কোভিড - ১৯: টেলিমেডিসিনের মূলধারায় আসার সুযোগ?

প্রায় দুই দশক ধরে প্রচলিত রয়েছে টেলিমেডিসিন। এই দীর্ঘ সময়ে মানুষের মধ্যে এই সেবা গ্রহণ তেমন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়েনি। করোনাভাইরাস মহামারী সম্ভবত এ বিষয়টিকে আমূল পাল্টে দেবে।

আজরাফ আল মূতীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 May 2020, 05:03 PM
Updated : 3 May 2020, 05:03 PM

বর্তমান পরিস্থিতিতে লাখো মানুষ ঘরে আটকে রয়েছেন, দুঃশ্চিন্তা করছেন প্রাণঘাতী ভাইরাসের ব্যাপারে। অনেকেই এ সময়টিতে পরামর্শ পেতে দ্বারস্থ হচ্ছেন টেলিমেডিসিন প্রতিষ্ঠানের ভার্চুয়াল পরামর্শদাতার কাছে।

ইউএস সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের দেওয়া তথ্য অনুসারে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত অধিকাংশেরই হালকা উপসর্গ রয়েছে এবং বাড়ি থেকে বাইরে না বের হয়েই তা সারিয়ে নেওয়া সম্ভব। বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেবেন নাকি হাসপাতালে, সে প্রশ্নের জবাব দিতে এগিয়ে আসছে টেলিমেডিসিন প্রতিষ্ঠানগুলো। উপসর্গ শুনে দূর থেকেই জানিয়ে দিচ্ছে কোথায় থাকলে ভালো হবে।  -- এ নিয়ে নিবন্ধ প্রকাশ করেছে সংবাদমাধ্যম সিএনএন।

আলেক্সান্দ্রিয়া নির্ভর ভার্চুয়াল স্বাস্থ্য প্ল্যাটফর্ম কেয়ারক্লিক্সের বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে দুই কোটিরও বেশি সেবাগ্রহীতা রয়েছেন। মার্চ মাস থেকে সেবা দেওয়ার হার আগের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে বলেও জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রায় একই চিত্র আরেক টেলিমেডিসিন প্রতিষ্ঠান জিপনোসিসের বেলায়-ও দেখা গেছে। গত মাসে ১১ দিন সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে মানুষের আনাগোনা বেড়েছে তিন হাজার ৬০০ শতাংশ।

“দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এটি বেশ অস্বাভাবিক ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে হয়েছে, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এটি শিল্পের ঘুরে দাঁড়ানোর মুহূর্ত”। - বলেছেন জিপনোসিসের প্রধান নির্বাহী জন পিয়ার্স। “গত কয়েক সপ্তাহে কোভিড - ১৯'র প্রকপে আমার মনে হয় মানুষের চিকিৎসা সেবাদাতার কাছ থেকে বিশ্বস্ত উপদেশ পেতে চাওয়ার সংখ্যা অনেক বেড়েছে … এবং আমরা ওই সেবাটিই খুব দ্রুততার সঙ্গে দিতে পারছি। আরও সহজভাবে বললে, আমরা আপনার বাড়িতেই সেবা দিতে পারছি”।

দুটি প্রতিষ্ঠানই অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন পন্থায় টেলিমেডিসিন সেবা দিয়ে থাকে।

কেয়ারক্লিক্স প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২০১২ সালে। রোগীদেরকে ‘অন-ডিমান্ড ভিডিও প্ল্যাটফর্মে’ ডাক্তারদের সঙ্গে সংযুক্ত করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি, ভার্চুয়াল পরিবেশে সামনে বসে পরামর্শ নেওয়ার অভিজ্ঞতা দেওয়া চেষ্টা করে রোগীদেরকে – অনেকটা ডাক্তারের সঙ্গে ফেইস টাইমে চ্যাটিংয়ের মতো সেবা।

“ইটপাথরে স্থাপনায় যা হয়, আমরা সেটাই অনুকরণের চেষ্টা করি আসলে” – বলেছেন কেয়ারক্লিক্স সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী করাঙ্গি। “ব্যবহারকারীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রোগী …. এবং ডাক্তারের জন্য, তারা ভিন্ন এমন কিছুই করছে না যা আপনি সশরীরে এলে এবং সামনা-সামনি বললে হবে না। শুধু একটি জিনিসই আলাদা, তা হলো এখন আমাদের মধ্যে একটি মনিটর থাকে”।

যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে হাসপাতাল নেটওয়ার্ক এবং স্বাস্থ্য সেবাদাতারা কেয়ারক্লিক্সের প্রযুক্তি ব্যবহার করে। এ ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব আভ্যন্তরীন ডাক্তারদের টিম রয়েছে, যারা দূর থেকে রোগীদের সেবা দিতে পারেন।

অন্যদিকে, জিপনোসিস সেবা দেয় অ্যাসিংক্রোনাস বা অসমনিয়ত প্রক্রিয়ায় – যেখানে ডাক্তার এবং রোগীর একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে থাকার দরকার নেই (এমনকি ভার্চুয়াল হিসেবেও না)। প্রায় এক দশক আগে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহকরা চ্যাটবটের মতো একটি টুলের সাহায্যে একটি ভার্চুয়াল প্রশ্নউত্তর সম্পন্ন করে। পরে তা পর্যালোচনা করে পরামর্শ জানান ডাক্তার। জিপনোসিসের দাবি, পুরো প্রক্রিয়াটির এভাবে গতি নাটকীয় হারে বেড়ে যায়, ডাক্তাররা গড়ে ৮৯ সেকেন্ডে সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। 

“ডাক্তারের সঙ্গে ভিডিও-তে কথা বলার বদলে আপনি ধারাবাহিক কিছু হ্যাঁ বা না প্রশ্নের জবাব দেবেন” – বলেছেন পিয়ার্স। “বাস্তব জীবনেও আপনাকে ওই একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হতো, আমরা তা করার বদলে বেশ স্মার্ট একটি কম্পিউটার সিস্টেম ব্যবহার করছি”।

টেলিমেডিসিনের নিজস্ব কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে – কিছু জটিল পরীক্ষানিরীক্ষা এবং চিকিৎসার জন্য সামনাসামনি সাক্ষাতে যাওয়ার দরকার হবে। যদি কোনো রোগী গুরুতর অসুস্থ বা জটিল পরিস্থিতিতে থাকেন, টেলিমেডিসিন প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ক্লিনিক বা হাসপাতালে যেতে বলে। তবে, এই প্রযুক্তি প্রাথমিক কিছু ঝামেলা কমিয়ে দিতে পারে। বিশেষ করে এ সময়টিতে, যখন বৈশ্বিক মহামারীর কারণে স্বাস্থ্যসেবা সেক্টরটিই চাপের মধ্যে রয়েছে এবং ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আতঙ্কে রয়েছেন মানুষ।

“আদতে মানুষ উদ্বিগ্ন” – বলেছেন আমেরিকান টেলিমেডিসিন অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী অ্যান মন্ড জনসন। আমেরিকান টেলিমেডিসিন অ্যাসোসিয়েশন একটি অলাভজনক সংস্থা যা ভার্চুয়াল স্বাস্থ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে কাজ করছে। “মানুষ জানেন না কী করতে হবে, কোথায় যেতে হবে, আদৌ ভাইরাসের জন্য পরীক্ষা করানো প্রয়োজন কি না। পাশাপাশি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে হাসপাতালগুলো গভীরভাবে উদ্বিগ্ন”।

বিনামূল্যে কোভিড-১৯ সম্পর্কিত মূল্যায়ন করে দেওয়া শুরু করেছে কেয়ারক্লিক্স। এদিকে, ৪০ শতাংশেরও বেশি স্বাস্থ্য সেবাদাতা জিপনোসিসের প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন, কারণ ‘ফ্রি স্ক্রিনিং’ সুবিধাও দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

জনসন বলছেন, টেলিমেডিসিনের ধারণা প্রায় ২৫ বছর ধরে প্রচলিত হলেও রোগী এবং ডাক্তাররা মহামারী শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত সেবাটির ব্যবহার তেমনভাবে শুরু করেননি। মানসিক বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে যা ভেঙে ফেলতে হবে।

“সত্যের খাতিরে বিচার করলে, আপনারা সবাই জানেন যে ছুঁয়ে দেখা ছাড়াই চিকিৎসক বা একজন ক্লিনিশিয়ান অনেক সময়ই অনেক সেবা দিয়ে থাকেন। ‘দ্বিতীয় শ্রেণির মেডিসিন’ এই কাল্পনিক ধারণা ঝেড়ে ফেলাটাও একটি অংশ”। - বলেছেন জনসন।

করোনাভাইরাস আসার কারণে অস্বাভাবিক এই পরিস্থিতিতে যে শিল্পের ঘুরে দাঁড়ানোর মতো সময়টির সৃষ্টি হয়েছে তা সংকট পার হয়ে গেলেও থাকবে বলে আশা করছে টেলিমেডিসিন প্রতিষ্ঠানগুলো।

জিপনোসিসের প্রধান নির্বাহী পিয়ার্স বলেছেন “এই শিল্পের অনেক দিনের ইচ্ছা যে আমরা এই টেলিমেডিসিন বা ভার্চুয়াল সেবা নিয়ে কথা বলা থামাবো এবং এটি স্বাস্থ্যসেবায় পরিণত হবে। এবং আমরা মনে হয় এটি ওই মোড় ঘুড়িয়ে দেওয়া সময়”।