শিশু নিপীড়ন কন্টেন্ট মোকাবেলায় ফেইসবুকের চেষ্টা ‘অপর্যাপ্ত’

নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম থেকে শিশু নিপিড়ন সংশ্লিষ্ট কন্টেন্ট মুছতে ফেইসবুকের চেষ্টা “যথেষ্ট নয়” এবং প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন পান না দায়িত্বপ্রাপ্তরা-- মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে এমন অভিযোগ করেছেন শীর্ষ সামাজিক মাধ্যমটির আরেক সাবেক কর্মী।

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Oct 2021, 11:38 AM
Updated : 28 Oct 2021, 02:30 PM

এখনও পরিচয় গোপন রেখেছেন ওই কর্মী, তার লিখিত বক্তব্য দেখার সুযোগ হয়েছে বিবিসি’র। বার্তাসংস্থাটি জানিয়েছে, আরও দুই সপ্তাহ আগেই যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)’র কাছে জমা পড়েছে ওই অভিযোগ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র। সাবেক ওই কর্মী আরও অভিযোগ করেছেন, ফেইসবুকের কন্টেন্ট মডারেশনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীরা “যথেষ্ট প্রশিক্ষিত নয় এবং তাদের প্রস্তুতিও দুর্বল।”

অন্যদিকে এক বিবৃতিতে ফেইসবুক বলেছে, শিশু নিপিড়নের মতো ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের প্রতি “কোনো সহনশীলতা নেই এবং এটি মোকাবেলয়া পরিশীলিত প্রযুক্তি” ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানটি। এই ভয়াবহ অপরাধ মোকাবেলা, শিশুদের উদ্ধার করে ভুক্তভোগীদের সুবিচার এনে দিতে শিল্প যে টুলগুলো ব্যবহার করে তার “অর্থায়ন ও নির্মাণ” ফেইসবুকই করেছে বলেও দাবি প্রতিষ্ঠানটির। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিপিড়ন বিরোধী প্রযুক্তি শেয়ার করার দাবিও করেছে ফেইসবুক।

চলতি মাসেই মার্কিন সিনেটের এক সাবকমিটির কাছে সাক্ষ্য দিয়েছেন ফেইসবুকের সাবেক কর্মী ফ্রান্সেস হাউগেন। ফেইসবুক “শিশুদের ক্ষতি করে, সামাজিক বিভক্তি বাড়ায় এবং আমাদের গণতন্ত্রের ক্ষতি করছে” বলে অভিযোগ করেন তিনি। ফেইসবুক ছাড়ার আগে প্রতিষ্ঠানটির বিপুল পরিমাণ অভ্যন্তরীণ নথিপত্র ও গবেষণা প্রতিবেদন সরিয়ে নিয়েছিলেন হাউগেন। তিনি মার্কিন দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে সরবরাহ করেছিলেন ওই নথিপত্র, যার ভিত্তিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সূত্র ধরে পুরো প্রযুক্তি জগতেই শুরু হয়েছে তোলপাড়। হাউগেনের দেখাদেখি ফেইসবুকের কর্মকাণ্ড নিয়ে একে একে মুখ খোলা শুরু করেছেন প্রতিষ্ঠানটির একাধিক সাবেক কর্মী।

২৫ অক্টোবর যুক্তরাজ্য পার্লামেন্টের একটি কমিটির কাছেও তথ্য উপাত্ত তুলে ধরেছেন হাউগেন। নতুন ‘অনলাইন সেইফটি বিল’-এর দায়িত্বে আছে ওই কমিটি। ফেইসবুক, টুইটার, গুগল, ইউটিউব ও টিকটকের মতো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও আলোচনায় বসবে ওই কমিটি।

সমাধান নেই!

ফেইসবুকের সাবেক ওই কর্মী এসইসি’র কাছে শপথ নিয়ে বলেছেন, ফেইসবুকের বেআইনি কন্টেন্ট সমস্যার কোনো সমাধান নেই কারণ “ওই সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় তহবিল সরবরাহ করা হয়নি”।

তিনি আরও অভিযোগ করেন, ফেইসবুক শিশু নিপিড়নের কন্টেন্ট চিহ্নিত করতে সক্ষম সফটওয়্যার নির্মাণের দায়িত্বে থাকা ছোট দলটি ভেঙে দিয়ে অন্য বিভাগে কাজে লাগিয়েছিল কারণ প্রতিষ্ঠানটিকে একে “বেশি জটিল” মনে করে।

ফেইসবুক বলছে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে শিশু নিপিড়নের ছবি চিহ্নিত করতে ‘ফটোডিনএ’ এবং ‘ভিডিওডিএনএ’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা। এই প্রযুক্তিতে ‘অ্যামেরিকান ন্যাশনাল সেন্টার ফর মিসিং অ্যান্ড এক্সপ্লয়টেড চিলড্রেন’র উদ্বারকৃত শিশু নিপিড়নের ছবিগুলো বিশেষ কোড দিয়ে চিহ্নিত করা থাকে আর ওই কোডের সঙ্গে তুলনা বিচারেই শিশু নিপিড়নের কন্টেন্ট চিহ্নিত করা হয়।

এসইসির কাছে জমা দেওয়া নথিপত্রে ওই সাবেক কর্মী আরও দুই গুরুতর অভিযোগ এনেছেন:

ফেইসবুক আসলে শিশু নিপিড়নের কন্টেন্টে বিস্তার সম্পর্কে জানেই না, কারণ তারা “এটা ট্র্যাক করে না।”

উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিত্য দিনের প্রশ্ন হল, “বিনিয়োগের বিপরীতে কী লাভ আসবে?”

ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে মুনাফার প্রশ্ন যথাযথ হলেও “শিশু নিপিড়নের মতো জননিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ক্ষেত্রে যথাযথ নয়” বলে মন্তব্য করেছেন ফেইসবুকের ওই সাবেক কর্মী।

বিবিসি বলছে, পাঁচ পৃষ্ঠার ওই আইনি নথিতে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে ফেইসবুক ‘গ্রুপ’ নিয়েও। গ্রুপগুলো “নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সুযোগ সৃষ্টি” করছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে নথিতে। ফেইসবুক গ্রুপগুলোতেই “অনেক ভয়াবহ ও ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড সংগঠিত হয়”-- বলা হয়েছে।

বেআইনি কর্মকাণ্ডে ফেইসবুকের মালিকানাধীন সেবাগুলোর ব্যবহার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, শিশু নিপিড়করা “শিশুদের বর্ণনা ও নিজেদের কর্মকাণ্ড ব্যাখ্যা করতে কোড ওয়ার্ড (সংকেত শব্দ) ব্যবহার করে, তারা ফেইসবুকের এনক্রিপ্টেড মেসেজিং সেবা অথবা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে কোড লেনদেন করে এবং সেগুলো নিয়মিত পরিবর্তনও করা হয়।”

তবে বিবিসির কাছে ফেইসবুক বলেছে, নীতিমালা ভঙ্গকারী কন্টেন্টের জন্য প্রাইভেট গ্রুপগুলো স্ক্যান করে তারা এবং নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে ৪০ হাজার কর্মী আছে তাদের। এই খাতে ২০১৬ সাল এক হাজার তিনশ’ কোটি মার্কিন ডলার খরচ করার দাবি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০২১ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে আড়াই কোটির বেশি শিশু নিপিড়নের কন্টেন্ট মুছে দেওয়ার কথাও বলেছে ফেইসবুক।

এই প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্যের ‘ন্যাশনাল সোসাইটি ফর প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েল্টি টু চিলড্রেন’-এর প্রধান নির্বাহী পিটার ওয়ানলেস বলেন “শিশু নিপিড়ন এবং নিজস্ব প্ল্যাটফর্মের অপব্যবহার বন্ধে ফেইসবুকের অঙ্গীকার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এই বিষয়গুলো প্রকাশ পাওয়ায়। প্রথমবারের মতো ফেইসবুকের ভেতর থেকে আসা প্রমাণ থেকে এমন ইঙ্গিত মিলছে যে শিশু নিপিড়নের কন্টেন্ট ব্যাপকভাবে মোকাবেলায় নিজেদের দায়িত্ব পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছে ফেইসবুক।”

অন্যদিকে, ফেইসবুকের ওই কর্মী তার বক্তব্যে শেষ কথা হিসেবে বলেছেন, “যতোক্ষণ পর্যন্ত আইনি পদক্ষেপের জোর ঝুঁকি সামনে না আসবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত পাল্টাবে না ফেইসবুক।”