হোয়াইট হাউজের “সাইবার নিরাপত্তা সতর্কতা” বাড়ানোর এই আহ্বানে সমর্থন দিয়েছে যুক্তরাজ্যের সাইবার নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ। তবে, রাশিয়া যে সাইবার হামলার পরিকল্পনা করছে তার কোনো প্রমাণ দেয়নি দুই দেশের কেউই।
এ ধরনের অভিযোগকে আগেও “রুশোফোবিয়া” বা রাশিয়া ভীতি বলে আখ্যা দিয়েছে রাশিয়ার সরকার। তবে, বিশ্ববাজারে ‘সাইবার সুপারওপাওয়ার’ হিসেবে পরিচিতি আছে রাশিয়ার। বলা হয়, সাইবার অস্ত্রের কমতি নেই দেশটির হাতে, আছে একটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে গুরুতর ক্ষতিসাধনে সক্ষম সাইবার আর্মি।
সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ‘র্যাপিড৭’ গণযোগাযোগ বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেন এলিস বলছেন, “বাইডেনের সতর্কবার্তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে, বিশেষ করে পশ্চিমা শক্তি যখন একের পর এক অবরোধ দিচ্ছে, হ্যাকটিভিস্টরা জড়িয়ে পড়ছে এই দ্বন্দ্বে, আর আগ্রাসনের গতিপথ পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোচ্ছে বলেও মনে হচ্ছে না।”
এমন পরিস্থিতিতে পশ্চিমা শক্তির ওপর তিন ধরনের হ্যাকিংয়ের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ব্ল্যাকএনার্জি - গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর উপর হামলা।
ইউক্রেইনকে ক্ষেত্রবিশেষে বলা হয় থাকে, রাশিয়ার হ্যাকারদের খেলাঘর। নতুন নতুন কৌশল ও টুলের কার্যকারীতা যাচাই করতে ইউক্রেইনের উপর হামলা চালিয়ে এসেছে রাশিয়ার হ্যাকাররা।
২০১৫ সালে সাইবার হামলায় ব্যাহত হয়েছিল ইউক্রেইনের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা। ওই সাইবার হামলার নামকরণ করা হয়েছে ‘ব্ল্যাকএনার্জি’। ওই হামলায় অস্থায়ীভাবে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন পশ্চিম ইউক্রেইনের ৮০ হাজার নাগরিক।
ওই হামলার প্রায় এক বছর পর একই ধরনের সাইবার হামলার শিকার হয়েছিল ইউক্রেইনের রাজধানী কিইভি। ‘ইনডাস্ট্রয়ার’ হামলায় প্রায় এক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিল কিইভের এক-পঞ্চমাংশ।
দুবারই হ্যাকিংয়ের জন্য রাশিয়ার সামরিক হ্যাকারদের দায়ী করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
“তবে, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় সাইবার হামলার কোনোটিতেই দীর্ঘ সময়ের জন্য সরবরাহ ব্যবস্থা বন্ধ ছিল না।” – তিনি বলেন।
“জটিল প্রকৌশল ব্যবস্থায় ওপর কার্যকরী সাইবার হামলা চালানো খুবই কঠিন কাজ এবং দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিসাধন বিল্ট-ইন নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে প্রায় অসম্ভব।”
বিবিসি জানিয়েছে, এ ধরনের সাইবার কর্মকাণ্ড রাশিয়ার জন্য হিতে-বিপরীত হতে পারে বলে মনে করছেন মারিনার মতো বিশেষজ্ঞরা। কারণ, রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কগুলোতেও সম্ভবত শক্ত উপস্থিতি আছে পশ্চিমা সাইবার শক্তির।
নটপেটইয়া: অনিয়ন্ত্রিত ধ্বংসযজ্ঞ
ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সাইবার হামলা হিসেবে বিবেচনা করা হয় ‘নটপেটইয়া’ ম্যালওয়্যার হামলাকে। ম্যালওয়্যারটির জন্য রাশিয়ার সামরিক হ্যাকারদেরই দায়ী করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন।
ইউক্রেইনে জনপ্রিয় একটি হিসারক্ষণ সফটওয়্যারের আপডেটে লুকানো ম্যালওয়্যারটি ছড়িয়ে পরেছিল বিশ্ববাজারে। কয়েক হাজার প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার সিস্টেমে সংক্রমমিত হয়ে অন্তত এক হাজার কোটি ডলারের আর্থিক ক্ষতি করেছিল ম্যালওয়্যারটি।
দেড়শ’ দেশের তিন লাখ কম্পিউটারে সংক্রমিত হয়ে ডেটা এলোমোলো করে দিয়েছিল ‘ওয়ানাক্রাই’ ভাইরাস।
এ প্রসঙ্গে জেন এলিস বলেন, “এ ধরনের হামলাগুলোই সবচেয়ে বেশি বিশৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং জীবননাশের পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।”
“অনেক দূরের চিন্তা মনে হতে পারে, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগুলো সাধারণত আধুনিক জীবনের অন্যান্য দিকগুলোর মতো সংযুক্ত প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে। আমরা যুক্তরাজ্যের হাসপাতালগুলোর ওপর ওয়ানাক্রাইয়ের প্রভাব থেকে এর সম্ভাব্যতা দেখতে পেরেছি।”
তবে, ইউনিভার্সিটি অফ সারে’র অধ্যাপক অ্যালান উডওয়ার্ডের মতে, এমন হামলায় ঝুঁকি আছে রাশিয়ার জন্যও।
“এ ধরনের অনিয়ন্ত্রিত হ্যাকিংগুলো অনেকটাই জৈবিক যুদ্ধের মতো, এতে নির্দিষ্ট কোনো গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ব্যবস্থাকে টার্গেট করা বেশ কঠিন কাজ। রাশিয়াতেও অঘটন ঘটিয়েছে নটপেটইয়া এবং ওয়ানাক্রাই।”
কলোনিয়াল পাইপলাইন
২০২১ সালের মে মাসে হ্যাকাররা মার্কিন জ্বালানী তেলের পূর্বাঞ্চলীয় নেটওয়ার্কের গুরুত্বপূর্ণ পাইপলাইন বন্ধ করে দেওয়ায় বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে জরুরী অবস্থা জারি করতে বাধ্য হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বতীরের ৪৫ শতাংশ ডিজেল, পেট্রোল এবং জেট ফিউয়েল সরবরাহ করতো কলোনিয়াল পাইপলাইন। সরবরাহ বন্ধ থাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পরেছিল তেলের পাম্পগুলোতে।
জ্বালানী তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি পরে নিজস্ব কম্পিউটার সিস্টেমের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে মুক্তিপণ হিসেবে ৪৪ লাখ ডলারের বিটকয়েন দিয়েছিল হ্যাকারদের।
এর কয়েক সপ্তাহ পরেই হ্যাকারদের দল ‘আরইভিল’-এর র্যানসমওয়্যার হামলার শিকার হয় বিশ্বের বৃহত্তম গো-মাংস প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান জেবিএস।
সাইবার নিরাপত্তা গবেষকদের একটি বড় আশঙ্কা হলো, ক্রেমলিন হয়তো হ্যাকারদের যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেটগুলোর ওপর সমন্বিত আক্রমণ চালানোর নির্দেশ দেবে যাতে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে বড় আকারের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।
“আর এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো দায় এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ। কারণ, এই দলগুলোর সঙ্গে রাশিয়া সরকারের দূরত্ব।”
জবাবে যুক্তরাষ্ট্র কী করবে?
বিবিসি বলছে, নেটোভুক্ত দেশগুলোর সাইবার হামলার শিকার হয়ে জনসাধারণের প্রাণনাশ ও অপূরণীয় ক্ষতির ভুক্তভোগী হওয়ার আশঙ্কা কম। তবে, এমন কিছু যদি ঘটেও, সেক্ষেত্রে নেটো চুক্তির ‘আর্টিকেল ৫’ কার্যকর হবে। নেটোভুক্ত দেশগুলোর জোটবদ্ধ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কথা বলা আছে এতে।
কিন্তু এতে নেটোও যুদ্ধে জড়িয়ে পরবে। কিন্তু, নেটো এই যুদ্ধের অংশ হতে চায় না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাই, রাশিয়ার সাইবার আগ্রাসনের কোনো উত্তর এলে, সেটি নেটোর বদলে সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র এবং কাছের মিত্রদেশগুলোর কাছ থেকেই আসবে।
ইতোমধ্যেই, রাশিয়ার সাইবার হামলা চালালে, “আমরা উত্তর দিতে প্রস্তুত আছি” বলে ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। তবে, ইউক্রেইন-রাশিয়ায় চলমান ‘সাইবার অস্থিরতা’ থেকে ধারণা মেলে যে, অসামরিক হ্যাকারদের অংশগ্রহণ থাকলে কতো দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে পরিস্থিতি।
তাই, সরকারি পর্যায়ে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তা সাবধানতার সঙ্গে ভেবে দেখা হবে বলে উঠে এসেছে বিবিসির প্রতিবেদনে।