সিনেটে হাউগেন, অভিযোগের আঙ্গুল  জাকারবার্গের দিকে

মার্কিন সিনেটে সাক্ষ্য দিয়েছেন ফেইসবুকের সাবেক ডেটা বিজ্ঞানী ফ্রান্সেস হাউগেন। শুনানিতে আলোচিত বেশিরভাগ বিষয় আগেই উঠে এসেছে মার্কিন দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন আর সিবিএসকে দেওয়া হাউগেনের সাক্ষাৎকারে। তবে, এর পাশাপাশি আরও কিছু তথ্য প্রকাশ করেছেন হাউগেন যা ফেইসবুক, বিশেষ করে এর শীর্ষ কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গের জন্য আদৌ সুখকর কিছু হওয়ার কথা নয়।

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Oct 2021, 08:44 PM
Updated : 5 Oct 2021, 08:44 PM

হাউগেনের বক্তব্য ও সিনেটরদের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্ব থেকে যে বিষয়গুলো বেরিয়ে এসেছে, তার মধ্যে রয়েছে- ফেইসবুকের ব্যবসা কাঠামো ও অ্যালগরিদমের প্রশ্নে হিসেবে মার্ক জাকারবার্গের একচ্ছত্র আধিপত্য, বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে ফেইসবুকের মিথ্যাচার, শিশুদের দেখানো বিজ্ঞাপনের প্রশ্নে ফেইসবুকের দাবি ও অ্যালগরিদমের কার্যপ্রণালীর অমিল, অ্যালগরিদমের দুর্বলতা,ভবিষ্যতে টিকে থাকতে ফেইসবুকের শিশুদের উপর নির্ভর করার চেষ্টা, এনগেজমেন্ট র‌্যাংকিং ব্যবস্থা এবং এর প্রমাণিত নেতিবাচক প্রভাব।

জাকারবার্গ কেন প্রমোদভ্রমণে!

গেল সপ্তাহেই মার্কিন সিনেটে সাক্ষ্য দিয়েছেন ফেইসবুকের নিরাপত্তা বিষয়ক বৈশ্বিক প্রধান অ্যান্টিগন ডেভিস। এরপর ৫ অক্টোবরের শুনানিতে ফ্রান্সেস হাউগেন যখন সাক্ষ্য দিচ্ছিলেন, ফেইসবুকের মূল কাণ্ডারী মার্ক জাকারবার্গ তখন ছিলেন কোনো এক পাল তোলা নৌকায় প্রমোদভ্রমণে। মূল দৃশ্যপটে জাকারবার্গের এই অনুপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অধিবেশনে উপস্থিত একাধিক সিনেটর।

“আজকে মার্ক জাকারবার্গের ‍উচিত আয়নায় নিজেকে দেখা। নেতৃত্ব না দেখিয়ে, দায়িত্ব নেওয়ার বদলে তিনি এখন প্রমোদতরীতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন”-- মন্তব্য করেন ডেমোক্রেট সিনেটর রিচার্ড ব্লুমেন্থাল।

এর পরপরই জাকারবার্গের প্রমোদভ্রমণের তুলনায় গুরুত্ব বেশি পেতে থাকে প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে তার ভূমিকা এবং অ্যালগরিদম ও অন্যান্য পণ্য নিয়ে প্রশ্নে তার একক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা।

জাকারবার্গই ফেইসবুকের সব সিদ্ধান্ত নেন কি না, সিনেটর ব্লুমেন্থালের এই প্রশ্নের জবাবে হাউগেন বলেন, ফেইসবুকের ৫৫ শতাংশ ভোটিং শেয়ার নিয়ে “পুরো প্রযুক্তি শিল্পের মধ্যে তুলনাহীন একটা জায়গা দখল করে আছেন” জাকারবার্গ।

“এমন ক্ষমতাধর আর কোনো প্রতিষ্ঠানে নেই যেটি এমন একতরফাভাবে পরিচালিত হয়। শেষ পর্যন্ত তার কাছে গিয়েই সব থেমে যায়। তিনি কারও কাছেই জবাবদিহিতার জন্য দায়বদ্ধ নন”-- বলেন হাউগেন।

প্রতিষ্ঠান হিসেবে ফেইসবুক সংখ্যা নির্ভর বলে জানান হাউগেন। “সংখ্যার উপর নির্ভর করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং দিন শেষে সিইও এবং চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি (জাকারকার্গ) এই সিদ্ধান্তগুলোর জন্য দায়বদ্ধ।”

নতুন কোনো ফিচার চালু করার আগে সেটির নেতিবাচক প্রভাব আছে জানার পরেও ফেইসবুক ওই ফিচার চালু করার মতো কোনো ঘটনা ঘটেছে কি না, এমন প্রশ্নে সরাসরি মার্ক জাকারবার্গের দিকেই আঙুল তুলেছেন হাউগেন। জাকারবার্গ নিজেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানান তিনি।

“আমাদের হাতে কয়েকটি নথি আছে যেটিতে মার্ক জাকারবার্গের সঙ্গে বৈঠক থেকে নেওয়া নোট আছে, যেখানে তিনি ভুয়া তথ্য প্রচার ও বিদ্বেষপূর্ণ কন্টেন্ট ঠেকানোর পদক্ষেপ বাদ দিয়ে ফেইসবুকের সঙ্গায়িত পরিমাপ ব্যবস্থা, যেমন মিনিংফুল সোশাল ইন্টার‌্যাকশন (এমএসআই)-এর ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।”

এমএসআই হচ্ছে কোনো পোস্টে ব্যবহারকারীদের কতো লাইক-কমেন্ট পড়ছে, তার হিসাব। যে কন্টেন্টের এমএসআই বেশি ফেইসবুকের নিজস্ব এআই অ্যালগরিদম ওই কন্টেন্টই ব্যবহারকারীকে দেখায়। আর প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব গবেষণাই বলছে, আক্রমণাত্মক ও বিদ্বেষপূর্ণ কন্টেন্টেই বেশি আগ্রহী হন ব্যবহারকারীরা। অর্থাৎ ওই কন্টেন্টগুলোই গুরুত্ব পায় অ্যালগরিদমের কাছে। ফলে এনগেজমেন্ট র‌্যাংকিংয়ের হিসেবেও ব্যবহারকারীর টাইমলাইনে চলে আসে বিদ্বেষপূর্ণ ও নেতিবাচক কন্টেন্ট।

ফেইসবুকের অ্যালগরিদম নিয়ে শেষ সিদ্ধান্তও জাকারবার্গের হাতেই থাকে বলে উঠে হাউগেনের সাক্ষ্য থেকে।

অ্যালগরিদমেও আছে ত্রুটি! 

ফেইসবুক দাবি করে এসেছে যে বিদ্বেষপূর্ণ কন্টেন্ট মোকাবেলায় তারা সদা তৎপর, ক্ষেত্রবিশেষে এই কাজে নিজেদের বিশ্বের সেরা বলেও দাবি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু হাউগেনের সরবরাহ করা নথিপত্র বলছে একেবারে ভিন্ন কথা।

এমএসআইয়ের ভিত্তিতে ব্যবহারকারীদের কোন কন্টেন্ট দেখাতে হবে বা এনগেজমেন্ট র‌্যাংকিংয়ের হিসেবে কোন বিজ্ঞাপন মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে--ফেইসবুকের এআই এই বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে বেশ পারদর্শী হলেও, নেতিবাচক কন্টেন্ট চিহ্নিত করার বেলায় একেবারেই দুর্বল ফেইবুকের এআই অ্যালগরিদম।

হাউগেন বলেন, আক্রমণাত্মক কন্টেন্টের “খুব সামান্যই ধরতে পারে” ফেইসবুকের এআই অ্যালগরিদম।

“সত্যিটা হচ্ছে, বড় জোর ১০ থেকে ২০ শতাংশ আক্রমণাত্মক কন্টেন্ট ধরতে পারে এআই”।

ফেইসবুক কি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি?

হাউগেন বললেন, “হ্যাঁ”। স্বৈরাচারী সরকার বা কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নেতৃত্ব ফেইসবুকের প্ল্যাটফর্মগুলোর সুযোগ নিচ্ছে কি না, এমন প্রশ্ন উঠেছিলো সিনেট শুনানিতে। হাউগেন বলেন, প্ল্যাটফর্মগুলো যে শুধু ব্যবহৃত হচ্ছে তা-ই নয়, ফেইসবুক নিজেও জানে এই বিষয়ে। 

চাকরি ছাড়ার আগে ফেইসবুকের কাউন্টার এসপিওনাজ টিমের হয়ে কাজ করেছেন হাউগেন। সেই কাজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, “আমার দলটি উইঘুরদের উপর চীনের নজরদারি চালানো অনুসরণ করেছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইরান সরকারের গোয়েন্দাগিরিও নজরে পড়েছে আমাদের।”

হাউগেন আরও বলেন, “সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কার্যক্রম মোকাবেলায় কাউন্টার এসপিওনাজ দলে নতুন কর্মী নিয়োগ দিতে ফেইসবুকের গড়িমসি জাতীয় নিরাপত্তা ইসু”। এই প্রসেঙ্গ কংগ্রেসের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা চলছে জানিয়ে হাউগেন বলেন, “ফেইসবুক এখন যেভাবে কাজ করে, তার ফলে জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত আমি”। 

ফেইসবুকের বাজারে টিকে থাকার হাতিয়ার এখন শিশুরা!

তরুণ প্রজন্মের ব্যবহারকারীদের অনেকেই এখন ফেইসবুক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। অন্যদিকে একের পর এক কেলেঙ্কারি পিছু ছাড়ছে না ফেইসবুকের। এমন পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতের গ্রাহক হিসেবে ফেইসবুক শিশুদের দিকে নজর দিচ্ছে এবং ইনস্টাগ্রাম কিডসের মতো পণ্য দিয়ে সেই লক্ষ্য পূরণের চেষ্টাও করছে বলে জানিয়েছেন হাউগেন।

ফেইসবুক আপাতত ইনস্টাগ্রাম কিডস প্রকল্প বন্ধ রাখলেও তা চিরস্থায়ী হবে কি না বা ফেইসবুক এমন পণ্য নির্মাণ বন্ধ করবে কি না, সিনেটর ব্রায়ান শাটজের এমন প্রশ্নের উত্তরে হাউগেন বলেন, “সেটা হলে আমি অবাক হবো। তাদের ইউজার লাগবে। বাচ্চারা প্ল্যাটফর্মে এলে, তাদের সঙ্গে তাদের অভিভাবকরাও প্ল্যাটফর্মে আসবেন। আর ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার শিশুদের অভ্যাসে পরিণত করার মাধ্যমে ভবিষ্যতের ব্যবহারকারী নিশ্চিত করতে পারবে তারা।”