‘ভাড়াটে গুপ্তচর সংস্থার’ মুখোশ উন্মোচন, ভুক্তভোগী ৫০ হাজার

হ্যাকিংসহ বিভিন্ন অনলাইন নজরদারির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আধ ডজন ব্যক্তিমালিকাধীন নজরদারি প্রতিষ্ঠানের পরিচয় প্রকাশ করেছে শীর্ষ সামাজিক মাধ্যম ফেইসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা প্ল্যাটফর্মস ইনকর্পোরেটেড। প্রতিষ্ঠানগুলোর অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভুক্তভোগী হয়েছেন বিভিন্ন দেশের অন্তত ৫০ হাজার ব্যবহারকারী।

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Dec 2021, 05:56 AM
Updated : 17 Dec 2021, 05:57 AM

বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম প্রকাশ করেছে মেটা। সম্প্রতি ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপের মতো ‘ডিজিটাল গোয়েন্দা সংস্থা’গুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে মার্কিন প্রশাসন ও দেশটির আইন প্রণেতারা। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোও তৎপর হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে বলেছে রয়টার্স।

ইতোমধ্যেই মার্কিন আদালতে এনএসও গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলা করার পদক্ষেপ নিয়েছে ফেইসবুক। মেটা’র নিরাপত্তা নীতিমালা প্রধান নাথানিয়েল গ্লেইশার বলছেন, বৃহস্পতিবার প্রকাশিত প্রতিবেদনের মূল লক্ষ্য ছিল যে “ভাড়াটে গোয়েন্দা শিল্প কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়” তার আভাস দেওয়া।

মেটা বলছে, ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম  ও হোয়াটসঅ্যাপ থেকে প্রায় দেড় হাজার অ্যাকাউন্ট মুছে দিচ্ছে তারা। অ্যাকাউন্টগুলোর একটা বড় অংশই ভুয়া এবং সাতটি ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠান সেগুলো পরিচালনা করছিল। পৃথিবীর একশ’র বেশি দেশের ব্যবহারকারী ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর নজরদারির শিকার হয়েছে বলে জানিয়েছে মেটা।

ওই প্রতিষ্ঠানগুলোকে কী ভাবে চিহ্নিত করা হল, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানায়নি মেটা। তবে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্মগুলোর একটি হিসেবে প্রায়শই অপরাধী বা নেতিবাচক ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার সক্ষমতা নিয়ে বড়াই করে মেটা এবং ফেইসবুক।

মেটা’র প্রতিবেদনে যে প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম উঠে এসেছে তার মধ্যে আছে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাক কিউব। রয়টার্স জানিয়েছে, হলিউডি প্রযোজক এবং যৌন নিপীড়ণের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত হার্ভি ওয়াইনস্টিনের হয়ে গুপ্তচর নিয়োগ দিতো প্রতিষ্ঠানটি। মেটা বলছে, ব্ল্যাক কিউব অনলাইনে ভুয়া অ্যাকাউন্ট বানিয়ে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে “সম্ভবত” ফিশিং আক্রমণের জন্য তাদের ইমেইল আইডি সংগ্রহের চেষ্টা করতো।

তবে এক বিবৃতিতে ব্ল্যাক কিউব বলছে, “ফিশিং বা হ্যাকিংয়ের মতো কোনো কাজ” হাতে নেয় না তারা। নিজস্ব ‘এজেন্টদের’ কর্মকাণ্ড যেন স্থানীয় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে সেদিকেও নিয়মিত নজর রাখার দাবি করেছে প্রতিষ্ঠানটি।  

মেটা’র প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরও যে প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম উঠে এসেছে তার মধ্যে আছে, ভারতের প্রতিষ্ঠান ‘বেলট্রক্স’; প্রতিষ্ঠানটির সাইবার এসপিওনাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ২০২০ সালেই উন্মোচিত হয়েছিল রয়টার্স এবং ইন্টারনেট পর্যবেক্ষক সিটিজেন ল্যাবের যৌথ উদ্যোগে। তালিকায় আরও আছে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠান ব্লুহক সিআই এবং ইউরোপের প্রতিষ্ঠান ‘সাইট্রক্স’। সবগুলো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই হ্যাকিংয়ের অভিযোগ তুলেছে মেটা।

আর ব্যবহারকারীদের বোকা বানিয়ে ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে কগনাইট, ভেরিন্ট সিস্টেমস এবং ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠান ‘কবওয়েবস টেকনোলজিস’-এর উপর। রয়টার্সকে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি কগনাইট, ভেরিন্ট এবং ব্লুহক।

তবে কবওয়েবস মুখপাত্র মেইতাল লেভি তাল দাবি করেছেন তার প্রতিষ্ঠান কেবল ওপেন সোর্স থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে এবং তাদের পণ্যগুলো “কোনো ভাবেই অনুপ্রবেশে ব্যবহারের উপযোগী নয়।”

রয়টার্স যোগাযোগের চেষ্টা অব্যাহত রাখলেও কোনো উত্তর দেননি বেলট্রক্স এবং সাইট্রক্সের শীর্ষ কর্মকর্তারা। 

প্রতিষ্ঠানগুলোর নজরদারির শিকার কোনো ব্যবহারকারীর নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি গ্লেইশার। তবে ওই একই সময়ে সিটিজেন ল্যাব থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সাইট্রক্সের ভুক্তভোগীদের তালিকায় ছিলেন মিসরের বিরোধী দলীয় নেতা আয়মান নূর।

নজরদারির জন্য মিসর সরকারকেই দুষছেন নূর। অনেক দিন ধরেই নজরদারির আশঙ্কা করছিলেন বলে ইস্তানবুল থেকে রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন তিনি।

“প্রথমবারের মতো আমার হাতে প্রমাণ আছে।”

এ প্রসঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে রয়টার্সকে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি মিসর সরকার। 

গ্লেইশারের দাওয়া তথ্য অনুযায়ী, নজরদারির ভুক্তভোগীদের মধ্যে ছিলেন তারকা ব্যক্তিত্ত্ব, রাজনীতিবিদ, সংবাদকর্মী, আইনজীবী, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা এবং সাধারণ ব্যবহারকারীরাও। নজরদারির শিকার হয়েছেন ভুক্তভোগীদের পরিবার ও কাছের বন্ধুরাও।

বৃহস্পতিবারের প্রকাশনার মাধ্যমে অনলাইনের “ভাড়াটে গোয়েন্দা ব্যবসা” শিল্পের ভাঙ্গন শুরু হবে বলে মন্তব্য করেছেন মেটা’র সাইবার নিরাপত্তা কর্মকর্তা ডেভিড আগ্রানোভিচ। 

অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমগুলোর দিক থেকেও একই ধরনের পদক্ষেপ আসার ইঙ্গিত মিলছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স। মেটা’র ঘোষণার কয়েক ঘন্টার মাথায় তিনশ’ অ্যাকাউন্ট মুছে দিয়েছে টুইটার। 

বার্তাসংস্থাটি আরও জানিয়েছে, সামাজিক মাধ্যমগুলোর তৎপরতা প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর দীর্ঘস্থায়ী কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে কী না, তা এখনও পরিষ্কার নয়। এর আগেও হ্যাকিং ও সাইবার নজরদারির অভিযোগ উঠেছিল বেলট্রক্স এবং ব্ল্যাক কিউবের বিরুদ্ধে। সমালোচনা-বিতর্ক কাটিয়ে আবারও আগের কর্মকাণ্ডে ফিরে গেছে প্রতিষ্ঠান দুটি।