সৃষ্টি ইতিহাসের খোঁজে রওনা হলো টেলিস্কোপ ‘জেমস ওয়েব’

মহাকাশের পথে যাত্রা করেছে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় স্পেস টেলিস্কোপ। এক হাজার কোটি ডলার খরচ করে নির্মিত ‘জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (জেডব্লিউএসটি)’-কে বিবেচনা করা হচ্ছে একুশ শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রতিশ্রুতিশীল বৈজ্ঞানিক প্রকল্পগুলোর একটি হিসেবে।

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Dec 2021, 01:40 PM
Updated : 26 Dec 2021, 07:15 AM

ফ্রেঞ্চ গায়ানাতে অবস্থিত ‘ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ)’র লঞ্চপ্যাড থেকে জেডব্লিউএসটি যাত্রা শুরু করেছে শনিবার বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে। প্রকল্পের নকশা থেকে শুরু করে মহাকাশ যাত্রার মাঝে পার হয়েছে ৩০ বছর; শেষ অবধি খরচ গিয়ে পৌঁছেছে প্রাথমিক বাজেটের প্রায় ১০ গুণে। 

এতো সময় আর অর্থ খরচ করে নির্মিত জেডব্লিউএসটি’র মূল লক্ষ্য– মহাবিশ্বের প্রথম নক্ষত্রপুঞ্জ আর ছায়াপথের খোঁজ বের করা। পাশাপাশি অনেক দূরের গ্রহের বায়ুমণ্ডলে প্রাণধারণের উপযোগী গ্যাসের উপস্থিতির খোঁজ করবে টেলিস্কোপটি।

জেডব্লিউএসটি নিয়ে প্রত্যাশা যেমন বেশি, তেমনি ছিল অনিশ্চয়তাও। মহাকাশে পৌঁছাতে টানা ২৭ মিনিট সময় নিয়েছে জেডব্লিউএসটি বহনকারী আরিয়ান ৫ রকেট। কিন্তু মহাকাশের যাওয়ার এই প্রক্রিয়ার আক্ষরিক বিবরণ দিলে তাকে বলতে হবে ‘নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ’; হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই পুরো উৎক্ষেপণ প্রক্রিয়ার সবচেয়ে ছোট বিষয়টিও।

আরিয়ান ৫ রকেটের খোলসে গোটানো অবস্থায় গিয়েছে জেডব্লিউএসটি। মহাকাশে পৌঁছে আরিয়ান ৫ থেকে আলাদা হওয়ার পরেই কাজ শেষ হয়ে যায়নি টেলস্কোপটির, বরং তারপরেই শুরু হবে পুরো মিশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল অংশ। গোটানো অবস্থা থেকে ধিরে ধিরে নিজেকে মেলে ধরেছে জেডব্লিউএসটি, আর এই মেলে ধরার পদক্ষেপগুলো এতোটাই জটিল আর গুরুত্বপূর্ণ যে হিসেবে বিন্দুমাত্র গোলমাল থেকে ভেস্তে যেতে পারে পুরো মিশন।

নাসা ব্যবস্থাপক বিল নেলসনের ভাষায় “ওয়েব একটা বিস্ময়কর মিশন।”

“আমরা বড় স্বপ্ন দেখলে সেখান থেকে কতোটা অর্জন করতে পারি তার জ্বলজ্বলে উদাহরণ এটি। আমরা সবসময়ই জানতাম যে প্রকল্পটি ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু বড় কিছু পেতে হলে তো বড় ঝুঁকি নিতেই হবে।”

জেডব্লিউএসটি’র নামকরণ করা হয়েছে ‘অ্যাপোলো মুন প্রোগ্রাম’-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গবেষক ‘জেমস ওয়েব’-এর নাম থেকে। টেলিস্কোপটির নকশা, নির্মাণ আর উৎক্ষেপণের বিভিন্ন ধাপে জোট বেঁধেছে নাসা, ইএসএ এবং সিএসএ। আর প্রকল্পের অংশীদার সবার চোখেই একুশ শতকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জগতের ‘ফ্ল্যাগশিপ’ জেডব্লিউএসটি।

জেডব্লিউএসটি-কে বিবেচনা করা হচ্ছে নাসার হাবল টেলিস্কোপের উত্তরসূরী হিসেবে। কক্ষপথে ৩১ বছর কাটানোর পর জীবন সীমার শেষ প্রান্তে চলে এসেছে হাবল। আর হাবলের আবিষ্কারগুলোর উপরই আরও গবেষণা চালাবে জেডব্লিউএসটি।

জেডব্লিইউএসটি’র পুরো সিস্টেমের কেন্দ্রে রয়েছে সোনার প্রলেপ দেওয়া ৬.৫ মিটার প্রস্থের একটি আয়না।  ওই আয়নাতে সৃষ্টির শুরুর দিককার নক্ষত্রগুলোর আলো প্রতিফলিত হবে এবং জেডব্লিইউএসটি’র ‘সুপার-সেনসিটিভ’ সেন্সরগুলো সেই আলোর কণাগুলো চিহ্নিত করতে পারবে– এমনটাই আশা করছেন মহাকাশ বিজ্ঞানীরা।

এই প্রসঙ্গে বিবিসিকে নাসার নোবেল জয়ী জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী জন ম্যাথার বলেন, “সেগুলো ছোট্ট লাল কণার মতো হয়ে থাকবে। আমাদের ধারণা এমন নক্ষত্রপুঞ্জ বা ছায়াপথ এবং ব্ল্যাক হোল আছে যার সৃষ্টি হয়েছিল বিগ ব্যাংয়ের ১০ কোটি বছর পর। খুঁজে পাওয়ার মতো তাদের অনেকে হয়তো এখন আর নেই, কিন্তু তারা যদি এখনও বিদ্যমান থাকে এবং আমাদের ভাগ্য ভালো হলে জেমস ওয়েব ওদের দেখতে পাবে।”

বিজ্ঞানীরা সৃষ্টির শুরুর নক্ষত্রগুলোর খোঁজ করছেন কেবল বৈজ্ঞানিক কৌতুহল মেটানোর জন্য নয়। পুরো মহাকাশে ‘হেভি কেমিকেল এলিমেন্টস’ এর বীজবপন শুরু করেছিল ওই নক্ষত্রগুলোই। মানব দেহের হাড়ে থাকা ক্যালশিয়াম, ডিএনএ-তে থাকা ফসফরাস আর রক্তে দ্রবীভূত লোহা– এই পরমাণু কণাগুলোর ‘সৃষ্টি’ হয়েছে পারমাণবিক বিক্রিয়া থেকে; ওই একই রাসায়ণিক বিক্রিয়ার ফলে জ্বলজ্বলে আলো ছড়ায় মহাকাশের নক্ষত্রগুলো, জীবন সীমার শেষে নক্ষত্রগুলো বিস্ফোরিত হওয়ার সময়ে আরও জোরালো হয় ওই বিক্রিয়া। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিলে জেডব্লিউএসটি মহাবিশ্বের সৃষ্টির ঘটনাগুলোর সাক্ষী হতে যাচ্ছে– এমনটা বলা যেতেই পারে।

“জোতির্বিদ্যার যে বিষয়টি আমার খুব ভালো লাগে সেটি হলো এটি সরাসরি আমাদের বড় প্রশ্নগুলোর কাছে নিয়ে যায়: আমরা কোথা থেকে এলাম? কীভাবে এলাম? আমরা কী একা? এই প্রশ্নগুলো শুধু প্রাচীন বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন নয়; মানব সত্ত্বার অস্তিত্ত্বের গভীর প্রশ্ন এগুলো।”-- বলেছেন নাসার সহকারী প্রকল্প গবেষক ডক্টর অ্যাম্বার স্ট্রন।