কিশোর বয়সীদের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব জেনেও লুকিয়েছে ফেইসবুক

কিশোর বয়সী ব্যবহারকারীদের উপর সামাজিক মাধ্যমের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে বিভিন্নভাবে গবেষণা চালিয়েছে ফেইসবুক ও ইনস্টাগ্রাম। ব্যবহারকারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর সামাজিক মাধ্যমগুলোর নেতিবাচক প্রভাবের প্রমাণও মিলেছে সেই গবেষণায়। কিন্তু অভ্যন্তরীণ গবেষণার ফলাফল সমালোচক, বিশ্লেষক ও সাধারণ ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে এতোদিন গোপন রেখেছে ফেইসবুক কর্তৃপক্ষ।

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Sept 2021, 08:43 AM
Updated : 17 Sept 2021, 08:43 AM

ফেইসবুকের অভ্যন্তরীণ গবেষণা এবং তার ফলাফল চেপে যাওয়ার বিষয়টি প্রকাশ করেছে দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। ওই গোপন গবেষণা প্রতিবেদনের সূত্র ধরে আবারও সমালোচক ও প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের তোপের মুখে পড়েছে শীর্ষ সামাজিক মাধ্যমটি।

প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব গবেষণাতেই উঠে এসেছে-- কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে উদ্বেগ আর বিষাদ বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখছে ইনস্টাগ্রাম। কিশোর বয়সীদের একটা অংশ আত্মহত্যার চিন্তায় প্রভাবিত হচ্ছেন সামাজিক মাধ্যমটির কারণে।

কিশোর বয়সীদের উপর সামাজিক মাধ্যমের প্রভাব নিয়ে টানা কয়েক বছর ধরে তথ্য সংগ্রহ ও গবেষণা করেছে ফেইসবুকের মালিকানাধীন ফটো ও ভিডিও শেয়ারিং সেবা ইনস্টাগ্রাম। ওই গবেষণার প্রতিবেদন ও ফলাফল গোপন রাখায় এবার অভিযোগ উঠেছে, প্রতিষ্ঠানটি কাছে ব্যবহারকারীদের ‘নিরাপত্তার তুলনায় মুনাফা’ বেশি গুরুত্ব পায়।

ইনস্টাগ্রাম বলছে, “জটিল এবং কঠিন বিষয়গুলো বুঝতে অঙ্গীকারের” প্রমাণ ওই গবেষণাগুলো। অন্যদিকে, সামাজিক মাধ্যমটির অভ্যন্তরীণ গবেষণা নিয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদন নিয়ে টু শব্দটিও করেনি মূল প্রতিষ্ঠান ফেইসবুক।

বিশ্বের শীর্ষ সামাজিক মাধ্যমটির গবেষণা প্রতিবেদন থেকে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো পেয়েছে, সেগুলো হলো:

২০১৯ সালের একটি প্রেজেন্টেশন স্লাইডে বলা হয়েছে “প্রতি তিনজন কিশোরীর মধ্যে একজনের শারীরিক গঠন নিয়ে হীনমন্যতা বাড়াই আমরা।”

আরেকটি স্লাইডে বলা হয়েছে, ইনস্টাগ্রাম তাদের উদ্বেগ ও বিষণ্নতা বাড়াচ্ছে বলে ফটো-ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপটিকে দুষেছেন কিশোর বয়সীরা।

২০২০ সালের গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৩২ শতাংশ কিশোরী বলেছেন, নিজের শারীরিক গড়ন নিয়ে যখন তারা হীনমন্যতা ভুগতেন, তখন সেই হীনমন্যতায় আরও রশদ জুগিয়েছে ইনস্টাগ্রাম।

যুক্তরাজ্যের প্রায় ১৩ শতাংশ কিশোর বয়সী এবং যুক্তরাস্ট্রের ৬ শতাংশ ব্যবহারকারী তাদের আত্মহত্যার চিন্তায় প্রভাবিত হয়েছেন ইনস্টাগ্রাম থেকে।

টানা কয়েক বছর ধরে একাধিক ফোকাস গ্রুপ, অনলাইন জরিপ আর ডায়রি বিশ্লেষণ করে গবেষণা করেছে ফেইসবুক কর্তৃপক্ষ।

২০২১ সালেও বড় পরিসরে কয়েক হাজার ব্যবহারকারীর উপর গবেষণা চালিয়ে তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য নিজস্ব ডেটার সঙ্গে তুলনা করে ইনস্টাগ্রাম দেখেছে যে ব্যবহারকারীরা প্ল্যাটফর্মে কতো সময় দিচ্ছেন এবং কোন ধরনের কন্টেন্ট দেখছেন। 

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনের পর নিজেদের গবেষণার সাফাই গাইতে লম্বা ব্লগ পোস্ট প্রকাশ করেছে ইনস্টাগ্রাম।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল কেবল “সীমিত কিছু ফলাফলের উপর জোর আরোপ করেছে এবং বিষয়গুলোকে নেতিবাচকভাবে উত্থাপন করেছে”-- কিন্তু “মূল বিষয়টি আরও জটিল” বলে মন্তব্য করেছে ইনস্টাগ্রাম। 

“ইনস্টাগ্রামকে সবার জন্য নিরাপদ ও সহায়ক একটি জায়গা হিসেবে গড়ে তুলতে নীপিড়ন, আত্মহত্যা, নিজের শারীরিক ক্ষতি, ক্ষতিকারক খাদ্যাভ্যাস নিয়ে বিস্তর কাজ করেছি আমরা।”--ব্লগ পোস্টে বলেছে প্রতিষ্ঠানটি।  

“আমাদের গবেষণা এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে আমরা একাধিক ফিচার তৈরি করেছি যার মাধ্যমে হয়রানি থেকে মানুষ নিজেদের রক্ষা করতে পারে। ‘লাইক কাউন্ট’ লুকিয়ে রাখার অপশনও যোগ করেছি আমরা এবং ভুক্তভোগীদের স্থানীয় সমর্থন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছি।”

তবে, ভবিষ্যতে গবেষণার তথ্য নিয়ে আরও স্বচ্ছতা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

ছবি- রয়টার্স

মানোসিক ক্ষতির থেকে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে মুনাফা

ইনস্টাগ্রাম ও ফেইসবুক গবেষণার তথ্যের ভিত্তিতে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে চুপ করে বসে থাকায় খেপেছেন ‘যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল সোসাইটি ফর দ্য প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েলটি টু চিলড্রেন’-এর অনলাইন শিশু নিরাপত্তা বিষয়ক প্রধান অ্যান্ডি বারোস। সামাজিক মাধ্যমগুলোর এই আচরণকে “ভয়ংকর” বলে আখ্যা দিয়েছেন তিনি।

“নিজেদের সাইটে সবার জন্য আরও নিরাপদ করা বাদ দিয়ে তারা গবেষক, নিয়ন্ত্রক এবং সরকারের কাজে বাধা সৃষ্টি করে এবং জনসংযোগ ও তদবির চালিয়ে উল্টোটা করার চেষ্টা করে”-- মন্তব্য করেছেন বারোস।

এক্ষেত্রে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে “দায়বদ্ধ” করার সময় এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাজ্যের একটি সংসদীয় কমিটির প্রধান ডেমিয়েন কলিন্স। ব্যবহারকারীদের নিরাপদ রাখতে বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত, সেই বিষয়টি বিবেচনা করে দেখছে ওই কমিটি।

“ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের ফেইসবুক তদন্ত এটা ফাঁস করে দিয়েছে যে কীভাবে প্রতিষ্ঠানটি বারবার ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তার কথা ভুলে মুনাফা কামানোকেই বেশি গুরুত্ব দেয়”--মন্তব্য করেছেন কলিনস।

“তাদের নিজস্ব গবেষণা জানিয়েছে, কিশোর বয়সী ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীদের একটা বড় অংশ বলছে যে প্ল্যাটফর্মটি কারণে তারা নিজেদের নিয়ে আরও বেশি হীনমন্যতায় ভোগেন--কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি শুধু এটাই চায় যে তারা যেন প্ল্যাটফর্মে ফিরে আসেন।”

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রচারণা সংস্থা ফেয়ারপ্লে বলছে, ইনস্টাগ্রাম যে শিশুদের জন্য কোনো প্ল্যাটফর্ম নয় সেটাই প্রমাণ করছে সাম্প্রতিক খবরগুলো।

“ফেইসবুকের আচরণ ঠিক যেন তামাকপণ্য উৎপাদকদের বই থেকে নেওয়া। নেতিবাচক প্রভাবগুলো কমিয়ে বলছে তারা। সাধারণ জনগনের কাছ থেকে গবেষণার তথ্য লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো, এমনকি কংগ্রেস সদস্যরা সেটা চাইলেও তাদের দেওয়া হয়নি।”

“ব্যবহারকারীদের প্রতি চূড়ান্ত অবহেলার দৃষ্টান্ত হিসেবে এখন শিশুদেরকেও ইনস্টাগ্রামে আসক্ত করতে চায় প্রতিষ্ঠানটি।”

গবেষণার সম্পূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য ফেইসবুককে বাধ্য করতে মার্কিন সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে ফেয়ারপ্লে। শিশুদের জন্য ইনস্টাগ্রাম প্রকাশের পরিকল্পনা আটকে দেওয়ার দাবিও করেছে সংস্থাটি।

উল্লেখ্য, চলতি বছরের প্রথম অংশে ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য বিজ্ঞাপনবিহীন ইনস্টাগ্রাম নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলো ফেইসবুক।

ছবি: রয়টার্স

গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্যকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না জাকারবার্গ

মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ফেইসবুকের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করতে সামাজিক মাধ্যমটির প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গের সঙ্গে দেখা করেছিলেন নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির স্টার্ন স্কুল অফ বিজনেসের সোশাল সাইকোলজিস্ট জোনাথান হাইডট। বিবিসি রেডিও ৪-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, “তিনি (জাকারবার্গ) আগ্রহ দেখালেও তার মতে গবেষণার ফলাফল অস্পষ্ট এবং এর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব নেই। কিন্তু এখন আমরা জানি যে তাদের নিজস্ব গবেষণাতেও ক্ষতিকর প্রভাব চিহ্নিত হয়েছে। তাদের ফোকাস গ্রুপ ছিলো, তারা অনলাইনে জরিপ করেছে -- এটা হুট করে পাওয়া কোনো আবিষ্কার নয়।”

“তারা ক্ষতিকারক প্রভাবের প্রমাণ পাওয়া মাত্র স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসে বলবে যে ‘হায় ঈশ্বর! আমাদের পণ্য মানুষের ক্ষতি করছে’, এটা আমি আশা করি না। কিন্তু তাদের কাছে যদি একাধিক সূত্র থেকে পাওয়া প্রমাণ থাকে, এমনটি প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকেও প্রমাণ আসে, তাহলে আমি মনে করি পুরো বিষয়টাই বেশ পরিষ্কার।”

তবে, “ভিন্ন কিছু চাইলে চাইলে একদম গোড়া থেকে প্রতিষ্ঠানের সব অংশেই পরিবর্তন আসতে হবে। “এই প্ল্যাটফর্মটি শিশুদের নিজের ফটো পোস্ট করতে উদ্বুদ্ধ করে, যেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের অচেনা লোকজন এসে তাদের মতামত দিয়ে যেতে পারে”--যোগ করেন তিনি।

“তাদের ব্যবসা কাটামোই যদি এটা হয়, তবে সেটা ঠিক করার কোনো উপায় নেই।”