মাস্কের হাতে টুইটারের ভবিষ্যৎ কী

সেন্সরশিপ কমিয়ে টুইটারে গণতন্ত্র আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিলেন আলোচিত প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্ক, এখন তার মালিকানায় এই ‘ডিজিটাল টাউন স্কয়্যার’-এর ভবিষ্যত কেমন হতে যাচ্ছে? উত্তরে আসছে নানা অনিশ্চয়তার কথা।

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 April 2022, 10:17 AM
Updated : 26 April 2022, 10:49 AM

ডিজিটাল মানবাধিকারকর্মীরা শুরু থেকেই আশঙ্কা করে আসছেন, যথাযথ সেন্সরশিপের অভাবে বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের প্রচার বাড়বে টুইটারে।

প্ল্যাটফর্মে নিষিদ্ধ বা স্থগিত হওয়া অ্যাকাউন্টগুলোকে আবার ফিরিয়ে আনা হবে কি না, এমন প্রশ্নও তুলেছেন টুইটার ব্যবহারকারীদের মধ্যে অনেকে। উল্লেখ্য, টুইটারে নিষিদ্ধ হওয়া সবচেয়ে ‘হাই-প্রোফাইল’ ব্যক্তি সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প।

অধিগ্রহণ চুক্তির ঘোষণা আসার পরপরই টুইটার নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। মাস্ক নিজেকে বাকস্বাধীনতার বড় সমর্থক বলে প্রচার করেন। কিন্তু মানবাধিকার সংস্থাগুলোর আশঙ্কা– টুইটারের ওপর মাস্কের একচ্ছত্র আধিপত্য বাকস্বাধীনতার নামে বিদ্বেষমূলক প্রচারণার পথ সুগম করবে।

সাধারণ ব্যবহারকারী হিসেবে মাস্ক ক্ষেত্রবিশেষে টুইটারকে কখনও ব্যক্তিগত গণযোগাযোগ প্ল্যাটফর্ম, কখনও ব্যক্তিগত ক্ষোভ মেটানোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। টুইটারে বিভিন্ন সময়ে মাস্কের খোঁচা-বিদ্রুপের শিকার হয়েছেন সাবেক অ্যামাজন প্রধান জেফ বেজোস থেকে শুরু করে রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা রসকসমসের প্রধান দিমিত্রি রোগোজিন।

এ ছাড়াও, ২০১৮ সালে থাইল্যান্ডে ‍গুহায় আটকা পড়া কিশোরদের উদ্ধারকাজে নিয়োজিত এক ব্রিটিশ ডাইভারকে ‘শিশু নিপীড়ক’ বলে টুইট করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন মাস্ক। উদ্ধারকর্মীদের ওপর মাস্ক খেপেছিলেন, কারণ তার মিনি সাবমেরিন ব্যবহারের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তারা।, গুহার কিছু সরু অংশে প্রবেশ করা একা একজন ডাইভারের জন্যই কষ্টকর ছিল। সেই পরিস্থিতিতে মাস্কের সাড়ে পাঁচ ফিট আকারের সাবমেরিন ব্যবহারের কোনো সুযোগই ছিল না।

সেই মাস্কই টুইটারের পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে সমঝোতায় আসার পর বাকস্বাধীনতাকে ‘গণতন্ত্রের ভিত্তিপ্রস্তর’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

অন্যদিকে, এক টুইটার থ্রেডে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, “ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য নির্মিত নীতিমালা ও কার্যপ্রণালীর ক্ষতি করতে পারে, টুইটারের এমন সম্ভাব্য পদক্ষেপ নিয়ে শঙ্কিত” সংস্থাটি।

“ব্যবহারকারীদের প্রতি সহিংস এবং নিপীড়নমূলক আচরণ ইচ্ছে করেই অগ্রাহ্য করে যায় এমন টুইটার মোটেই প্রত্যাশিত নয়।”

এ প্রসঙ্গে টুইটারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর পায়নি বিবিসি।

টুইটারে ফিরবেন ট্রাম্প?

গত বছরের ৬ জানুয়ারি ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল হিলে দাঙ্গার মদদ জুগিয়ে টুইটারে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন ডনাল্ড ট্রাম্প। তবে, নিষেধাজ্ঞা উঠলেই টুইটারে ফিরবেন না বলে দাবি করেছেন ট্রাম্প; বরং নিজের প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশাল’ ব্যবহারের করতে চান তিনি।

“আমি টুইটারে যাচ্ছি না। আমি ট্রুথেই থাকবো।”-- ফক্স নিউজকে বলেছেন ট্রাম্প।

তবে, মাস্ক একজন ‘ভালো মানুষ’ এবং তিনি প্ল্যাটফর্মটিকে আরও ‘উন্নত’ করবেন বলে বিশ্বাসের কথা জানিয়েছেন ট্রাম্প।    

বিবিসির কাছে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি ট্রাম্পের মুখপাত্ররা। তবে, বাজার বিশ্লেষকদের ধারণা, পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে ট্রাম্প সম্ভবত আবার টুইটারে ফেরার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

প্রযুক্তি বাজার বিশ্লেষক মিং-চি কুও বিবিসিকে বলেন, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে টুইটারে ফিরতে পারেন।

“বলার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে টুইটার এখনও তার জন্য তুলনামূলক সুবিধাজনক প্ল্যাটফর্ম, যদি টুইটার তার অ্যাকাউন্ট ফিরিয়ে আনতে রাজি হয়,” বলেন কুও।

“সামনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে টুইটারের চেয়েও বেশি প্রভাব আছে এমন প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা সহজ কাজ নয়।”-- যোগ করেন তিনি।

ব্যবহারকারীরা কি মুখ ফিরিয়ে নেবেন?

মাস্কের আশা, তিনি মালিক হওয়ার পরেও তার সমালোচকরা টুইটার প্ল্যাটফর্মেই থাকবেন। মাস্কের ভাষ্যে, ‘এটাই বাকস্বাধীনতার মানে’।

তবে বিবিসি বলছে, টুইটার ছাড়ার হুমকি দিয়েছেন কিছু ব্যবহারকারী, ইতোমধ্যেই টুইটার ছেড়েছেন কেউ কেউ।

মাস্কের মালিকানায় টুইটারে ‘অরাজকতা, বিদ্বেষ, অভিবাসী বিদ্বেষ এবং নারীবিদ্বেষ’ আরও বাড়বে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন ব্রিটিশ অভিনেত্রী জামিলা জামিল। নিজের ১০ লাখ টুইটার ফলোয়ারের উদ্দেশ্যে টুইট করেছেন, “আমি চাই যে… এটাই যেন আমার শেষ টুইট হয়।”

অন্যদিকে টুইটারে সাড়ে চার লাখ ফলোয়ার আছে ইউনিভার্সিটি অফ ম্যারিল্যান্ডের পোস্ট ডক্টোরাল গবেষক ক্যারোলিন ওর বুয়েনোর; আপাতত টুইটারের থাকার সিদ্ধান্ত নিলেও মাস্কের নেতৃত্ব নিয়ে শঙ্কিত তিনিও।

বুয়েনো টুইট করেছেন, “আমরা জানি না যে মাস্কের মালিকানায় টুইটারের কী অবস্থা হবে। তবে, আমরা এটা জানি যে সব ভদ্র মানুষ চলে গেলে, খুব দ্রুত পরিস্থিতি খারাপ হবে এখানে।”

এ প্রসঙ্গে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ‘ওয়েডবুশ সিকিউরিটিজ’-এর বাজার বিশ্লেষক ড্যান আইভসের মত, বেশিরভাগ ব্যবহারকারী এখন সম্ভবত দেখে শুনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কৌশল অবলম্বন করবেন।

“এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে নতুন ব্যবহারকারীদের আকৃষ্ট করা এবং পুরনোদের প্ল্যাটফর্মে ধরে রাখা,”-- বলেন তিনি।

সামনে অনিশ্চয়তা

টুইটারের ১১ সদস্যের যে পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে মাস্ক চার হাজার চারশ কোটি ডলারের অধিগ্রহণ চুক্তির সমঝোতায় এসেছেন, তাদের মধ্যে এখনও আছেন টুইটারে সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং সাবেক প্রধান নির্বাহী জ্যাক ডরসি। মালিকানা মাস্কের হাতে যাওয়া বিষয়টিকে ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখছেন তিনি।

তবে, সার্বিক বিবেচনায় ডরসির বক্তব্য বিপরীতমুখী মনে হতে পারে। একদিকে, ‘টুইটার কেউ একা চালাবে বা নিয়ন্ত্রণ করবে,’ এতে বিশ্বাস করেন না ডরসি। অন্যদিকে, মাস্কের মালিকানায় যাওয়ার পর টুইটার ‘উন্মুক্ত-আলোচনায় সমর্থন দিয়ে যাবে’ বলে নিজের খুশির কথাও বলেছেন তিনি।

মঙ্গলবারের এক টুইটে ডরসি বলেছেন, “নীতির মূলে জনগনের জন্য ইতিবাচক কিছু হতে চায় এটি, কোম্পানি নয়। আর কোম্পানি সমস্যার সমাধান হিসেবে ইলন হলো একমাত্র সমাধান যাতে আমার বিশ্বাস আছে।”

অন্যদিকে টুইটারের বর্তমান কর্মীদের কোনো আশার বাণী দিতে পারেননি টুইটারের বর্তমান প্রধান নির্বাহী পারাগ আগরাওয়াল। প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বলে কর্মীদের জানিয়েছেন তিনি।

“চুক্তি সম্পন্ন হলে প্ল্যাটফর্ম কোন দিকে যাবে সে বিষয়ে জানি না আমরা,” আগরাওয়াল কর্মীদের উদ্দেশ্যে এমনটাই বলেছেন বলে উঠে এসেছে রয়টার্সের প্রতিবেদনে।

রাজনীতিবিদদের মধ্যেও আছে বিভক্তি

সোমবারেই হোয়াইট হাউজ মুখপাত্র জেন সাকি সংবাদকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, টুইটার যার মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণেই থাকুক না কেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ‘বরাবরই বড় সামাজিক মাধ্যমগুলোর ক্ষমতা নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন।’

ডেমোক্রেটিক দলের সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেনের মতে, এই চুক্তি ‘গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক’।

তবে, রিপাবলিকান পার্টির সিনেটর মার্শা ব্ল্যাকবার্নের মতে, মাস্ক এবং টুইটার পরিচালকদের মধ্যে অধিগ্রহণ চুক্তির সমঝোতা ‘বাকস্বাধীনতার জন্য একটি উত্সাহজনক দিন।’