আদতে কতোটা গোপন আপনার জিমেইল?

আমরা প্রায় সবাই আমাদেরকে ওয়েবে ট্র্যাক করা ‘কুকি’ সম্পর্কে অল্পবিস্তর জানি। গুগল সার্চে গোপনতা লঙ্ঘনের অভ্যাসও আমাদের অজানা নয়। কিন্তু গুগলের ইমেইল সেবা, জিমেইল যে আমাদের কাছ থেকে যে পরিমাণ ডেটা সংগ্রহ করে থাকে, সেটির ব্যাপারে কতোটুকু জানেন আপনি?

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 May 2021, 07:55 PM
Updated : 10 May 2021, 07:55 PM

ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান তথ্যসমৃদ্ধ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জিমেইলের তথ্যসংগ্রহের বিস্তৃতি নিয়ে। আসুন জেনে নেওয়া যাক কী বলেছে তারা--

সম্প্রতি অ্যাপলের চাপে অন্যান্য আর দশটি প্রতিষ্ঠানের মতো নিজেদের জিমেইল অ্যাপে ‘গোপনতা লেবেল’ জুড়তে বাধ্য হয়েছে গুগল। এর মধ্য দিয়ে নিজের মুখেই গুগল স্বীকার করেছে কোন কোন ডেটা তারা জিমেইলের মাধ্যমে সংগ্রহ করে এবং বিজ্ঞাপনদাতাদের সঙ্গে শেয়ার করে।

জিমেইলের লেবেল বলছে, আইওএস জিমেইল অ্যাপ যথাযথ অনুমতি পেলে ব্যবহারকারীর আনুমানিক অবস্থানসহ নানাবিধ তথ্য শেয়ার করে, ‘ইউজার আইডি’ ব্যবহার করে তাদেরকে ট্র্যাক করে গুগল এবং ব্যবহারকারীরা অনলাইনে কোন বিজ্ঞাপনগুলো দেখছে সে তথ্যগুলো বিজ্ঞাপনদাতাদের সঙ্গে শেয়ার করে তারা।

গুগল সবসময়ই নিজেদের এসব কর্মকাণ্ডের সাফাইয়ে বলে, “আরও ভালো সেবা তৈরির” লক্ষ্যে এমনটি করা হয়। কিন্তু তাদের “আরও ভালো সেবা” তৈরির ফাঁদে পড়ে ব্যবহারকারীর কেনাকাটা সম্পর্কিত তথ্য, অবস্থান, ইমেইল অ্যাড্রেস, ছবি, সার্চ হিস্ট্রি – কোনোকিছুই আর গোপন থাকছে না।

জিমেইল বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ইমেইল সেবা, গোটা বিশ্বে তাদের সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা দেড়শ’ কোটিরও বেশি। এটি যে কত বেশি তা মাইক্রোসফট আউটলুক এবং ইয়াহু মেইলের দিকে তাকালেই তুলনা করা যায়। বর্তমানে মাইক্রোসফট আউটলুক ব্যবহার করছেন ৪০ কোটি, আর ইয়াহু মেইলে সাইন আপ রয়েছে ২২ কোটি ৫০ লাখের।

গুগল এক সময় বিজ্ঞাপন দেখানোর জন্য ইমেইলের ভেতরে থাকা যোগাযোগ তালিকাও স্ক্যান করতো, পরে ২০১৭ সালে ওই অনুশীলন থেকে সরে এসেছে প্রতিষ্ঠানটি। এখনও তারা ইমেইল স্ক্যান করে, তবে তা শুধু স্মার্ট ফিচারের স্বার্থে, যেমন ছুটির মৌসুমে কোনো বুকিং বা কোনো সরবরাহের ব্যাপারটি সরাসরি ক্যালেন্ডারে যোগ করতে, বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাক্য সম্পন্ন করে দেওয়ার পরামর্শ দেখানোর লক্ষ্যে। গত বছর থেকে জিমেইলে ‘শপিং অ্যাডস’ বা একদম সাদামাটা বাংলায় কেনাকাটা সম্পর্কিত বিজ্ঞাপন দেখানোও শুরু করেছে তারা।

গোপনতা পরামর্শক ‘মিস আইজি গিক’ –এর প্রতিষ্ঠাতা রোয়েনা ফিল্ডিংয়ের মতে, একজন ব্যবহারকারী যতভাবে জিমেইল ব্যবহার করেন, তার সবই নজরদারিতে রাখা সম্ভব। যেমন, কোন দিন বা তারিখে আপনি ইমেইল পাঠাচ্ছেন, কার সঙ্গে কথা বলছেন, কোন বিষয়ের উপর ইমেইল পাঠাচ্ছেন।

গুগল যেভাবে আপনার ডেটা ব্যবহার করে

জিমেইল থেকে সংগৃহীত এবং বিজ্ঞাপনদাতাদের সঙ্গে শেয়ার করা অধিকাংশ তথ্যই মেটাডেটা বা ডেটা সম্পর্কিত ডেটা। কিন্তু আপনি যদি অন্য গুগল সেবার কুকি বহন করেন, তাহলে আপনার কর্মকাণ্ডকে গুগল ম্যাপস এবং ইউটিউবের মতো সংশ্লিষ্ট সেবার সঙ্গে মেলানো হয়। এ প্রসঙ্গে ফিল্ডিং বলছেন, “তাদের বিস্তর এবং গভীর নজরদারি কাঠামোর কারণে জিমেইল আপনার গোটা অনলাইন জীবনের একটি জানালায় পরিণত হয়।”

“কার্যতঃ আপনি অনলাইনে যা কিছু করছেন তা গুগলের কাছে যায়।” – যোগ করেছেন ফিল্ডিং।

গুগল দাবি করছে, কেনাকাটা সম্পর্কিত তথ্যের জন্য ইমেইল স্ক্যান করে পাওয়া ডেটা, সরবরাহ ট্র্যাকিং নাম্বার এবং ফ্লাইট বুকিংয়ের কোনোটিই বিজ্ঞাপনের জন্য ব্যবহার করা হয় না।

এ প্রসঙ্গে নিরাপদ ইমেইল সেবা প্রটোনমেইলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী অ্যান্ডি ইয়েন বলছেন, “যাই হোক না কেন গুগল যে এই ব্যাপারগুলোর ডেটা সংগ্রহ করে এবং তা লগ করে, সেটি একটি সত্য হিসেবেই রয়ে যাচ্ছে।”

ইমেইল ডেটা সংগ্রহ এবং ট্র্যাকিং প্রশ্নে নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগে অনুপস্থিতিকে এ সমস্যার জন্য আংশিকভাবে দায়ী করা যায়। অধিকাংশ মানুষই ইউরোপীয় ইউনিয়নের ই-প্রাইভেসি ডিরেকটিভ এবং ‘জেনারেল ডেটা প্রটেকশন রেগুলেশন’ (জিডিপিআর) সম্পর্কিত ওয়েবসাইটে যাওয়ার পর ট্র্যাকিং সম্পর্কে জানতে পারে।

“মানুষ কুকি সম্পর্কে জানেন গোপনতা এবং ডেটা সুরক্ষা আইনের বরাতে – এটি বলছে আপনার ডিভাইসে ট্র্যাকার দেওয়ার জন্য আপনার সম্মতি লাগবে, এবং আপনার ডেটা নিয়ে কী হচ্ছে তা জানার অধিকার রয়েছে আপনার। ইউরোপে, ওই সুরক্ষা ইমেইল ট্র্যাকিংয়ের বেলাতেও খাটে, কিন্তু এই খাতে তেমন কোনো প্রয়োগ হয়নি।” – বলেছেন ফিল্ডিং।

জিমেইল বনাম অন্যান্য সেবা

এ ধরনের কাজ যে শুধু জিমেইলই করছে, অন্যান্য ইমেইল সেবাদাতারা করছে না, তা নয়। জিমেইলের মতো, মাইক্রোসফট আউটলুকও প্রতিষ্ঠানটির ইকোসিস্টেমের অন্যান্য সেবার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ফিল্ডিং বলছেন, “মূলধারার যে কোনো ভোক্তাকেন্দ্রিক সেবার অ্যাকাউন্ট বিনামূল্যে পাওয়ার মানে হচ্ছে, আপনি ওই সেবার জন্য অর্থ দিচ্ছেন না, আপনি আসলে আপনার ডেটা দিচ্ছেন।”

ফিল্ডিং আরও বলছেন, “মাইক্রোসফট বলছে তারা আপনাকে বিজ্ঞাপন দেখানোর জন্য আউটলুকের ইমেইলের কনটেন্টে নজর বুলায় না, কিন্তু বিজ্ঞাপনের লক্ষ্যে নিজেদের সেবা জুড়ে ব্যবহারকারী কার্যক্রমের বেলায় মেটাডেটা সংগ্রহ করে ও ব্যবহার করে।”

অন্যদিকে আবার ইয়েন বলছেন, “আউটলুক এবং ইয়াহু তাদের প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি ডেটা সংগ্রহ করে, তারপরও তারা জিমেইলের মতো অবস্থান ডেটা এবং কেনাকাটার হিস্ট্রি সংগ্রহ করা পর্যন্ত যায় না।”

গোপনতা বিশেষজ্ঞরা প্রায়ই বলে থাকেন, যদি আপনাকে পণ্যের জন্য অর্থ না দিতে হয়, তাহলে আপনিই পণ্য। গুগলের বেলায় এ উক্তিটিকে “অকাট্য সত্য” হিসেবেই দেখছেন ইয়েন। “গুগলের ব্যবসায়িক মডেলটিই ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে সংগৃহীত ডেটাকে অর্থকরণের উপর নির্ভরশীল, প্রধানত গুগলের আসল গ্রাহক -বিজ্ঞাপনদাতার কাছে বিক্রির জন্য...জিমেইল ওই ডেটা সংগ্রহ কাঠামোর একটি অংশ তৈরি করছে।”

যুক্তরাষ্ট্র-নির্ভর গোপনতা সমর্থক ‘ইলেকট্রনিক ফ্রন্টিয়ার ফাউন্ডেশনে’র প্রযুক্তি প্রকল্পের পরিচালক জন ক্যালাসের মতামত আবার ভিন্ন। তিনি গুগলের ডেটা সংগ্রহের ঘটনা স্বীকার করলেও বলছেন, সবচেয়ে আক্রমণাত্মক ট্র্যাকিং আসে ইমেইল বিপণনকারীদের কাছ থেকে, সেবাদাতার কাছ থেকে নয়। “এখানে, গুগল বিশ্বের অন্যতম বড় বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান, আপনি যে ইমেইল সেবাই ব্যবহার করুন না কেন এটি নিবিড়ভাবে জড়িত।”

এ ধরনের ইমেইল – পণ্য ও সেবার ব্যাপারে ব্যবসার প্রচারণা – প্রেরকের মাধ্যমে নজরে রাখা সম্ভব, তা আপনি জেনে সাইন আপ করুন আর না করুন। আপনি ইমেইল খুলেছেন কি না, কতক্ষণের জন্য করেছেন এবং কোন লিংকে ক্লিক করেছেন সেগুলো সহ ডেটা ইমেইল বিপণণকারীর কাছে পাঠানো হয়।”

ক্যালাস ব্যাখ্যা করেছেন, “আপনি যখন দূর থেকে ছবি লোড করেন, যারা আপনাকে ইমেইলটি পাঠিয়েছেন তারা জানতে পারে যে আপনি বার্তাটি পড়েছেন, কোন সময়টিতে আপনি পড়েছেন এবং আপনি আনুমানিক কোথায় রয়েছেন তা চলে আসে আপনার নেটওয়ার্ক অ্যাড্রেসের বরাতে।”

অনেক সময় এ ধরনের “ছবি”তে একটি মাত্র পিক্সেল থাকে এবং এটি খালি চোখে দেখা যায় না। ক্যালাস জানিয়েছেন, এ ধরনের চুপিসারের ট্র্যাকিংয়ের বিরুদ্ধে সুরক্ষা নেওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো নিজ ইমেইলকে এমনভাবে ঠিক করে রাখা, যাতে এটি নিজে থেকে ছবি বা দূরের কোনো কনটেন্ট খুলতে না পারে।

হয় জিমেইল লকডাউন রাখুন, বা কোনো গোপনতা-নির্ভর বিকল্প খুঁজে নিন

গোপনতা সমর্থকদের মতে, জিমেইল এবং অন্যান্য সেবার সমস্যা হলো এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন না থাকা। এই মানের নিরাপত্তা সুরক্ষা নিরাপদ মেসেজিং অ্যাপ সিগনাল বা হোয়াটসঅ্যাপে রয়েছে, নিরাপদ ইমেইল সেবা প্রটোনমেইল এবং হাশমেইলেরও রয়েছে। এতে করে কেউ ব্যবহারকারীর ইমেইলের কনটেন্টে প্রবেশ করতে পারে না, এমনকি সেবাদাতাও না। এটি ব্যবহারকারীকে নিশ্চয়তাও দেয় যে তার ডেটা ইমেইল সেবাদাতারা বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে বিক্রি করতে পারবে না।

কিন্তু এ সুরক্ষা ও গোপনতা মাত্রা পাওয়ার জন্য জিমেইলের সুবিধা ছাড়তে হবে ব্যবহারকারীদের। কারণ নিরাপদ ইমেইল সেবাদাতারা সুরক্ষা ও গোপনতা দিলেও গুগল ক্যালেন্ডার এবং অন্য অ্যাপের সঙ্গে তাল মেলানো সেবা দিরতে পারেন না ব্যবহারকারীদের।

কিছু বিশেষজ্ঞ আবার প্রশ্ন তুলেছেন এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন ইমেইলের জন্য আদৌ জরুরি কি না সে বিষয়টি নিয়ে। তাদের মতে, ব্যক্তিগত ও সুবিধাজনক কথাবার্তার জন্য সিগনাল ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো অ্যাপই তো রয়েছে। এদিকে, আবার ক্যালাস বলছেন, “প্রটোনমেইল সেবা এনক্রিপ্টেড, কিন্তু এটি কার্যকর হওয়ার জন্য দুই পাশেরই এনক্রিপ্টেড মেইল ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে।”

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি জিমেইল বাদ দেবেন কি না? যদি উপরে আলোচিত বিষয়গুলো আপনার কাছে ঘোলাটে এবং সমস্যাপূর্ণ মনে হয়, তাহলে প্রটোনমেইলের মতো নিরাপদ ইমেইল সেবা ব্যবহারের ব্যাপারে ভাবতে পারেন, তবে সেক্ষেত্রে আপনার প্রাপকদেরও একইভাবে সুরক্ষিত সেবা ব্যবহার করতে হবে। আর না-হয় সিগনালের সেবা ব্যবহার করতে পারেন, এটি দুই পাশেই আপনার যোগাযোগকে এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপ্টেড রাখবে।

গুগলের ডেটা হাতানোর অভ্যাস যদি পছন্দ না হয়, সেক্ষেত্রে তাদের গোপনতা চেকআপে গিয়ে নিজ মতামত পাল্টে নিতে পারেন। এটি পর্যালোচনার মাধ্যমে চাইলে আপনার বহু ডেটা নেওয়া ঠেকাতে পারবেন। ফিল্ডিংয়ের পরামর্শ হচ্ছে, অন্যান্য গুগল সেবার অনলাইন ট্র্যাকার ব্লক করতে ‘প্রাইভেসি ব্যাজার’ বা ‘ঘোস্টারি’র মতো টুল ব্যবহার করুন।

যদি আপনার আইফোন থেকে থাকে, তাহলে গুগলের অ্যাপ এড়িয়ে অ্যাপলের নিজস্ব মেইল ক্লায়েন্ট ব্যবহার করতে পারেন বা আপনার ইমেইল সাফারি ব্রাউজারে খুলতে পারেন।

এতে অবশ্য একই মাত্রার সুবিধা পাবেন না। এ প্রসঙ্গে ফিল্ডিং বলেছেন, “অ্যাপল মেইল ব্যবহার করা জিমেইল অ্যাপ ব্যবহারের চেয়ে ভালো, কারণ অ্যাপলের ব্যবসা মডেল গুগলের মতো ডেটা ও বিজ্ঞাপন প্রযুক্তি উপর নির্ভর করে না।