জীবন যেখানে বাঁধা কিউআর কোডে

ভাবুন একবার: বাসা থেকে বেরিয়ে আপনি হয়ত যাবেন অফিসে, বাজারে বা রেস্তোরাঁয়; কিন্তু যেতে পারবেন তখনই, যদি আপনার মোবাইলে থাকা একটি বিশেষ অ্যাপ সবুজ সংকেত দেয়। সেই অ্যাপ লাল বা হলুদ হলে আটকে যাবেন আপনি।

আইরিন সুলতানা নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 April 2020, 03:59 AM
Updated : 20 April 2020, 04:52 AM

হ্যাঁ, করোনাভাইরাস সঙ্কটের প্রথম ধাক্কা পেরিয়ে এসে চীনের কোটি কোটি মানুষকে এখন চলতে হচ্ছে অ্যাপের রঙ মেনে। এই ব্যবস্থা হয়ত বহুদিন চলবে, অন্তত যতদিন না ভাইরাসের আতঙ্ক থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসা যায়। 

সিএনএনের এক প্রতিবেদন বলছে, মোবাইল প্রযুক্তি আর বিগ ডেটা ব্যবহার করে বানানো  ‘হেলথ কোড’ নামের এই অ্যাপ দিয়ে নাগরিকদের প্রতিটি পদক্ষেপে নজর রাখছে চীন সরকার।

স্বাস্থ্য পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ হচ্ছে রঙভিত্তক কুইক রেসপন্স কোর্ড, যাকে সংক্ষেপে কিউআর কোড বলে। সেই রঙই ঠিক করে দিচ্ছে, তার চলাফেরার স্বাধীনতা হবে কতটুকু।

চীন সরকার ঘোষণা দিয়ে এই অ্যাপ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেনি। কিন্তু অনেক শহরে মোবাইলে ওই অ্যাপ না থাকলে নাগরিকরা বাড়ি থেকে বের হতে পারছেন না, অথবা পাবলিক প্লেসে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।  

চীনে করোনাভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে আসার পর এখন লকডাউন উঠেছে। কিন্তু ফের ভাইরাস ছড়ানো ঠেকাতে শুরু হয়েছে কিউআর কোডের শাসন। রাশিয়াও ইতোমধ্যে অ্যাপের মাধ্যমে চলাফেরায় নজরদারি শুরু করেছে, একই পরিকল্পনা করছে জাপানও। 

চীনের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলিবাবার স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞ জিয়ান-শেং ‍হুয়ার ভাষায়, ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে পারা ‘খুবই জরুরি’। আর সে কারণেই অ্যাপ।

কীভাবে কাজ করে চীনের অ্যাপ?

আলিবাবা ও টেনসেন্টের সহায়তা নিয়ে আর্থিক লেনদেনের অ্যাপ আলিপে ও মেসেজিং অ্যাপ উইচ্যাট ব্যবহার করে ‘হেলথ কোড’ অ্যাপটি চালু করেছে চীন।  গত ১১ ফেব্রুয়ারি জেজ্যাং প্রদেশের হ্যাংজু শহরে প্রথম এর ব্যবহার শুরু হয়।

অ্যাপ চালু করার পর নাম, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর অথবা পাসপোর্ট নম্বর, ফোন নম্বর দিয়ে নিবন্ধন করতে হয়। এরপর ব্যবহারকারীর গত ১৪ দিনের স্বাস্থ্যগত তথ্য জেনে নেওয়া হয় কয়েকটি প্রশ্ন করে। যেমন তিনি আক্রান্ত বা সন্দেহভাজন কারো সংস্পর্শে এসেছিলেন কি না, কোথাও বেড়াতে গিয়েছিলেন কি না।

জ্বর, শুকনো কাশি, সর্দি, গলা ব্যথা, ডায়রিয়ার মত উপসর্গ থাকলে অ্যাপের নির্দিষ্ট ঘরে টিক দিতে হয়। সব তথ্য যাচাই করে প্রত্যেককে একটি কিউআর কোড দেওয়া হয়। এর রঙ হয় লাল, হলুদ বা সবুজ।

লাল কোডধারীকে অবশ্যই ১৪ দিন সরকারি ব্যবস্থাপনায় অথবা নিজের ঘরে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। হলুদ কোডে কোয়ারেন্টিনের মেয়াদ সাত দিন। আর যার কোড সবুজ, তিনি শহরে চলাফেরা করতে পারবেন।

তবে সবুজ কোডধারীর গতিবিধিও অ্যাপের মাধ্যমে নজরদারিতে থাকবে। কোনো সময় তার মধ্যে সংক্রমণ ঘটলে ওই অ্যাপ বলে দেবে গত কয়েকদিনে তিনি কোথায় গিয়েছেন, কাদের সংস্পর্শে এসেছেন, তাদের মধ্যে কেউ কোভিড-১৯ পজিটিভ ছিলেন কি না।

আলিপের এই অ্যাপের বিষয়ে জানেন এমন একজন সিএনএনকে বলেছেন, আসলে চীন সরকারই অ্যাপটি বানিয়েছে, পরিচালনাও তারাই করছে। আলিপে শুধু তাদের প্লাটফর্ম ব্যবহার ও কারিগরি সুবিধা দিচ্ছে।

চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম সিনহুয়া আর সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ডেইলির বরাতে সিএনএন জানিয়েছে, চালু হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে একশর বেশি শহরে হেলথ কোড’ ব্যবহার শুরু হয়। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে সেই সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে যায়। টেনসেন্টের হেলথ কোড অ্যাপটিও গত মার্চ পর্যন্ত তিনশর বেশি শহরে চালু হয়ে যায়।

মার্চের প্রথম দিন রাজধানী বেইজিংয়ে আলিপে ও উইচ্যাট প্লাটফর্মের তিন রঙের কিউআর কোড অ্যাপটি চালু হয়। এই অ্যাপে স্বাস্থ্য তথ্যের সঙ্গে ফেশিয়াল রিগকনিশনও লাগে।

চীনে যাদের কোভিড-১৯ ধরা পড়েছে, যারা সন্দেহভাজন অথবা যাদের জ্বর রয়েছে- তাদের সবার তথ্য প্রতিটি রাজ্যের ডেটাবেইজে সংরক্ষণ করা আছে। এই ডেটাবেজে যাদের কোভিড-১৯ সংশ্লিষ্ট তথ্য নেই, তারা ঘোরাফেরার ছাড়পত্র পাচ্ছেন।

হুবেই ও উহানের বাসিন্দা অথবা পর্যটকদের এই শহর ছেড়ে যেতে হলে একটি সবুজ কিউআর কোড অর্জন করতে হবে তাদের মোবাইল ফোনের অ্যাপে।

 

কতটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে এই চীনা অ্যাপ?

হ্যাংঝু শহরে অনেক বাসিন্দাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলেছেন, নিবন্ধনের সময় ক্লান্তি ও নাকবন্ধ থাকার মত তথ্য দিয়ে তাদের ভাগ্যে লাল রঙের কিউআর কোড জুটেছে।

আবার এক শহরের অ্যাপের কিউআর কোড আরেক শহর যাচাই করতে পারছে না। চীনে প্রতি রাজ্যে কোভিড-১৯ ডেটাবেইজ তাদের নিজেদের মত করে করা হয়েছে। এমনকি ব্যক্তির স্বাস্থ্য পরিস্থিতি বোঝাতে রঙের নির্দেশনাও সব রাজ্যে এক রকম নয়। 

লকডাউন উঠে যাওয়ার পর হুবেইয়ের বাসিন্দা ইউয়ান কর্মস্থলে যোগ দিতে গুইজু শহরে ফিরেছেন মার্চের শেষে। সেখানে তাকে আবার ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়। অথচ হুবেইয়ে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে থেকে তিনি সবুজ কিউআর কোড পেয়েছিলেন।   

এসব জটিলতা কাটানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের কর্মকর্তা মাও কুনান সিএনএনকে বলেন, জাতীয় পর্যায়ে চালু করা হয়েছে ‘মহামারী প্রতিরক্ষা কোড’। কোভিড-১৯ শনাক্ত হওয়া ও সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের নিয়ে কেন্দ্রীয় ডেটাবেইজ করা হয়েছে, যাতে বিভিন্ন রাজ্যের অ্যাপে কিউআর কোড সহজে যাচাই করা যায়।  

ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা থাকবে?

মাইক্রোব্লগিং সাইট উইবো ব্যবহারকারী হান ডনজিয়ান সিএনএনকে বলেন, “আমাদের ব্যক্তিগত তথ্যগুলো ফাঁস হয়ে যাবে কি না, তথ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা হচ্ছে কি না, এটাই আমার উদ্বেগের জায়গা।”  

চায়নিজ ইউনিভার্সিটি অব পলিটিক্যাল স্টাডিজ অ্যান্ড ল- এর শিক্ষক জু ওয়েই বলছেন, এই হেলথ কোড চীনের ইন্টারন্টে নিরাপত্তা আইন মেনেই করা হয়েছে।

তবে মহামারী শেষ হলে এই সব তথ্য তখনও সংরক্ষণ করে রাখা হবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন হংকং ব্যাপটিস্ট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ জেসন লাউ ।  

তিনি বলেন, “মহামারী শেষ হয়েছে কি না তা কীভাবে আমরা নির্ধারণ করব? সরকার এবং যে প্রতিষ্ঠানগুলো এই তথ্য নিচ্ছে, তাদের মধ্যে কে এসে বলবে যে- মহামারী শেষ হয়েছে, ব্যক্তিগত তথ্য আর রাখার দরকার নেই, সব মুছে দাও?’”

হ্যাংজু শহরে এখন রেল স্টেশন, শপিং মল ব হোটেলের মত জনসমাগম স্থলে আর হেলথ কোড দেখাতে হচ্ছে না কাউকে।

তবে বেইজিং, সাংহাই শহরে লাল, হলুদ ও সবুজ রঙের চৌকোনা বার কোডটি এখনও মানুষের গতিবিধির নিয়ন্ত্রক।

আরও পড়ুন