পুতিনের বিরুদ্ধে কীভাবে কী করছে অ্যানোনিমাস?

ইউক্রেইনে সামরিক আগ্রাসর শুরু হওয়ার পরপরই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে ‘সাইবার যুদ্ধ’ ঘোষণা করেছিল অ্যানোনিমাস। রাশিয়ার বিভিন্ন সরকারি সংস্থার উপর সাইবার হামলা চালিয়েছে আলোচিত ও বিতর্কিত হ্যাকারদের দলটি। এবার তাদের কেউ কেউ মুখ খুলেছেন মিডিয়ার কাছে, বলেছেন কর্মপদ্ধতি আর পরিকল্পনার কথা।

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 March 2022, 09:17 AM
Updated : 21 March 2022, 09:30 AM

এরই মধ্যে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ব টিভি চ্যানেল হ্যাক করে সাড়া ফেলেছে তারা।

হ্যাকিংয়ের ঘটনার ছোট একটি ভিডিওর কথা জানিয়েছে বার্তাসংস্থা বিবিসি। টিভি চ্যানেলের প্রতিদিনের নিয়মিত অনুষ্ঠান থামিয়ে তার মধ্যে ইউক্রেইনে বোমা হামলার ছবি আর যুদ্ধের ভয়াবহতা নিয়ে সৈনিকদের বক্তব্য প্রচার করেছে অ্যানোনিমাসের হ্যাকাররা।

ভিডিওটি অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে ২৬ ফেব্রুয়ারি। অ্যানোনিমাস নিজস্ব সামাজিক মাধ্যম অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে কয়েক কোটি ফলোয়ারের সঙ্গে শেয়ার করে ভিডিওটি। এর একটি পোস্টে হ্যাকারদের দলটি বলেছে, “সদ্য পাওয়া খবর, ইউক্রেইনে কী হচ্ছে সেই সত্য প্রচারের জন্য অ্যানোনিমাস রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ব টিভি চ্যানেল হ্যাক করেছে।”

এখন পর্যন্ত লাখো মানুষ দেখেছেন ভিডিওটি।

পুরো ঘটনায় অ্যানোনিমাসের সংশ্লিষ্টতার ছাপটাও ছিল স্পষ্ট– মন্তব্য বিবিসির। পুরো ঘটনায় ছিল নাটকীয়তা, দর্শক বা সংশ্লিষ্টদের মনে দাগ কাটার মতো এবং সহজে অনলাইনে শেয়ার করার মতো। আর অ্যানোনিমাসের আগের হ্যাকিংয়ের মতো এই ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করাও ছিল নেহায়েতই কঠিন কাজ।

তবে, অ্যানোনিমাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হ্যাকারদের ছোট একটি দল দাবি করেছে, হ্যাকিংয়ের জন্য তারাই দায়ী এবং রাশিয়ার টেলিভিশন চ্যানেলের প্রচার ১২ মিনিটের জন্য তাদের হাতেই ছিল।

হ্যাকিংয়ের ঘটনার সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়েছে রাশিয়ার বংশদ্ভুত যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এক নারীর কারণে। এলিজা যুক্তরাষ্ট্রে থাকলেও তার বাবা থাকেন রাশিয়ায়, হঠাৎ টিভি অনুষ্ঠান থমকে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েকে কল করেন তিনি। “যখন এটা ঘটে, আমার বাবা আমাকে কল দিয়ে বললেন, ‘হে ঈশ্বর, ওরা সত্যিটা দেখাচ্ছে।’ তখন আমি তাকে ভিডিও রেকর্ড করতে বলি এবং পরে ভিডিওটি অনলাইনে পোস্ট করি। তার এক বন্ধুও নাকি বিষয়টা দেখেছেন।”

অ্যানোনিমাসের হ্যাকিংয়ের শিকার সেবাগুলোর পরিচালনা করে রাশিয়ার প্রতিষ্ঠান রসটেলিকম। তাৎক্ষণিকভাবে হ্যাকিং প্রসঙ্গে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি প্রতিষ্ঠানটি। 

আর হ্যাকাররা বলছেন, “গণহত্যার শিকার হচ্ছেন নিষ্পাপ ইউক্রেইনিয়ানরা। ইউক্রেইনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে কিছু করা না হলে আমরা ক্রেমলিনের ওপর হামলার তীব্রতা বাড়িয়ে যাবো।”

পাশাপাশি, রাশিয়ান ওয়েবসাইটে হ্যাকিং চালানো এবং সরকারি গোপন নথি চুরির দাবিও করেছে হ্যাকাররা। তবে, সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ‘রেড গোট’-এর অংশীদার লিসা ফোর্টের বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, বেশিরভাগ সাইবার হামলাই ছিল “সাধারণ মানের”।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হ্যাকাররা ডিডিওএস হামলা চালিয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। এ ক্ষেত্রে, ওয়েবসাইট বা অনলাইন সেবায় মাত্রাতিরিক্ত ডেটা রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে সার্ভার অকার্যকর করে ফেলে হ্যাকাররা। এ ধরনের হামলার ঘটনা আহামরি কিছু নয়, এবং ওয়েবসাইট সাময়িকভাবে অনলাইন হওয়া যারা বড় কোনো ক্ষতি হয় না।

কিন্তু সাইবার হামলা চালিয়ে টিভি চ্যানেল দখল করা “অবিশ্বাস্যভাবে সৃজনশীল এবং আমার মনে হয়, বেশ কঠিন কাজ,” বলে মন্তব্য করেছেন ফোর্টে।

অ্যানোনিমাস আসলে কী:

  • হ্যাকারদের সংগঠনটির উৎপত্তি ২০০৩ সালে, ফোরচ্যান ওয়েবসাইট থেকে।
  • সংগঠনটির কোনো নেতৃত্ব নেই, তাদের ট্যাগলাইন, “উই আর লিজিওন।”
  • যে কেউ নিজেকে হ্যাকারদের দলটির সদস্য দাবি করতে পারে এবং যে কোনো কারণে হ্যাকিং চালাতে পারে। তবে সাধারণত ক্ষমতার অপব্যবহারে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের উপরই সাইবার হামলা চালানোর ঘটনা বেশি।
  • সংগঠনটির মুখোশ গাই ফক্সের মুখোশ। অ্যালান মুরের গ্রাফিক নভেল ‘ভি ফর ভেনডেটা’র মাধ্যমে মূল ধারায় পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা পেয়েছিল মুখোশটি।
  • সামাজিক মাধ্যমগুলোতে হ্যাকারদের সংগঠনটির অনেকগুলো অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এর মধ্যে টুইটার অ্যাকাউন্টের ফলোয়ারের সংখ্যাই দেড় কোটির বেশি।

হ্যাকিংয়ের পর রাশিয়ার ওয়েবসাইটের চেহারাও পাল্টে দিয়েছে অ্যানোনিমাসের হ্যাকাররা, পোস্ট করে দিয়েছিল নিজেদের বক্তব্য। এই হামলাগুলোতে বড় কোনো ক্ষতি না হলেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে রাশিয়ার ইন্টারনেট সেবায়; বিড়ম্বনার মুখে পড়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। তবে, ইউক্রেইনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে কথিত ‘হ্যাকটিভিজম’ বাড়তে থাকায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, হাসপাতালের কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা জরুরী সেবাদাতাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে হ্যাকারদের ভুলে। 

এ প্রসঙ্গে সাইবার পলিসিস জার্নালের এমিলি টেইলর বলেন, “আমি এমন কিছু আগে কখনো দেখিনি। এই হামলাগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ দিকও আছে। এতে পুরো পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে, যা অসামরিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যবস্থায় ক্ষতির কারণ হতে পারে।”

অ্যানোনিমাস দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ক্রিয় ছিল বলে জানিয়েছে বিবিসি। রাশিয়ার আক্রমণ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত অ্যানোনিমাসের সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না ইউক্রেইনের স্থানীয় হ্যাকারদের দল ‘স্ট্যান্ড ফর ইউক্রেইন’-এর দলনেতা রোমানের।

রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ব সংবাদসংস্থা তাসের ওয়েবসাইট হ্যাক করেছিলেন রোমান ও তার দল। সাইটটি হ্যাক করে পুতিন বিরোধী বক্তব্য পোস্ট করে দিয়েছিলেন তাতে, সঙ্গে ছিল অ্যানোনিমাসের লোগো।

হ্যাকিং বাদে, পেশাগত জীবনে একজন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ছিলেন রোমান। কিইভে অবস্থিত নিজের ফ্ল্যাটে বসে এখন ওয়েবসাইট, অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ, আর ট্রেলিগ্রাম বট বানিয়ে ইউক্রেইনকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করছেন তিনি ও তার কর্মীরা। পাশাপাশি চলছে রাশিয়ার উপর সাইবার হামলা।

“ইউক্রেইনের জন্য অস্ত্র তুলে নিতে আমি প্রস্তুত। কিন্তু এ মুহুর্তে কম্পিউটারেই আমার দক্ষতার সবচেয়ে ভালো ব্যবহার হচ্ছে। তাই আমি দুটো ল্যাপটপ নিয়ে আমার ঘরে বসে আইটি প্রতিরোধের সমন্বয় করছি।”

রোমানের ‘স্ট্যান্ড ফর ইউক্রেইন’ ছাড়াও অ্যানোনিমাসের সঙ্গে সমন্বিত হয়েছে পোলিশ হ্যাকারদের দল ‘স্কোয়াড ৩০৩’।  হ্যাকারদের এই দলটির এক সদস্য বলেন, “আমরা প্রায়শই অ্যানোনিমাসের সঙ্গে কাজ করি এবং এখন আমি নিজেকে অ্যানোনিমাস আন্দোলনের সদস্য মনে করি।”

নিজের পরিচয় গোপন রেখেছেন স্কোয়াড ৩০৩-এর ওই সদস্য। তবে, বিবিসিকে নিজের হেলমেট ও মাস্ক পরিহিত ছবি পাঠিয়ে হ্যাকারদের দলটির আরেক সদস্য জানিয়েছেন, “দিন পার হয় রাইফেল হাতে ব্যারিকেড পাহারা দিয়ে, আর রাতে স্কোয়াড/অ্যানোনিমাসের সঙ্গে হ্যাকিং চালাই। ”

রাশিয়ার ফোন নম্বরে টেক্সট মেসেজ পাঠানোর জন্য একটি ওয়েবসাইট বানিয়েছে স্কোয়াড ৩০৩। যে কেউ ওই ওয়েবসাইট থেকে রাশিয়ার নম্বরে যুদ্ধের সত্যতা জানিয়ে টেক্সট মেসেজ পাঠাতে পারবেন। হ্যাকারদের দলটির দাবি, অন্তত দুই কোটি এসএমএস এবং হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ পাঠানোর পথ করে দিয়েছে তারা।

একে এখন পর্যন্ত রাশিয়ায় হ্যাকারদের সবচেয়ে সফল কাজগুলোর একটি হিসেবে আখ্যা দিয়েছে অ্যানোনিমাসের দুটি দল। হ্যাকিংয়ের কাজগুলো কতোটা ন্যায়সঙ্গত, এমন প্রশ্নের উত্তরে স্কোয়াড ৩০৩-এর সদস্য জানিয়েছেন, তারা ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করেন না বা শেয়ার করেন না এবং কেবল রাশিয়ানদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন তারা; মূল উদ্দেশ্য তথ্য যুদ্ধ জেতা।

সামনের দিনগুলোতে আরও শক্তিশালী সাইবার হামলা চালানোর পরিকল্পনা চলছে বলে জানিয়েছে হ্যাকাররা। রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ হ্যাকাররাও ইউক্রেইনের উপর সাইবার হামলা চালাচ্ছে। তবে, বিবিসি বলছে, তুলনামূলক ছোট পরিসরে ঘটছে হামলাগুলো।

জানুয়ারি মাস থেকে তিনটি বড় ডিডিওএস হামলার শিকার হয়েছে ইউক্রেইন। এ ছাড়াও ইউক্রেইনের অল্প সংখ্যক কম্পিউটার সিস্টেম থেকে ‘ওয়াইপার’ ম্যালওয়্যার ব্যবহার করে ডেটা মুছে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে অন্তত তিনবার।

সম্প্রতি, ‘ইউক্রেইন ২৪ টিভি’ হ্যাক করে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির একটি ‘ডিপফেইক’ ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল অনলাইনে। ভিডিওটি ইতোমধ্যেই মুছে দিয়েছে ফেইসবুক ও ইউটিউব।

তবে, বর্তমান পরিস্থিতি এতটাই ঘোলাটে যে কে কোন হামলার হোতা, সেটি নির্ধারণ বেশ কঠিন বলে মন্তব্য করেছে বিবিসি।

এ প্রসঙ্গে অ্যানোনিমাসের পুরনো সদস্য হিসেবে পরিচিত ‘অ্যানোন২ওয়ার্ল্ড’ বলেন, “অ্যানোনিমাসের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে যে কেউ নিজেকে অ্যানোনিমাসের সদস্য হিসেবে দাবি করতে পারে। এর মধ্যে সরকারী লোকজনও আছে যারা আমরা যে কারণে জন্য লড়াই করছি তার ঠিক বিপরীতে অবস্থানে আছেন।”

“বর্তমানে আমাদের জনপ্রিয়তা যতোটা বেড়েছে, তাতে সরকারি সংস্থাগুলোর কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া অবশ্যম্ভাবী। আর বিশৃঙ্খল অবস্থা নিয়ে বলতে গেলে, আমরা এটার সঙ্গে অভ্যস্ত, বিশেষ করে অনলাইনে।”