কে এই পারাগ আগরাওয়াল, কী আছে টুইটারের সামনে?

টুইটারের হাল ধরেছেন নতুন কাণ্ডারী; ১৫ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের প্রধান নির্বাহী জ্যাক ডরসি পদ ছাড়ার ঘোষণা দেওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই পাল্টে গেছে টুইটারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের তালিকায় প্রধান নির্বাহীর নাম। লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে রাতারাতি আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছেন পারাগ আগরাওয়াল।

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Nov 2021, 09:27 AM
Updated : 30 Nov 2021, 09:27 AM

টুইটারের ভেতরে-বাইরে খুব একটা পরিচিত নাম নয় আগরাওয়াল। তবে, প্রায় এক দশক ধরে টুইটারের সঙ্গে আছেন তিনি। ২০১১ সালের অক্টোবরে শুরুটা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে নিজের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিলেন আগরাওয়াল; পরিচিতি আছে ডরসি’র সবচেয়ে কাছের মানুষদের একজন হিসেবেও।

শুরুতে টুইটারের বিজ্ঞাপনকেন্দ্রিক পণ্য নিয়ে কাজ করলেও প্রতিষ্ঠানের প্রথম ‘সেলিব্রেটি ইঞ্জিনিয়ারে’র পরিচয় ঠিকই বাগিয়ে নিয়েছিলেন আগরাওয়াল। ২০১৭ সালে দায়িত্ব নেন প্রতিষ্ঠানের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা হিসেবে। এর পরপরই বড় পরিসরে পাসওয়ার্ড নিরাপত্তা জটিলতা নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি, বিকেন্দ্রিকরণের মতো টুইটারের ‘উচ্চাভিলাসী’ উদ্যোগের গুরুভারও বর্তায় তার ঘাড়েই।

বিভিন্ন সময়ে টুইটারে নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকলেও বরাবরই লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে গেছেন ৩৭ বছর বয়সী এই ‘অখ্যাত সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার’।

প্রযুক্তি খাতে এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে আগরাওয়ালের নেতৃত্বে টুইটারের ভবিষ্যত কেমন হবে। আগরাওয়ালকে নিয়ে গণমাধ্যমের কাছে তথ্যের ঘাটতি থাকতে পারে, তবে প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা হিসেবে আগরাওয়ালের দায়িত্ব পালনের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে তার ভবিষ্যত নেতৃত্ব নিয়ে কিছুটা হয়তো অনুমান করা সম্ভব।

টুইটারের কাণ্ডারী হিসেবে দায়িত্ব পাওয়া চতুর্থ ব্যক্তি আগরাওয়াল। জ্যাক ডরসি প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করেছেন দুই মেয়াদে, প্রথমবার ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত আর দ্বিতীয়বার ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত। ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রধান নির্বাহী ছিলেন টুইটার সহ-প্রতিষ্ঠাতা ইভান উইলিয়ামস। আর মাঝে ২০১০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত প্রধান নির্বাহী ছিলেন ডিক কস্টোলো।

প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা বা সিটিও হিসেবে আগরাওয়ালের অধীনে থাকা সবচেয়ে বড় প্রকল্প ছিল টুইটারের বিকেন্দ্রিক প্ল্যাটফর্ম ‘ব্লুস্কাই’। ‘সামাজিক মাধ্যমের উন্মুক্ত ও বিকেন্দ্রিক’ মান হিসেবে প্ল্যাটফর্মটিকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে টুইটার। প্রযুক্তিবিষয়ক সাইট ভার্জ বলছে, ব্লুস্কাই ডরসি’র ব্যক্তিগত প্রকল্প হলেও টুইটার একসময় ওই প্ল্যাটফর্মটিতে সরে আসবে-- এমন সম্ভাবনা নিয়ে বিবেচনা করছেন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।

বেশ কিছুদিন ব্লুস্কাই নিয়ে কোনো কিছু শোনা না গেলেও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে লক্ষণীয় তৎপরতা চোখে পড়েছে প্ল্যাটফর্মটি নিয়ে। সম্প্রতি বিকেন্দ্রিক সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মটির অগ্রগতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। বলা হচ্ছে, ব্লুস্কাইয়ের সম্ভাব্য প্রভাব এবং টুইটারকে বর্তমান প্ল্যাটফর্ম থেকে সরিয়ে ব্লুস্কাই প্ল্যাটফর্মে নেওয়ার পরিকল্পনার অগ্রগতিই হবে প্রধান নির্বাহী হিসেবে আগরাওয়ালের অধীনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। 

নতুন ক্রিপ্টোকারেন্সি বিভাগ গঠন করেছে টুইটার। টেস রিনিয়ারসনের নেতৃত্বাধীন ক্রিপ্টো বিভাগটি সরাসরি আগরাওয়ালের অধীনেই কাজ করেছে এতোদিন। আগরাওয়ালের পদোন্নতির পর সেই পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকবে কি না, সে বিষয়টি এখনও পরিষ্কার নয়। তবে ব্লুস্কাই-এর কাছাকাছি থেকেই কাজ করার কথা রয়েছে ক্রিপ্টোকারেন্সি বিভাগের। অন্যদিকে বিকেন্দ্রিক ওয়েব৩ প্ল্যাটফর্ম নিয়েও আগ্রহের কমতি নেই আগরাওয়ালের। এই সব মিলিয়ে টুইটারের ভবিষ্যত কোন পথে-- তার কিছুটা ধারণা হলেও মিলছে বলে মন্তব্য করেছে ভার্জ।

টুইটারের সিটিও হিসেবে বেশ কিছু দিন ধরেই টুইটারের কিছু পণ্য নিজস্ব সার্ভার থেকে সরিয়ে অ্যামাজন বা গুগলের মতো অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের নির্ভারযোগ্য ক্লাউড সেবায় স্থানান্তরের চেষ্টা করছেন আগরাওয়াল। বড় অগ্রগতি আসতে পারে সেই প্রকল্পেও।

২০১৮ সাল থেকে টুইটারের নিজস্ব প্রযুক্তির অগ্রগতি ও উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন আগরাওয়াল। প্রতিষ্ঠানের জন্য নতুন প্রযুক্তি নির্মাণ ও বিতরণের গতি বাড়ানোই ছিল তার প্রধান লক্ষ্য। সে প্রসঙ্গে চলতি বছরে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আগরাওয়াল বলেছিলেন “আমরা যখন শুনি যে মানুষ বলছে টুইটার বাজারজাতকরণে ধীর গতির; তাতে কষ্ট পাই আমরা, এবং সেটাকে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজে লাগাই ।”

নির্ভরযোগ্য ক্লাউড সেবায় পণ্য স্থানান্তর লক্ষ্যে ২০১৮ সালে মে মাসে গুগল ক্লাউডের সঙ্গে জোট বাঁধে টুইটার। অন্যদিকে টু্ইটার টাইমলাইন ফিচার অ্যামাজান ওয়েব সেবায় সরিয়ে নেওয়ার প্রকল্প এখনও চলমান, ২০২৩ সাল নাগাদ শেষ হবে এই প্রকল্প। “আমার মনে হয় বাইরে থেকে মানুষ বুঝতে পারছে না যে আমরা কতো দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছি। কাজটা ভালোই লাগছে কারণ, মনে হচ্ছে যেন আগের কাজগুলো এখন ফল দিচ্ছে”-- বলেছেন আগরাওয়াল। “তবে শেষের ধারে কাছেও নেই আমরা। আমি মনে করি আগামী বছরগুলোতে আমাদের আরও দ্রুত এবং লক্ষ্যণীয়ভাবে এগোনোর সুযোগ আছে।”--যোগ করেন তিনি।

ভবিষ্যতমুখী কাজ বাদেও বিভিন্ন সময়ে হঠাৎ সৃষ্ট জটিলতা সমাধানেও কাজ করেছেন আগরাওয়াল। সিটিও হিসেবে গেল বছরেই ফটো প্রিভিউ ফিচার জাতিগত দৃষ্টিকোণ থেকে ছবি ক্রপ করার জটিলতা সমাধানে কাজ করেছেন তিনি। ২০১৮ সালের পাসওয়ার্ড বাগ জটিলতা নিয়ে সাধারণ ব্যবহারকারীদের ব্যাখ্যা দেওয়ার কাজটিও করেছিলেন আগরাওয়াল। 

টুইটারের জন্য সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে কন্টেন্টে মডারেশন বিতর্ক। এমআইটি টেকনোলজি রিভিউকে ২০২০ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আগরাওয়াল বলেছিলেন, টুইটারের মূল ভূমিকা হচ্ছে অনলাইনে আলাপচারিতার একটি ইতিবাচক প্ল্যাটফর্মের প্রতিষ্ঠা করা। “প্রথম সংশোধনীর মধ্যে আটকে থাকা আমাদের মূল উদ্দেশ্য নয়। আমাদের ভূমিকা হচ্ছে জনসাধারণকে সুস্থ্য বিতর্কের সুযোগ দেওয়া।”

তবে তার মানে এই নয় যে, সকল ভুয়া খবর ও মিথ্যাচার ‘মডারেশনের’ চেষ্টা করবে টুইটার। আগরাওয়ালের চোখে টুইটারের মূল লক্ষ্য হল “ভুয়া তথ্যের ক্ষতি এড়ানো, ইন্টারনেটে কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা সেটি নির্ধারণ নয়”।

“ভুয়া খবরের সঙ্গা নির্ধারণ খুবই কঠিন”-- মন্তব্য আগরাওয়ালের।

ভার্জ বলছে, এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান দলের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে রেষারেষির সূত্রপাত হতে পারে আগরাওয়ালের। দলটির অনেকে ইতোমধ্যেই টুইটারের নীতিমালার বিরোধী, বিশেষ করে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পকে নিষিদ্ধ করায় মাইক্রোব্লগিং সাইটটির উপর খেপেছিলেন অনেকেই। ইতোমধ্যেই আগরাওয়ালকে ডরসি’র চেয়ে ‘আরও খারাপ’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে ‘হাউজ জুডিশিয়ারি জিওপি’ টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে।

একদিকে টুইটারের দৈনিক ব্যবহারকারীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে দ্রুতগতিতে নতুন সেবা বাজারজাত করছে প্রতিষ্ঠানটি। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়াতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিকে। স্ন্যাপচ্যাটের মতো সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাঠফর্মগুলোও সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছে টুইটারের সঙ্গে। এমন পরিস্থিতিতেই প্রতিষ্ঠানটির হাল ধরছেন আগরাওয়াল।

অন্যান্য টু্ইটার কর্মকর্তাদের সঙ্গে তুলনা করলে জনসমক্ষে হয়তো খুব একটা পরিচিত নন আগরাওয়াল। তবে প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করার এক দশকের অভিজ্ঞতা রয়েছে ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের। টুইটারের পণ্য ও সেবাগুলো নিয়ে সরাসরি কাজ এবং টুইটারের মূল প্রযুক্তি আধুনিকায়নের অভিজ্ঞতার কারণে প্রতিষ্ঠানটির কাণ্ডারী হিসেবে আগরাওয়ালের নির্বাচনকে ঠিক ‘অপ্রত্যাশিত’ বলার সুযোগও নেই।

তরুণ বয়সে বোম্বে আইআইটি বা ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি বোম্বে’ থেকে কম্পেউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক পাশ করেন পারাগ আগরাওয়াল। এরপর কম্পিউটার সায়েন্স নিয়েই পিএইচডি ডিগ্রি পেয়েছেন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে।