ফাজি: কোভিড টিকা নিয়ে যেভাবে ফাঁস হলো ভুয়া প্রচারণা

ইউটিউব স্পনসরশিপের নামে কোভিড-১৯ টিকা নিয়ে ভুয়া তথ্য প্রচারের চেষ্টা করছিলো একটি বিজ্ঞাপন ও বাজারজাতকরণ প্রতিষ্ঠান। আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে সেই পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়েছেন ইউটিউবাররা।

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 July 2021, 02:01 PM
Updated : 26 July 2021, 02:59 PM

কোভিড টিকা নিয়ে মিথ্যাচারের অপচেষ্টার ঘটনা জনসমক্ষে এনেছেন জার্মান ইউটিউবার মিরকো দ্রচম্যান এবং ফরাসী ইউটিউবার লিউ গ্রাসে। চলতি বছরের মে মাস নাগাদ ‘ফাজি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে স্পনসরশিপের প্রস্তাব পান দ্রচম্যান। আস্ট্রাজেনেকা টিকার তুলনায় ফাইজার টিকা গ্রাহকদের মৃত্যুর হার তিন গুণ বেশি-- ভিডিওতে এমন তথ্য প্রচার করতে বলে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু ভিডিওতে স্পন্সরশিপ চুক্তি গোপন রাখতে বলে ওই প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি মূল বিজ্ঞাপনদাতার নামও আড়ালে রাখে প্রতিষ্ঠানটি। আর এতেই সন্দেহের উদ্রেক হয় সাংবাদিক ও ইউটিউবার দ্রচম্যানের।

ইউটিউবে দ্রচম্যানের সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা ১৫ লাখ বলে জানিয়েছে বিবিসি। দ্রচম্যানকে ইউটিউবসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে যে তথ্য প্রচার করতে বলা হচ্ছিলো সেটা ভুয়া ও জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকির কারণে হয়ে দাঁড়াতে পারে বুঝতে পেরে পিছু হটেন তিনি।

দ্রচম্যানের পাশাপাশি, দুই হাজার ইউরোর বদলে একই তথ্য প্রচারের প্রস্তাব পান আরেক ইউটিউবার লিও গ্রাসে। কিন্তু বিজ্ঞাপনী  প্রচারণার মূল মক্কেল নিজের পরিচয় গোপন রাখতে চাইছেন এটা জানার পর সন্দেহের উদ্রেক হয় তারও।

মূল ঘটনা উদঘাটনের জন্য প্রাথমিক অবস্থায় স্পন্সরশিপ চুক্তিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন দুজনেই। এরপর ওই বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বিস্তারিত নির্দেশনা দেওয়া হয় ভিডিওতে ইউটিউবাররা কী বলবেন সেই বিষয়ে।

“এমন আচরণ করুন যাতে মনে হয় এই বিষয়ে আপনার আগ্রহ আছে”-- এমনটা বলা হয়েছিলো বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানের নির্দেশাবলীতে। ভিডিও কেউ স্পন্সর করছে, এই ব্যাপারটি চেপে যেতে এবং ইউটিউবাররা নিজের ইচ্ছায় ভিডিও বানিয়ে নিজের মত প্রকাশ করছেন এমন আচরণ করতে বলা হয় তাতে।

কোনো কন্টেন্ট কেউ স্পন্সর করলে সেই তথ্য ভিডিওতে গোপন করা যাবে না বলে উল্লেখ করা আছে সামাজিক মাধ্যমগুলোর নিয়মাবলীতে। এ ছাড়াও, ফ্রান্স ও জার্মানিতে স্পন্সরশিপ চুক্তি গোপন রাখা বেআইনি।

ফরাসী সংবাদপত্র ‘ল্যো মঁদ’-এর একটি প্রতিবেদন ভিডিও’র অন্তর্ভূক্ত করতে সামাজিক মাধ্যমের ইনফ্লুয়েন্সারদের বলে ‘ফাজি’। ওই প্রতিবেদনে ‘ইউরোপিয়ান মেডিসিন এজেন্সি’ থেকে ফাঁস হওয়া ডেটা নিয়ে তথ্য থাকলেও টিকার কারণে মৃত্যু নিয়ে কিছুই বলা হয়নি। কিন্তু ‘ফাজি’র নির্দেশাবলী মেনে ভিডিও বানালে মনে হতো যে আস্ট্রাজেনেকা টিকার থেকে ফাইজার টিকায় বেশি মৃত্যুহারের তথ্য ওই ফাঁস হওয়া ডেটা থেকেই এসেছে।

সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইউটিউবারদের যে তথ্য প্রচার করতে বলা হচ্ছিল, সেটি বিভিন্ন সূত্র থেকে নিয়ে প্রাসঙ্গিক বিষয়ের বাইরে ব্যবহার করে একটি ভূল ধারণা সঠিক বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছিলো বলে জানিয়েছে বিবিসি।

ইউটিউবারদের বিভিন্ন দেশে টিকা নেওয়ার পর মৃত্যুর হার সম্পর্কিত ডেটা সরবরাহ করা হয়। কিন্তু কেউ টিকা নেওয়ার পর মারা গেছেন, তার মানে এই নয় যে টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াতেই মারা গেছেন তিনি, সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক কারণ অথবা দুর্ঘটনাও হতে পারে মৃত্যুর কারণ। এ ছাড়াও, পরিসংখ্যানের ডেটা সংগ্রহ করা হয়েছিলো যে সময়ে, ওই সময়ে উল্লিখিত দেশগুলোতে ফাইজারের টিকাই দেওয়া হয়েছে বেশি। ফলে মৃতের সংখ্যার মধ্যে ফাইজার টিকা গ্রাহকদের উপস্থিতিটাই স্বাভাবিক।

এ ছাড়াও ইউটিউবারদের ইন্টারনেটের কয়েকটি প্রতিবেদনের লিংক দেওয়া হয় নির্দেশাবলীতে। প্রতিবেদনগুলোর মূল সূত্র ছিলো সন্দেহজনক এবং ফাইজার টিকা সংশ্লিষ্ট একই ডেটা ভুলভাবে উপস্থাপন করছিলো বলে জানিয়েছে বিবিসি। দ্রচম্যান আর গ্রাসে বিজ্ঞাপনী ক্যাম্পেউনের গোমড় ফাঁস করে দেওয়ার পর মুছে দেওয়া হয়েছে ওই প্রতিবেদনগুলো।

দ্রচম্যান ও গ্রাসে বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানের ভুয়া গুজব ছড়ানোর চেষ্টা ফাঁস করে দেওয়ার পর ইউরোপ ও ফ্রান্সের আরও ৪ জন ইনফ্লুয়েন্সার ‘ফাজি’র স্পন্সরশিপ প্রস্তাব পেয়ে নাকচ করে দেওয়ার ঘটনা নিশ্চিত করেছেন।

তবে ‘ফাজি’র এই  প্রচারণায় অংশ নেওয়া অন্তত দু’জন ইউটিউবারকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন জার্মান সাংবাদিক ড্যানিয়েল লোফার। ডেটিং ও গাড়ি নিয়ে ভিডিও বানান ভারতীয় ইউটিউবার ‘আশকার টেকি’, আর হাস্যরসাত্মক কন্টেন্টের জন্য পরিচিত ব্রাজিলেন ইনফ্লুয়েন্সার এভারসন জোইও।

দু’জনেই এর আগে ‘ফাজি’র বিজ্ঞাপনী  প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে বিবিসি। টিকা নিয়ে অপপ্রচারের গোঁমড় ফাঁস হয়ে গেলে নিজেদের অ্যাকাউন্ট থেকে ভিডিও মুছে দেন তারা। বিবিসি’র যোগাযোগের চেষ্টাতেও সাড়া দেননি দু’জনের কেউ।

বিবিসি জানিয়েছে, আদতে ‘অ্যাডনাও’-নামের একটি ডিজিটাল মার্কেটিং প্রতিষ্ঠানের অংশ ‘ফাজি’। রাশিয়া ও যুক্তরাজ্য, দুই দেশেই নিবন্ধন আছে প্রতিষ্ঠানটির।

বিভিন্নভাবে ‘অ্যাডনাও’-এর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে সব শেষে প্রতিষ্ঠানটির যুক্তরাজ্যভিত্তিক পরিচালক ইওয়ান টোলাডে’র সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয় বিবিসি। টোলাডে জানিয়েছেন, ‘ফাজি’ আদতে তার রাশিয়ান সহকর্মী ও পরিচালক স্টানিস্লাভ ফেসেংকো ও তৃতীয় এক ব্যক্তির সম্মিলিত উদ্যোগ ছিলো। তবে তৃতীয় ব্যক্তির পরিচয় জানেন না বলে বিবিসি’কে জানিয়েছেন টোলাডে।

টিকা নিয়ে ভুয়া খবর ছড়ানোর  প্রচারণার সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন না বলে দাবি করেছেন টোলাডে। তবে ‘ফাজি’ ও ‘অ্যাডনাও’-এর যুক্তরাজ্যের শাখা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

ফ্রান্স ও জার্মানি, উভয় দেশের কর্তৃপক্ষ সামাজিক মাধ্যমের কন্টেন্ট নির্মাতাদের দিয়ে টিকা নিয়ে অপপ্রচার চালানোর এই চেষ্টা তদন্ত করছে বলে জানিয়েছে বিবিসি। বিজ্ঞাপনী  প্রচারণার পেছনের মূল হোতার পরিচয় এখনও জানা যায়নি। তবে সন্দেহের আঙুল রাশিয়ার দিকে। ধারণা করা হচ্ছে, রাশিয়া তার নিজস্ব টিকা স্পুটনিক ফাইভ-এর প্রচার বাড়ানোর জন্য অন্য টিকা নিয়ে অপপ্রচারের ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে-- জানিয়েছে বিবিসি।