ভুয়া খবর কীভাবে আটকাবে ফেইসবুক?

ফেইসবুকের নিউজ ফিডে ভুয়া খবরের দৌরাত্ম‌্য ঠেকাতে উদ‌্যোগী হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জনপ্রিয় এ সামাজিক যোগাযোগ মাধ‌্যমের প্রধান মার্ক জাকারবার্গ। তিনি কতটা কী করতে পারবেন- সেই উত্তর খুঁজেছে বিবিসি।  

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Nov 2016, 03:26 AM
Updated : 19 Nov 2016, 04:08 AM

সম্প্রতি এক পোস্টে জাকারবার্গ জানিয়েছেন, ফেইসবুককে তিনি সত্যমিথ‌্যার বিচারক বানাতে চান না, তবে তার কোম্পানি ধাপ্পাবাজির হাত থেকে ব্যবহারকারীদের মুক্তি দিতে একটি হাতিয়ার খুঁজছে।

সমস‌্যাটা কোথায়?

ফেইসবুক যে অ্যালগরিদম নিয়ে কাজ করে, তাতে প্রাধান্য পায় জনপ্রিয় বিষয়গুলো। ব্যবহারকারী তার বন্ধুদের শেয়ার করা খবরের পোস্টগুলোও সরাসরি নিউজ ফিডে দেখতে পায়।

বন্ধুরা ‘লাইক’ দিয়েছেন- এমন খবরও কখনও কখনও ফেইসবুকের অ্যালগরিদম স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিউজ ফিডে হাজির করে।

প্রযুক্তি বিষয়ক লেখক ও বিশ্লেষক কেট বেভান বিবিসিকে বলেন, কোনটা সত্য আর কোনটা নয়- তার পার্থক্য করতে পারে না ফেইসবুক অ‌্যালগরিদম।

“পোস্টে আসা পেইজের মান দেখা এর কাজ নয়। কোনো কিছু যুক্তিগ্রাহ‌্য মনে হলে, আর মানুষ যদি সেটা শেয়ার করে, তাহলেই ফেইসবুকের কাছে সেটা গুরুত্ব পায়।”

আসলে একটা হেডলাইন আর ছবি নিয়ে কোনো পোস্ট যখন ফেইসবুকের নিউজ ফিডে আসে, অনেক ক্ষেত্রেই বাইরে থেকে বোঝার উপায় থাকে না যে সেটি বানোয়াট। না খোলা পর্যন্ত সেটি দেখতে বিশ্বস্ত সংবাদ মাধ্যমগুলোর সত্যিকারের খবরের মতই মনে হয়।

‘ফ‌্যাক্ট চেক’ এর কোনো ব‌্যবস্থা ফেইসবুকে নেই।

‘নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্ম পাকিস্তানে!’ কিংবা ‘ইয়োকো ওনো: হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল’ এরকমই কয়েকটি নমুনা।

ব্যবহারকারীরা অনেক সময় না পড়েই লাইক দেন। আর লাইক দেওয়ামাত্র এসব খবর চলে যায় তার বন্ধুদের ফিডে; শেয়ার করলে তো কথাই নেই। এভাবেই ভুয়া খবর ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।

সত‌্যিকারের নিউজ ফিডের চেয়ে বানোয়াট পোস্ট বেশি বাজার পায়। ফেইসবুকের অ্যালগরিদম ‘ট্রেন্ডিং স্টোরিজ’ বিভাগ এরকম ধাপ্পাবাজির বিস্তার আটকাতে পারে না। এমনকি ফেইসবুকের ‘লাইভ ভিডিও টুল’ও মাঝে মাঝেই ব্যবহৃত হচ্ছে ভুয়া সম্প্রচারে।

বেভান বলছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যাপারটা নতুন হলেও এর প্রভাব অসামান্য।

“মানুষ কর্তৃপক্ষে বিশ্বাস করে। আর সেই ছদ্মবেশ নিয়েই ভুয়া খবরগুলো হাজির হয়। সেগুলো দেখতে নিয়মসিদ্ধই মনে হয়, মানুষ সেগুলো পড়ে এবং বিশ্বাস করে। এরপর নিশ্চিতভাবেই তার চিন্তায় প্রভাব পড়ে।”

জাকারবার্গ বলছেন, ফেইসবুক জুড়ে থাকা এ ধরনের ধাপ্পাবজির পোস্ট সংখ‌্যায় ‘১ শতাংশেরও কম’।

এর মধ‌্যে ‘মেমে’ও (যেমন রাজনীতিবিদদের ছবি ও মন্তব্যজুড়ে যেসব পোস্ট দেওয়া হয়) ধরা হয়েছে কি না- সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

জাকারবার্গ বলছেন, একজন ব‌্যবহারকারী কোন ধরনের পেইজ ফলো করেন এবং কারা তার বন্ধু- সে বিষয়টিও তার ফিডে ভুয়া খবরের আধিক‌্যের কারণ হতে পারে।

এ পরিস্থিতি সামাল দিতে গুগল নিউজের ‘ফ্যাক্ট চেক’ সেবা সোশাল নেটওয়ার্কগুলোর জন‌্য উদাহরণ হতে পারে। গত অক্টোবরে গুগলের চালু করা এই সেবার মাদ‌্যমে ব‌্যবহারকারীরা সন্দেহজনক স্টোরি বিশ্বাসযোগ্য ওয়েবসাইটের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার সুযোগ পান।

ফেইসবুক লাইভে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে স্পেসওয়াকের পুরনো ডিডিও

ভুয়া খবর ও ধাপ্পাবাজির পোস্ট সামলাতে এর আগে ফেইসবুক কর্তৃপক্ষ তাদের ট্রেন্ডিং স্টোরিজ বিভাগ সম্পাদনা করার জন্য বেশ কয়েকজনকে দায়িত্ব দিয়েছিল।

কিন্তু সেই ‘মানব সম্পাদক’দের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী প্রচারের সময় পক্ষপাতের অভিযোগ উঠলে তাদের ছেঁটে ফেলে আবারও অ্যালগরিদমের ওপর দায়িত্ব চাপায় ফেইসবুক।

জাকারবার্গ বলছেন, ব‌্যবহারকারীরা ভুয়া খবর শনাক্ত করতে পারলে যাতে অন‌্যদের সতর্ক করতে পারেন, তার একটি উপায় খোঁজা হচ্ছে। একইসঙ্গে তিনি সতর্ক করেছেন, এ ধরনের টুলস চালু হলে তা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেও ব‌্যবহৃত হতে পারে।

আর বেভান বলছেন, নতুন টুলস ফেইসবুককে ‘প্রামাণ‌্য সূত্র’ নির্ধারণ নিয়েও সমস্যায় ফেলতে পারে।

ফেইসবুকের অ্যালগরিদম হয়তো ফাইনানশিয়াল টাইমস বা ওয়াশিংটন পোস্টের মত খ্যাতিমান প্রামাণ্য সূত্রগুলোকে প্রাধান্য দিতে পারে। কিন্তু প্রামাণ্য কর্তৃপক্ষ কীভাবে নির্ধারিত হবে, সেই প্রশ্ন তখন উঠতে পারে।

পক্ষপাতের অভিযোগ এড়িয়ে এ কাজ করতে গেলে ফেইসবুককে কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে বলেই মনে করছেন বেভান।

কেউ কেউ বলছেন, যতদিন না ফেইসবুক কর্তৃপক্ষ নিজেদের আধুনিক সময়ের সংবাদ প্রকাশক হিসেবে মেনে নিতে প্রস্তুত হচ্ছে, ভুয়া খবরের এই দৌরাত্ম তারা কমাতে পারবে না।

এদেরই একজন দ্য নেক্সট ওয়েবের ম্যাট নাভারা। জাকারবার্গের ওই পোস্টের মন্তব‌্যে তিনি লিখেছেন, “ফেইসবুকের ক্ষমতা ও প্রভাব আপনাকে স্বীকার করে নিতে হবে এবং ভুয়া খবরের বিষয়টি সামলানোর দায়িত্ব স্বাধীন সম্পাদকদের উপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত।”

উত্তরে জাকারবার্গ লিখেছেন, ফেইসবুকের কাছে মানুষ যা চায়, তার মধ‌্যে সংবাদ মুখ‌্য নয়।

“তাই কেউ যখন ফেইসবুককে মিডিয়া কোম্পানি ঘোষণা করার পরামর্শ দেয়, তখন বেখাপ্পা লাগে। সবার জন্য ইন্টারনেট নিশ্চিত করতে আমরা সত‌্যিই উড়োজাহাজ বানানোর পরিকল্পনাকে গুরুত্ব দিচ্ছি, কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা নিজেদের এরোস্পেস কোম্পানি বলব।”

জাকারবার্গের সঙ্গে একমত নন কেট বেভানও। বিবিসিকে এ প্রযুক্তি লেখক বলেছেন, খবরের পোস্ট প্রকাশ করতে গিয়ে যে দায়িত্ব এসে চেপেছে, তা এড়াতে চাইছে ফেইসবুক। 

“এ মুহূর্তে ফেইসবুক এই গ্রহের অন‌্যতম বড় প্রকাশক, এবং এ কারণে দায়িত্বের প্রশ্ন এসেই যায়।”

খবর থেকে ফেইসবুক যেহেতু লাভবান হচ্ছে, সেহেতু এখন তাদের ভূমিকা প্রকাশকের মতই হওয়া উচিৎ বলে মনে করেন বেভান।

“তবে তারা এটা করতে চায় না। কারণ এতে খরচ অনেক, সেই সঙ্গে আছে নতুন চক্করে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা।”