সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন ঢাকার ফাহাদ বিন সাখাওয়াত। সঙ্গে সঙ্গে তিনটি নম্বরে চলে গিয়েছিল সম্ভাব্য বিপদের খবর। তবে, সেই খবরটি কোনো মানুষ জানাননি, জানিয়েছে হাতের স্মার্টওয়াচ।
Published : 20 Apr 2022, 09:43 PM
বড় কোনো বিপদ হয়নি ফাহাদের। তবে, গেল কয়েক বছরে কব্জিতে স্মার্টওয়াচ থাকার সুবাদে জীবন বেঁচেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বেশ কিছু মানুষের।
অস্ট্রেলিয়ার কিশোরীর লেক্সি নর্থকট জন্মদিনের উপহার হিসেবে বায়না ধরেছিলেন একটি অ্যাপল ওয়াচের। দিন কয়েকের ব্যবধানে তার জীবন বাঁচিয়েছে সেই ‘চটপটে’ ঘড়িই।
বারবার ভাইব্রেট করে চলছিল স্মার্টওয়াচটি। কারণ ঘুমের মধ্যে লেক্সির হৃদস্পন্দন বিপজ্জনক হারে কমে গিয়েছিল। ওই সতর্কবার্তায় দ্রুত সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে দৌঁড়েছিলেন লেক্সির মা। চারদিন পরেই লেক্সির হৃদযন্ত্রে পেসমেকার বসিয়ে তার জীবন বাঁচান চিকিৎসকরা।
প্রযুক্তি পণ্য হিসেবে বাজারে স্মার্টওয়াচের বহুল প্রচলন হয়তো বেশি দিনের নয়, তবে এক দশকেরও কম সময়ে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক হারে বিক্রি বেড়েছে ডিভাইসটির। বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘কাউন্টারপয়েন্ট রিসার্চ’ বলছে, ২০২১ সাল পর্যন্ত বছর ওয়ারি স্মার্টওয়াচের বৈশ্বিক বাজার বেড়েছে ২৪ শতাংশ হারে।
প্রথম সারির ডিভাইস নির্মাতা অ্যাপল থেকে শুরু করে চীনের শাওমি পর্যন্ত বানাচ্ছে কব্জিতে পরিধেয় ডিভাইসগুলো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফিটনেস ডিভাইস হিসেবে অথবা সুপরিকল্পিত স্বাস্থ্য রক্ষা কৌশলের আনুসাঙ্গিক পণ্য হিসেবে ডিভাইসগুলো বাজারজাত করছেন নির্মাতা। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রেতারা কেন কিনছেন এই আধুনিক ডিভাইস?
স্মার্টওয়াচের সেই বৈশ্বিক ঢেউ বাংলাদেশে এসেছে বেশ কিছুদিন আগেই। প্রশ্ন হলো, প্রতিশ্রুতি আর সম্ভাবনার বিচারে বাংলাদেশের দৃশপট কি একই, না কিছুটা ভিন্ন।
বাংলাদেশেও পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ডিভাইসগুলো, ক্রেতাদের মধ্যেও আছে আগ্রহ। ব্র্যান্ড ও মডেলভেদে ডিভাইসগুলোর দাম বাংলাদেশী টাকায় আড়াই হাজার থেকে শুরু করে প্রায় ৫০ হাজার পর্যন্ত। তবে, বাংলাদেশের ক্রেতারা ডিভাইসগুলোকে কেবল শখের ফ্যাশন পণ্য হিসেবে কিনছেন, নাকি হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ, আর অক্সিজেন মাপার সেন্সরসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট ফিচার বা হেলথ ফিচার বিবেচনায় নিয়ে কিনছেন, সে প্রশ্নেই দৃশ্যপট ঘোলাটে।
বাংলাদেশে প্রতিবছর ঠিক কতোগুলো স্মার্টওয়াচ বিক্রি হচ্ছে, বা বাজার বৃদ্ধির হার কেমন– এমন প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাওয়া বেশ কঠিন কাজ। তবে, প্রতিবেশি দেশ ভারতের দিকে তাকালে হয়তো একটি উন্নয়নশীল দেশে নতুন প্রযুক্তির চাহিদা ও ব্যবহার নিয়ে কিছুটা ধারণা মেলে। ভারতে ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে স্মার্টওয়াচের বিক্রি বেড়েছে ২৭৪ শতাংশ। আর এর ৭৫ শতাংশই ছিল দেশটির স্থানীয় ব্র্যান্ডের তৈরি তুলনামূলক কম দামের ডিভাইস।
অন্যদিকে, বাংলাদেশে তরুণদের হাতেই ডিভাইসগুলো নজরে পড়ে বেশি। এমন বেশ কয়েকজন স্মার্টওয়াচ ব্যবহারকারীর সঙ্গে কথা বলে ইঙ্গিত মিললো, সম্ভবত হেলথ ফিচারের বদলে ফ্যাশন পণ্য হিসেবেই ডিভাইসগুলোর প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ বেশি।
বিপণন পেশায় আছেন মাইদুল ইসলাম, স্মার্টফোন নির্মাতা শাওমির তৈরি হেইলোউ এলএস মডেলের স্মার্টওয়াচ ব্যবহার করছেন বছর দুয়েকের বেশি হল। স্মার্টওয়াচ কেন কিনেছিলেন এমন প্রশ্নের উত্তরে বললেন, “শখে ফ্যাশন পণ্য হিসেবে কিনেছিলাম। আমার আসলে অ্যানালগ ঘড়িই বেশি ভালো লাগে।”
সবমিলিয়ে স্মার্টওয়াচটি নিয়ে ‘সন্তুষ্ট নন’, তাই ভবিষ্যতে একই ধরনের পণ্য আর কেনার ইচ্ছা নেই বলে জানালেন তিনি। কারণ হিসেবে বললেন ডিভাইসটি নিয়ে তার নানা অতৃপ্তির কথা।
“আগের মতো দীর্ঘস্থায়ী নয় ব্যাটারি। কয়েকবার পরীক্ষা করে দেখেছি, ফোনের সঙ্গে কানেক্ট করা থাকলেও হঠাৎই ডিসকানেক্ট হয়ে যায়।” ফোন কল আসলে স্মার্টওয়াচটিতে তার নোটিফিকেশন আসার ফিচার থাকলেও বারবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার যন্ত্রণায় স্মার্টফোনের সঙ্গে ডিভাইসটির সংযোগ রাখাই বন্ধ করে দিয়েছেন বলে জানালেন তিনি।
আর ডিভাইসটি হেলথ ফিচার আর সেন্সর থেকে আসা ডেটাকেও নির্ভরযোগ্য বলে মনে করেন না মাইদুল, তাই ফিচারগুলো ব্যবহারের প্রয়োজনও অনুভব করেন না বলে জানালেন তিনি।
আছে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি
মাইদুলের মতোই শখের বসে অ্যাপলের প্রথম প্রজন্মের অ্যাপল ওয়াচ কিনেছিলেন ফাহাদ বিন সাখাওয়াত। বর্তমানে পঞ্চম প্রজন্মের অ্যাপল ওয়াচ ব্যবহার করছেন তিনি। তবে, স্মার্টওয়াচ তথা এই পুরো প্রযুক্তি নিয়েই তার অভিজ্ঞতা ও মতামত বেশ ভিন্ন। স্বাস্থ্যবিষয়ক ফিচারগুলো আলাদা গুরুত্ব পাচ্ছে পেশায় এই আইনজীবির কাছে, মাইদুলের মতো কব্জির ডিভাইসটি নিয়ে নানা আক্ষেপ-অভিযোগ থাকলেও কারণগুলো একেবারেই ভিন্ন।
অ্যাপল নিজের সবগুলো ডিভাইসকে একই ‘ইকোসিস্টেম’ বা বাস্ততন্ত্রের অংশ হিসেবে বাজারজাত করে। এই বিষয়টির গুণগান করে ফাহাদ বললেন নিজের অন্যান্য অ্যাপল ডিভাইসের সঙ্গে স্মার্টওয়াচটির সিঙ্ক করার বেলায় বাড়তি সুবিধা পাওয়ার কথা।
“আর প্রতিবার আপডেটের পর স্মার্টওয়াচের রেসপন্স স্লো হয়ে যায়। ঘড়িতে সময় ঠিকই দেখায়, কিন্তু প্রতিটি কাজে আগের চেয়ে বেশি সময় নেয়, কোনো কারণে ঘড়ি রিস্টার্ট করলেও চালু হতে সময় লাগে আগের চেয়ে বেশি। ব্যাটারি ব্যাকআপও কমতে থাকে।”
এমন নানা অভিযোগের পরেও হাতের স্মার্টওয়াচটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে রাজি নন এই ‘প্রযুক্তি পাগল’ ব্যবহারকারী। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বললেন নিজের সেই সিড়ি থেকে পড়ে যাওয়ার কথা।
‘অল্পের ওপর’ ফাহাদ বেঁচে গেলেও বিপদে পড়েছিলেন নরওয়ের নাগরিক তুরাভ এস্ত্রাং। বন্ধুর বাসার গভীর রাতে রক্তচাপ কমে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন ৬৮ বছর বয়সী এস্ত্রাং, পড়ার সময়ে আঘাত লেগে রক্তপাতও হয়েছিল। বন্ধুর বাসার কেউ কোনো কিছু টের পায়নি, কিন্তু মাঝরাতে ঠিকই দরজার কড়া নাড়ছিল পুলিশ। সেই ‘ফ্রিফল ডিটেকশন’ ফিচারের কারণেই সরাসরি খবর এবং ‘লোকেশন’ পৌঁছে গিয়েছিল স্থানীয় জরুরী সেবাদাতাদের কাছে।
বাইকারদের কাছে আলাদা কদর
বাংলাদেশের স্মার্টওয়াচ ব্যবহারকারীদের সঙ্গে কথা বলে এ ধরনের ডিভাইসের একটি আলাদা কদরের জায়গার সন্ধান মিললো। আইটি খাতের দীর্ঘ দিনের কর্মী শাহরিয়ার বাপ্পী জানালেন, ‘মোটরবাইক চালানোর সময় কাজে আসে স্মার্টওয়াচ’।
“বাইক চালানোর সময় কোনো কল এলে কব্জিতেই টের পাই আমি। জরুরী কোনও ফোন কল হলে বাইক থামিয়ে কল রিসিভ করে কথা বলি, না হয় কেটে দেই। আর আমার ঘুমের সমস্যা আছে, তাই স্লিপ মনিটর কিছুটা হলেও কাজে আসে। ওয়াটার রেজিস্ট্যান্ট, এটাও ভালো দিক,” বললেন বাপ্পী।
এর বাইরে ডিভাইসটির হেলথ ফিচারের কোনোটিকেই খুব একটা নির্ভরযোগ বলে মনে করেন না তিনি।
“বিল্ট ইন স্পিকার থাকলে আরও ভালো হতো, আর ঘড়ির স্ট্র্যাপের মানটিও খুব একটা ভালো নয়,” এমন খুঁটিনাটি অভিযোগের কথা বললেও সার্বিকভাবে এই প্রযুক্তিকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন বাপ্পী। “এরপর স্মার্টওয়াচ কিনলে আরও ভালো কিছু কিনবো, অ্যাপল বা স্যামসাংয়ের।”
অভিযাত্রীদের জন্য সুনতো!
নামটি বাংলাদেশে বেশ অপরিচিত হলেও ফিনল্যান্ডে তৈরি স্মার্টওয়াচ সুনতোর কদর অভিযাত্রীদের কাছে বেশি। কিন্তু কেন?
২০১২ সাল থেকে এই ব্র্যান্ডের ঘড়ি ব্যবহার করছেন সালমা খাতুন। তিনি জানালেন, চরম আবহাওয়ায় চুলচেরা তথ্য পাওয়ার বেলায় অভিযাত্রীদের কাছে নির্ভরযোগ্য ব্র্যান্ড এই সুনতো (Suunto)।
“এই সুবিধাগুলো তো আছেই, সেইসঙ্গে এর ব্যবহার একেবারে সহজ।”
বাংলাদেশ ও বিশ্ববাজার
পরিসংখ্যানের সাইট স্ট্যাটিসটিকার তথ্য বলছে, গেল কয়েক বছরে স্মার্টফোনের বিশ্ববাজারে একটা বড় অংশ দখল করে রেখেছে অ্যাপল, স্যামসাং, ফিটবিট এবং গারমিনের মতো প্রথম সারির প্রতিষ্ঠানগুলো। নির্মাতার বাজার অবস্থানের প্রতিফলন হচ্ছে যেন ডিভাইসের দামেও।
ডিভাইসের দাম কোন ব্যবহারকারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে কতোটা প্রভাবিত করছে, সে প্রশ্নও থেকেই যায়। ডিভাইসগুলো কতোটা অ্যাপ সমর্থন পাচ্ছে এবং সেটি কতোটুকু কার্যকর সে বিষয়েও ব্যবহারকারীদের মধ্যে আছে মত বিভেদ। কিন্তু সার্বিক বিবেচনায় কি বলা সম্ভব, বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্মার্টওয়াচ প্রযুক্তি আর বিভিন্ন ফিচারের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে দেশের ক্রেতাদের?
উত্তরটি সম্ভবত হ্যাঁ।