জেনেও প্ল্যাটফর্মে ‘দাস বাণিজ্য’ চলতে দিয়েছে ফেইসবুক

নিজেদের তদন্তের হাত ধরেই ফেইসবুক জানতো তাদের ইনস্টাগ্রাম অ্যাপটি মধ্যপ্রাচ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে দাসী কেনাবেচার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে। প্রতিষ্ঠানটি দিনের পর দিন চলতে দিয়েছে মানব পাচারের এই কর্মকাণ্ড। সংবাদপত্র প্রতিবেদন আর অ্যাপলের সরাসরি হুমকির আগে এ বিষয়ে গা করেনি বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী এই সামাজিক মাধ্যম।

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Sept 2021, 08:18 AM
Updated : 24 Sept 2021, 08:18 AM

২০১৯ সালে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি ‘গৃহ দাসী’ বেচা-কেনায় ইনস্টাগ্রামের ব্যবহার উন্মোচন করে প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই ফেইসবুককে হুমকি দেয় অ্যাপল। অ্যাপ স্টোরে ফেইসবুকের সকল সেবা ও অ্যাপ নিষিদ্ধ করার কথা বলেছিল অ্যাপল।

ফেইসবুককে অ্যাপলের হুমকি দেওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের ‘ফেইসবুক ফাইলস’ প্রতিবেদনে। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরীণ নথি বিশ্লেষণ করে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন দৈনিকটি। প্রতিবেদনগুলোর সূত্র ধরে বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে শীর্ষ সামাজিক মাধ্যমটি।

ফেইসবুকের দাবি, প্রতিষ্ঠানটি “কোনো অবস্থাতেই” নিপীরণ সমর্থন করে না।

বিবিসি’র প্রতিবেদন থেকে ঘটনার সূত্রপাত

ফেইসবুকের মালিকানাধীন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অনলাইনেই চলছিলো বেআইনী গৃহকর্মী বেচা-কেনার কালোবাজার। ওই ঘটনা উৎঘাটন করেছিলো আরবি ভাষার বিবিসি সংবাদ।

আরব বিশ্বে গৃহকর্মী হিসেবে কর্মরত নারীদের অমানবিক জীবনযাপনের উপর আলোকপাত করেছিলো বিবিসি’র ওই প্রতিবেদন। মৌলিক অধিকার বঞ্চিত ওই নারীরা যে কোনো সময়ে বেশি দাম হাকানো ব্যক্তির কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকতেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস্তবে তাদের অবস্থা ছিলো মধ্যযুগীয় একজন কৃতদাসীর মতো।

গৃহকর্মীদের দাস হিসেবে বেচা-কেনা চলতো কয়েকটি অ্যাপ ব্যবহার করে। এর মধ্যে ফেইসবুকের মালিকানাধীন ইনস্টাগ্রামও ছিলো। পোস্টগুলো হতো আরবি ভাষায় এবং মূলত সৌদি আরব ও কুয়েতের ব্যবহারকারীরা ওই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিবিসি জানিয়েছে, জাতিভেদে ‘শ্রেণিভূক্ত’ করা হতো ওই নারীদের। কিনতে পাওয়া যেত কয়েক হাজার ডলারের বিনিময়ে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় কয়েক লাখ টাকার সমান।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছে, বিবিসি’র ওই প্রতিবেদনের পর মানব পাচার বন্ধে ফেইসবুককে “আরও তৎপর” হতে বলেছিলো অ্যাপল। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই সমস্যা সমাধানে অ্যাপল হুমকি দেওয়ার আগ পর্যন্ত “কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি” ফেইসবুক।

এরপর, এসব কর্মকাণ্ড বন্ধ না করলে ফেইসবুকের সকল পণ্য অ্যাপ স্টোর থেকে মুছে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলো অ্যাপল।

মার্কিন দৈনিকটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিবিসি তদন্তে নামার অনেক আগে থেকেই তাদের প্ল্যাটফর্ম মানব পাচারের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে জানতো ফেইসবুক।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের হাতে আসা ফেইসবুকের অভ্যন্তরীণ নথিতে প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব গবেষকরা লিখেছেন, “এই বিষয়টি কি বিবিসি’র তদন্ত এবং অ্যাপল খেপে যাওয়ার আগে জানা ছিলো? হ্যাঁ। ২০১৮ সালের পুরোটা সময় এবং ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে বৈশ্বিক পর্যায়ে অনুশীলন চালিয়ে আমরা বোঝার চেষ্টা করেছি গৃহদাসী হিসেবে বেচা-কেনার পুরো পুরো প্রক্রিয়া কিভাবে আমাদের প্ল্যাটফর্মে উঠে আসছে, নিয়োগ প্রক্রিয়া, নিপীড়ণ এবং কীভাবে প্ল্যাটফর্ম এই সুযোগ দিচ্ছে।”

২০১৯ সালের বিবিসি প্রতিবেদনের পর ওই প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত মূল হ্যাশট্যাগ নিষিদ্ধ করে ফেইসবুক। বন্ধ করে দেওয়া হয় কয়েকশ’ ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট।  

বিবিসি’র প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় ফেইসবুক বলেছিলো “আমরা প্ল্যাটফর্মে এমন আচরণ ঠেকাতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, বিশেষজ্ঞ সংস্থা এবং পুরো শিল্পের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাবো।”

তবে ওই প্রতিবেদন প্রকাশের সময়েও ফেইসবুকের প্ল্যাটফর্মে দাস হিসেবে নারীদের বেচা-কেনা চালু ছিলো বলে জানিয়েছে বিবিসি।

জানানো হয়েছিলো অ্যাপল ও গুগলকে

ওই প্রতিবেদন করার সময় বিবিসি অ্যাপল ও গুগলকেও জানিয়েছিলো যে তাদের স্মার্টফোন অ্যাপস্টোর থেকে পাওয়া অ্যাপের মাধ্যমেই চলছে দাস-দাসীর বেচা-কেনা।

ওই বেআইনি লেনদেনগুলো ছিলো ব্যবহারকারী ও ডেভেলপারদের বিষয়ে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর নীতিমালার পরিষ্কার লঙ্ঘন। নিজস্ব প্ল্যাটফর্মে বেআইনি কর্মকাণ্ড ঠেকাতে ডেভেলপারদের সঙ্গে এক যোগে কাজ করার কথা বলে উভয় প্রতিষ্ঠান। 

ওই সময়ে গুগল বিষয়টি নিয়ে “গভীরভাবে বিচলিত” বলে জানিয়েছিলো। আর ডেভেলপারদের কাছ থেকে “তাৎক্ষণিক সংশোধনমূলক পদক্ষেপ” প্রত্যাশা করা হচ্ছে--বলেছিলো অ্যাপল।

ফেইসবুকের প্রতিক্রিয়া

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছে, ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে বিবিসি’র প্রতিবেদন প্রকাশের পর তৎপরতা বাড়ায় ফেইসবুক। মানব পাচারের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজতে প্রতিষ্ঠানটি স্বপ্রণোদিত উদ্যোগে “তিন লাখের বেশি নীতিমালার সম্ভাব্য ব্যত্যয় খুঁজে পেয়েছিলো এবং বন্ধ করে দিয়েছিলো এক হাজারের বেশি অ্যাকাউন্ট”।

বিবিসি’র প্রতিবেদনের পর ফেইসবুকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলো জাতিসংঘও।

এসবের প্রতিক্রিয়ার ২০২০ সালের জুন মাসে ফেইসবুক লিখেছিলো, “বিবিসি’র অনুসন্ধানের সূত্র ধরে তদন্তের অনুরোধের পর আমরা নিজেদের প্ল্যাটফর্ম রিভিউ করেছি। আমরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সাতশ’ ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট মুছে দিয়েছি এবং একই সঙ্গে নীতিমালা ভঙ্গকারী হ্যাশট্যাগ ব্লক করে দিয়েছি।

পরের মাসেই ফেইসবুক ও ইনস্টাগ্রাম থেকে গৃহদাসীর বেচা-কেনা সংক্রান্ত এক লাখ ৩০ হাজার আরবি ভাষার কন্টেন্ট মুছে দেওয়ার দাবি করে ফেইসবুক। 

এর পাশাপাশি বেআইনি মানব পাচারে নিজস্ব প্ল্যাটফর্মের অপব্যবহার বন্ধে নতুন প্রযুক্তি নির্মানের কথা বলেছিলো ফেইসবুক। যার মাধ্যমে “ জানুয়ারি ২০২০ থেকে এখন (জুন ২০২০) পর্যন্ত আরবি ও ইংরেজি ভাষার চার হাজার নীতিমালা লঙ্ঘনকারী কন্টেন্ট মুছে দেওয়া হয়েছে”-- জানিয়েছিলো ফেইসবুক।