গর্ভপাত: মার্কিন নারীদের গলার কাঁটা হচ্ছে ব্যক্তিগত ডেটা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট গর্ভপাত বিষয়ে যে রায় দিয়েছে তার ফলে দেশটির প্রায় অর্ধেক সংখ্যক অঙ্গরাজ্যে গর্ভপাত নিষিদ্ধের পট প্রস্তুত হয়েছে। এর ফলে দেশটিতে কোনো নারী যখন গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নেবেন, সম্ভবত তারা এ বিষয়ে সকল তথ্য গোপন রাখার চেষ্টা করবেন।

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 June 2022, 10:15 AM
Updated : 25 June 2022, 10:15 AM

কিন্তু তাতে কী শেষ রক্ষা হবে? দৈনন্দিন জীবনে প্রায় সকল ব্যক্তিগত তথ্যই প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো জানে। আর জানে আপনার স্মার্টফোন!

নতুন রায়ে যুক্তরাষ্ট্রে সব মিলিয়ে প্রজননক্ষম প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ নারী গর্ভপাতের অধিকার হারাতে পারেন বলে উঠে এসেছে গর্ভপাত নিয়ে কাজ করা স্বাস্থ্যসেবা সংগঠন ‘প্ল্যানড প্যারেন্টহুড’ এর গবেষণায়।

আর মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট প্রতিবেদনে বলছে, গুগল সার্চ, অবস্থানের তথ্য, ‎নারীদের ‎পিরিয়ড বিষয়ক অ্যাপ্লিকেশন‎‎ এবং অন্যান্য ডেটা নতুন বাস্তবতায় হয়ে উঠতে পারে ‘গর্ভপাত অপরাধের’ প্রমাণ হিসাবে ব্যবহারযোগ্য হাতিয়ার।

এর নজির এরইমধ্যে রয়েছেও। গোপনতা সমর্থক অধিকার কর্মীরা বলছেন, যারা গোপনে গর্ভপাত ঘটাতে চান, তাদের সকল ব্যক্তিগত ডেটা উঠে আসতে পারে কাঁধের ওপর বোঝা হিসেবে। ‎জনপ্রিয় অ্যাপ এবং ওয়েবসাইটগুলো দিনে হাজার বার ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ এবং শেয়ার  করে। এই বাস্তবতায় নারীরা তাদের প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য গোপন রাখবেন কীভাবে?‎

‘‎ডবস বনাম জ্যাকসন উইমেন্স হেলথ অর্গানাইজেশন’ মামলায় রায়ের খসড়া ফাঁস হওয়ার পর ডেমোক্রেটিক দলের আইনপ্রণেতারা ‘মাই বডি, মাই ডেটা অ্যাক্ট’ নামে একটি বিলের উদ্যোগ নিয়েছেন বটে, যা প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে ব্যক্তিগত তথ্যের ওপর ফেডারেল সুরক্ষা যোগ করবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, রিপাবলিকানদের সমর্থন ছাড়া এর আইনে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা কম।‎ আর গর্ভপাত নিষিদ্ধে রিপাবলিকান দলটিই সোচ্চার।

“এটি অসম্ভব উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো একটি বিষয়ই কেবল নয় - শেখারও বিষয়। বিশেষ করে জন্য বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি হওয়ার আগেই। কারণ সঙ্কট ঘণীভূত হওয়ার পর সেটি সামলানো অনেক কঠিন হয়ে উঠতে পারে।” – বলেন ফোর্ড ফাউন্ডেশনের প্রযুক্তি ফেলো সিনথিয়া কন্টি-কুক‎।

রায়ের পরপরই গোপনতা সমর্থক অধিকার কর্মীরা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে সকল ব্যক্তিগত তথ্য মুছে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সেইসঙ্গে তারা চাইছেন, এইসব কোম্পানি যেন ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহও বন্ধ করে।

কিন্তু বর্তমানের এই ডিজিটাল অর্থনীতিই দাঁড়িয়ে আছে ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ এবং এর বিপণনযোগ্য ব্যবহারের ওপর। এইসব ডেটা বারবার হাতবদল হয়, এক পর্যায়ে এ ডেটা গিয়ে পরে ‘ডেটা দালাল’ প্রতিষ্ঠানের হাতে- যারা বসে আছেন পর্বতসমান ব্যক্তিগত তথ্যের ভাণ্ডার নিয়ে।

এই ডেটাই হয়ে উঠতে পারে আদালতের সমন বা আদেশের অস্ত্র। সমস্যা হলো, অধিকাংশ প্রযুক্তি কোম্পানিই কোন কোন তথ্য তারা কারো হাতে তুলে দেবে অথবা দেবে না সে বিষয়ে কোনো প্রশ্নের সোজাসাপ্টা জবাব দেয় না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গুগল ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসে প্রায় ৪০ হাজার অনুরোধ পেয়েছে সমন বা তল্লাশী পরোয়ানার জন্য।

কেবল পুলিশই নয়, অর্থ খরচের সামর্থ থাকলে যে কেউ কিনতে পারেন এই ডেটা। এ কথা সত্যি গর্ভপাত বিরোধী কোনো সংগঠনের জন্যও।

কেবল মোবাইল ফোনে নজরদারীর ফলেই লাখ লাখ নারীর ওপর মামলার খড়্গ নামতে পারে, সেটা আপনি গর্ভপাত ঘটাতে চান বা এ বিষয়ে অন্য কাউকে সহায়তা দিতে চান। - বলেন ইয়েল ইনফর্মেশন সোসাইটি প্রজেক্টের নির্বাহী পরিচালক নিকোলাস গোগেনবার্গার।

“মানুষ নিরাপদ থাকতে চায়। সেই চাওয়া যখন আইনের বিপক্ষে যায়, সেটি রক্ত হিম করা অনুভূতি।”

অবস্থানের তথ্য

ম্যাপ এবং অন্যান্য পরিষেবার জন্য স্মার্টফোন আপনার অবস্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারে - একেবারে আপনি কোন ভবনে আছেন তেমন তথ্য সহ। বিভিন্ন অ্যাপ ইনস্টল করার আগে “আই অ্যাগ্রি” চেপে সেই তথ্য অন্যান্য কোম্পানির কাছে বিক্রি করার অধিকারও আপনি দিয়ে দিচ্ছেন। চাইলে যে কেউ ওই তথ্য কিনতেও পারে, যদি তারা এটা পাওয়ার জন্য অর্থ প্রদানে রাজী থাকে।

‎প্রযুক্তি সাইট ভাইসের ‘মাদারবোর্ড ব্লগ’ প্রতিবেদনে বলছে, কেবল ১৬০ ডলারে এটি সেইফগ্রাফ নামে একটি কোম্পানির কাছ থেকে এক সপ্তাহের ডেটা কিনেছে যা থেকে ছয়শ’টির বেশি ‘প্ল্যানড প্যারেন্টহুড ক্লিনিকে’ কারা করা গিয়েছেন, তারা কোথা থেকে এসেছেন এবং এরপর কোথায় গিয়েছেন সেই তথ্য মিলেছে।‎

‎এই ধরনের তথ্য ব্যবহার করে কোন কোন ক্লিনিক রাজ্যের বাইরে থেকে আসা নারীদের গর্ভপাত করায় সেটি শনাক্ত করা যেতে পারে।

‎সেইফগ্রাফের প্রধান নির্বাহী অরেন হফম্যান অবশ্য ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছেন, তার কোম্পানি গর্ভপাত সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোয় লোকজনের আনাগোনার ডেটা বিক্রি বন্ধ করার বিষয়টি বিবেচনা করছে। ‎সেইফগ্রাফ এবং এ ধরনের কোম্পানি সাধারণত নাম বা ফোন নম্বরসহ অবস্থানের তথ্য বিক্রি করে না। যদিও কোম্পানিটি গোপনতা সমর্থকদের তোপের মুখে পড়েছে এবং এ সংক্রান্ত বেশ কিছু রেওয়াজে পরিবর্তন আনছে।‎

‎তবে গোপনতা পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে অনেক কিছুই বের করে ফেলা যায়। উদাহরণস্বরূপ, গত বছর একটি ক্যাথলিক ব্লগ ডেটিং অ্যাপ্লিকেশন গ্রাইন্ডার থেকে পাওয়া অবস্থানের তথ্য সংগ্রহ করেছে যা থেকে  একজন যাজক যে সমকামী সেটি তারা উদঘাটন করেছেন। তারা কেবল তথ্য মিলিয়েছেন যে, ঠিক কোন কোন সময় একজন ব্যক্তি গীর্জায় ছিলেন আর কখন সমকামী ক্লাবে গিয়েছেন।‎

সার্চ ও চ্যাটিং হিস্ট্রি

ক্লিনিক বা ওষুধ বিষয়ে গুগল সার্চ হিস্ট্রিও একজন ব্যক্তির আগ্রহের বিষয়ে চিহ্ন রেখে যায়।

২০১৭ সালেই গর্ভপাতের ওষুধের জন্য ইন্টারনেট সার্চ থেকে পাওয়া তথ্য ব্যবহৃত হয়েছে একজন নারীর বিরুদ্ধে। অভিযোগ, তিনি ভ্রুন হত্যা করেছেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য গ্র্যান্ড জুরি ওই নারীকে অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি দেয় বলে জানিয়েছে, ‘ন্যাশনাল অ্যাডভোকেটস ফর প্রেগন্যান্ট উইমেন’। আবার গত বছরই, উইসকনসিনের সুপ্রিম কোর্ট সিদ্ধান্ত দেয় যে, গোয়েন্দারা কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই খুনে অভিযুক্ত জর্জ বার্চের ফোন থেকে তথ্য ও ইন্টারনেট সার্চের ডেটা সংগ্রহ করে কোনো আইন ভাঙেনি।

ব্যক্তিগত আলাপচারিতাও অপরাধ প্রমাণের সূত্র হতে পারে। ২০১৫ সালে গর্ভপাত বিষয়ে তথ্য চাওয়ার প্রমাণ ব্যবহৃত হয়েছে একজন নারীর বিরুদ্ধে ‘সন্তান পালনে অবহেলা’ প্রমাণে।

প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক অ্যাপ

লাখ লাখ নারী তাদের প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য জমা রাখেন এ বিষয়ক অ্যাপে। এর মধ্যে রয়েছে পিরিয়ডের তথ্য এবং এ থেকে পাওয়া সম্ভব কখন কার পিরিয়ড বা গর্ভধারণ শুরু হয়। গর্ভপাত নিষিদ্ধের ফলে এই তথ্যও ব্যবহৃত হতে পারে কাউকে অপরাধী প্রমাণে।

এই অ্যাপ নির্মাতারা গোপনতার প্রশ্নে নৈতিকতার যে ধার ধারেন না, তার প্রমাণ রয়েছে অনেক। ২০১৯ সালেই পিরিয়ড ট্র্যাকার ‘ওভিয়া’কে চাপে ফেলেছে একটি প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের ডেটা চেয়ে।

‎গত বছর ‎পিরিয়ড-ট্র্যাকিং অ্যাপ ফ্লো ব্যবহারকারীদের ডেটা ব্যক্তিগত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েও পরে ফেইসবুক এবং গুগলসহ বিপণন কোম্পানির সঙ্গে ডেটা শেয়ার করার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। ওই মামলা পরে নিষ্পত্তি হয় ফেডারেল ট্রেড কমিশনে।‎

জনপ্রিয়তায় শীর্ষে থাকা অন্তত পাঁচটি পিরিয়ড ট্র্যাকিং অ্যাপে ডেটা ব্যবহারে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে গুগলসহ তৃতীয় পক্ষের কাছে ডেটা বিক্রি করার প্রমাণও রয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, অ্যাপগুলো কীভাবে ডেটা শেয়ার করার ক্ষমতা পায়? ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন বলছে, কোনো ব্যক্তির সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবাদাতার তথ্য আইন করেই ব্যক্তিগত ও গোপনীয় বলে চিহ্নিত করা আছে যুক্তরাষ্ট্রের আইনে। কিন্তু পিরিয়ড বিষয়ক অ্যাপের ডেটা ওই শ্রেণিভূক্ত হিসেবে এখনও চিহ্নিত নয়।