স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবির মাধ্যমে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ডের উপর শখের বশে নজর রাখা মানুষদের একজন যুক্তরাজ্যের কাইল গ্লেন। টুইটারের ‘কনফ্লিক্ট নিউজ’ অ্যাকাউন্টের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ওয়েলশ নিবাসী গ্লেন যার পেশা প্রকল্প ব্যবস্থাপনা। অ্যাকাউন্টটির ফলোয়ার সংখ্যা চার লাখের বেশি। জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া যুদ্ধের ছবি ও ভিডিও শেয়ার করে অ্যাকাউন্টটি।
বছরের শুরু থেকেই ইউক্রেইন সীমান্তে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর উপর নজর রাখছিলেন গ্লেনের মতো অনেকেই। অনলাইন দুনিয়ায় তারা ইতিমধ্যে পরিচিতি পেয়েছেন “ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটি” হিসেবে।
অনলাইন সেবা ‘স্কাইওয়াচ’ থেকে স্যাটেলাইট ছবি কিনে শেয়ার করেছেন গ্লেন। বিবিসির প্রতিবেদন বলছে, টানা কয়েক মাস ধরে ইউক্রেইন সীমান্তে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি এবং আগ্রাসনের প্রস্তুতি ধরা পরেছিল ছবিগুলোতে। এমনকি আগ্রাসনের শুরুরটাও ধরা পড়েছিল স্কাইওয়াচের ছবিতে।
তেমনই একটি রাশিয়ান ক্যাম্পের স্মৃতি মনে করে গ্লেন বলেন, “শূন্যস্থান থেকে বড় কিছুতে পরিণত হতে দেখেছি আমরা। আবার আগ্রাসন শুরুর আগের দিনেই খালি হয়ে গিয়েছিল সব।”
“আমি একাজ থেকে কোনো পয়সা পাই না। এটা পুরোপুরি একটা শখ, স্বেচ্ছাসেবা বা আপনি যা ইচ্ছা বলতে পারেন একে,” নিজের কাজ নিয়ে বলেন গ্লেন।
মূল ধারার সংবাদমাধ্যমগুলোতে ইউক্রেইন যুদ্ধ নিয়ে যতো খবর এসেছে, তার একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল সামাজিক মাধ্যমে পাওয়া ছবি আর ভিডিও কনটেন্ট। এর মধ্যে আছে রাশিয়ার সামরিক বহরের গতিবিধির ছবি থেকে শুরু করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত শহরের ছবিসহ মানুষকে চমকে দেওয়ার মতো কনটেন্ট।
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবিতে ধরা পড়েছে রাশিয়ার বিধ্বস্ত হেলিকপ্টার, ইউক্রেইনের কয়েকটি শহরে রাশিয়ার হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত শপিং সেন্টার আর মারিউপুলের আবাসিক এলাকা।
গেল কয়েক বছরের যুদ্ধ-বিগ্রহের ঘটনাতেও স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্তের উপস্থিতি ছিল অনলাইনে। কিন্তু, রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের যে পরিমাণ তথ্য-উপাত্ত বর্তমানে অনলাইনে রয়েছে, সে তুলনায় আগের তথ্য-উপাত্তের আকার নেহাতই নগণ্য ছিল বলে জানিয়েছেন গ্লেন।
বিবিসি বলছে, এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে এমন তথ্য-উপাত্তের সহজলভ্যতায়। স্যাটেলাইটের থেকে সংগ্রহ করা তথ্য আর ছবি জাতীয় নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে গোপন রাখে বিভিন্ন দেশের সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। কিন্তু, বাণিজ্যিক স্যাটেলাইট প্রতিষ্ঠানগুলোর ‘আনক্লাসিফায়েড’ ছবি ও তথ্য-উপাত্ত বিক্রির অনুমতি আছে দীর্ঘ দিন ধরেই। রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের বেলায় এই তথ্য-উপাত্ত, আর ছবি-ভিডিওতে সহজ নাগাল পাচ্ছেন বিশ্বের সবাই।
গোয়েন্দা সংস্থা আর সামরিক বাহিনীর বাইরেও বিভিন্ন কাজে স্যাটেলাইট ব্যবহার করে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এবং গবেষণা সংস্থা; দাবানলের গতিপথ থেকে শুরু করে মাঠের ফসল এমনকি সমুদ্রে ভাসমান জাহাজের গতিবিধির উপর নজর রাখতেও ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন স্যাটেলাইট।
এর ফলে কক্ষপথে বাণিজ্যিক স্যাটেলাইটের সংখ্যা বেড়েছে এবং তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে কাজে লাগানোর সুযোগও বেড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বাজার বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান ‘কুইল্টি অ্যানালিটিক্স’-এর অংশীদার ক্রিস কুইল্টি।
“আকাশে এখন অনেক চোখ”-- বলেন তিনি।
গেল দুই দশকে মহাকাশে স্যাটেলাইটের সংখ্যা বেড়েছে লক্ষ্যণীয় হারে। এখন চাইলেই প্রতি বর্গ কিলোমিটার ১০ ডলার হারে স্যাটেলাইট থেকে তোলা হাই-রেজুলিউশন ছবি কিনতে পারেন যে কেউ।
আর ক্ষেত্রবিশেষে ছবিগুলোর রেজুলিউশন এতোটাই ভালো থাকে যে, ৩০ সেন্টিমিটার বাই ৩০ সেন্টিমিটার ভূ-পৃষ্ঠের ছবিতেও পরিষ্কার বোঝা যায় ছোটখাটো খুঁটিনাটি। যানবাহন বা রাস্তার দিকচিহ্নের মতো বিষয়গুলো চিহ্নিত করা যায় সহজেই।
এ ছাড়াও, চাইলে ২৪ ঘণ্টায় একাধিকবার একই জায়গার ছবি তোলার জন্য স্যাটেলাইটকে প্রোগ্রাম করতে পারে পরিচালক প্রতিষ্ঠান। ফলে পরিবর্তনগুলো সম্পর্কেও তথ্য পাওয়া যায় সহজেই।
প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবি নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহও বেড়েছে বলে জানিয়েছেন কুইল্টি।
“মৌলিক সক্ষমতায় নাটকীয় কোনো পরিবর্তন আাসেনি। বরং মানুষের ডেটা হজম করা ও ব্যবহারের সদিচ্ছা এবং পন্থায় পরিবর্তন এসেছে।”-- বলেন তিনি।
আরও উন্নত প্রযুক্তির ‘সিনথেটিক অ্যাপারচার রেডার (এসএআর)’ ছবির ক্ষেত্রেও সাধারণ মানুষের এই আগ্রহ আছে বলে জানিয়েছে বিবিসি। এই ছবিগুলো বিশ্লেষণের কাজ অনেক ক্ষেত্রেই অপটিকাল লেন্সে তোলা ছবির তুলনায় বেশ জটিল।
এমন ছবিগুলোই রাশিয়ার আগ্রাসনের শুরুর দিনগুলোতে সামরিক বহরের গতিবিধির উপর নজর রাখতে সহযোগিতা করেছিল বলে জানিয়েছেন গ্লেন।
ইউক্রেইন প্রসঙ্গে অনলাইনে মিথ্যাচার আর ভুয়া তথ্যের প্রচারণা মোকাবেলা করতেও ছবিগুলো বড় ভূমিকা রাখছে বলে মন্তব্য করেছেন জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির ‘সেন্টার ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড ইমার্জিং টেকনোলজি’র সহযোগী পরিচালক রিটা কোনায়েভ। স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবি “১০-১৫ বছর ধরে আধুনিক যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ” অংশ হয়ে উঠেছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
তবে, এবারে স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া তথ্য উপাত্তের আকার এবং এর সহজলভ্যতা আগ্রাসন নিয়ে ভুয়া তথ্যের প্রচারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
“কিইভের মতো ইউরোপিয়ান শহরগুলোর স্থাপত্য কাঠামো পশ্চিমা দুনিয়ার কাছে খুবই পরিচিত,” মন্তব্য ড. কোনায়েভের। এই “পরিচিত” অনুভূতিই আগ্রাসন নিয়ে পশ্চিমাদের প্রভাবিত করেছে বলে ধারণা করছেন তিনি; মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধগুলোর বেলায় যেমনটা হয়নি।
অন্যদিকে, ‘কনফ্লিক্ট নিউজ’ এবং এর মতো অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম অ্যাকাউন্টের ফলোয়াররা নিজেই অনলাইনে ছবির নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করতে পারেন বলে জানিয়েছেন গ্লেন; “আপনি নিরপেক্ষভাবে বড় পরিসরে দর্শকদের কাছে তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরতে পারছেন যেন মানুষ নিজেই তাদের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।”
তবে, গ্লেন এটাও স্বীকার করে নিয়েছেন যে, কখন কী শেয়ার করবেন, সে সিদ্ধান্তগুলো কথিত “ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটি” সদস্যরা নিজেরাই নিচ্ছেন। ইউক্রেইন-রাশিয়া প্রশ্নে নিজেও ইউক্রেইনের দিকে ঝোঁকার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন তিনি। তাই ইচ্ছা করেই ইউক্রেইনের সামরিক বাহিনীর গতিবিধি নিয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করেননি বলে জানিয়েছেন গ্লেন। ইউক্রেইনের সামরিক বাহিনীকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে চান না তিনি।
ব্যক্তিমালাকাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কয়েকটি সরাসরি ইউক্রেইনের সামরিক বাহিনীকেও স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবি সরবরাহ করছে বলে জানিয়েছে বিবিসি। এর মধ্যে আছে কানাডার প্রতিষ্ঠান ‘এমডিএ’।
ড. কোনায়েভের মতে স্যাটেলাইটের ছবি থেকে সার্বিক পরিস্থিতির নিয়ে আক্ষরিক অর্থেই ‘অতুলনীয়’ ধারণা মিলছে। সংবাদের অন্যান্য যে কোনো মাধ্যমের সঙ্গে তুলনা করলে, হাজার মাইল দূরে বসেও সঠিক তথ্য পাচ্ছে মানুষ। এটিও স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবির প্রতি মানুষের এতো আগ্রহের কারণ হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
তবে, সামাজিক মাধ্যমে এই ছবিগুলো ছড়িয়ে দেওয়ার নেতিবাচক দিকের আশঙ্কাও করছেন তিনি। সামরিক বাহিনীগুলোর নিজস্ব গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক এবং তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উপায় থাকলেও, মূল যুদ্ধক্ষেত্রে সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত ছবিগুলোর প্রভাব কী ভাবে পড়বে সেটি আগেভাগেই বোঝার কোনো উপায় নেই।
“জীবন-মৃত্যু নিয়ে বাস্তবিক টানাপোড়েন” শুরু হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন ড. কোনায়েভ। একই বিষয়ে ভেবেছেন কাইল গ্লেনও। কিন্তু দিন শেষে তিনি যে ছবিগুলো সামাজিক মাধ্যমে দিচ্ছেন তার কারণে সম্মুখসমরে কারও প্রাণহানী হচ্ছে কি না, সেটা জানার কোনো উপায় নেই তার কাছে।
“আমি বলবো না যে এতে আমি দ্বিধান্বিত হই। তবে, এই আশঙ্কার ব্যাপারে আমার জানা আছে, এবং বিষয়টি আমি মেনে নিয়েছি,” বলেন গ্লেন।