ইউরোপিয়ান কমিশনকে জবাব দিলেন কুক

ইউরোপিয়ান কমিশন-এর আদেশের পর বিবৃতি দিয়েছেন অ্যাপল প্রধান টিম কুক।

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 August 2016, 01:39 PM
Updated : 31 August 2016, 01:39 PM

চলতি মাসের শেষ মঙ্গলবার কর মামলায় মার্কিন টেক জায়ান্ট অ্যাপলকে ১৩০০ কোটি ইউরো পরিশোধের আদেশ দেয় ইউরোপিয়ান কমিশন। এরই প্রেক্ষিতে অ্যাপলের ওয়েবসাইটে প্রতিষ্ঠান প্রধান টিম কুক-এর একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়।

বিবৃতিতে ইউরোপিয়ান কমিশনের সিদ্ধান্ত কেন ‘ভুল’ সেটি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে অ্যাপল। কুক যে বিষয়টি স্পষ্ট করতে চেয়েছেন সেটি হল- ইউরোপিয়ান কমিশন ইউরোপের আইন আয়ারল্যান্ডের ওপর ‘চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে।’

আরও যে বিষয়টি কুক বলার চেষ্টা করেছেন সেটি হল, অ্যাপল কর দেয় এবং আয়ারল্যান্ড কৃর্তৃপক্ষ কর নেয়। এর মধ্যে কোনো পক্ষই এ নিয়ে কোনো অভিযোগ না করলেও ইউরোপিয়ান কমিশন অনেকটা জবরদস্তিমূলকভাবেই নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে যা কর ইতিহাসে ‘নজিরবিহীন’।

এর বাইরে অ্যাপল আরও একটি যুক্তি এখানে তুলে ধরেছে যেটি এর আগে ২০১৩ সালের মে মাসে একই বিষয়ে মার্কিন সিনেট কমিটিতে দিয়েছিলেন টিম কুক। সে সময় তিনি বলেছিলেন, বর্তমান কর ব্যবস্থায় ‘আইনসম্মতভাবে’ যে সুবিধা গ্রহন করা সম্ভব সেগুলোই কেবল গ্রহন করছে অ্যাপল। এখন এই কর ব্যবস্থায় যদি কোনো দুর্বলতা থেকে থাকে সেটির সমাধান করা উচিৎ এবং করবিষয়ক নিয়মাবলী আরও সহজসরল করা উচিৎ। এ সরলীকরণের ফলে যদি অ্যাপলকে বর্তমানের তুলনায় বেশি কর দিতে হয়, অ্যাপল তাতেও রাজি আছে। সেই একই যুক্তি এবারও প্রচ্ছন্নভাবে দিয়েছেন টিম কুক।

আর যে যুক্তি অ্যাপল দেবে বলে বিবৃতি পড়ার আগেই চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়, সেটিও উল্লেখ করেছেন অ্যাপল প্রধান। “(আয়ারল্যান্ডে) আমরা কোনো বিশেষ সুবিধা কখনও চাইনি, এমনকি পাইওনি।”

কুক-এর বিবৃতি সম্পূর্ণ নিচে তুলে ধরা হল-

ছত্রিশ বছর আগে, আইফোন, আইপড এমনকি ম্যাক বানানোরও অনেক আগে স্টিভ জবস ইউরোপে অ্যাপলের প্রথম কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময়, প্রতিষ্ঠানটি জানত ইউরোপের গ্রাহকদের সেবা দিতে হলে, সেখানে তাদের একটি ভিত্তি প্রয়োজন হবে। এ কারণে, ১৯৮০ সালের অক্টোবরে অ্যাপল আয়ারল্যান্ডের কর্ক-এ ৬০ কন কর্মী নিয়ে একটি কারখানা চালু করে।

ওই সময়, কর্ক অনেক বেশি বেকারত্ব আর অত্যন্ত নিচুমানের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ সমস্যায় ভুগছিল। কিন্তু অ্যাপলের নেতৃত্ব এখানে মেধা দিয়ে ধনী একটি সম্প্রদায় দেখতে পান, আর প্রতিষ্ঠানটি যদি সফল হওয়ার মতো যথেষ্ট ভাগ্যবান হয় তবে সেখানে উন্নতি আনতে পারবেন- একটা সময় তারা এমনটাই বিশ্বাস করা শুরু করেন।

সে সময় থেকে আমরা কর্ক-এ কাজ অব্যাহত রেখেছি, এমনকি আমাদের ব্যবসায়ের অনিশ্চিত সময়েও; আর আজ আয়ারল্যান্ড জুড়ে আমাদের প্রায় ৬০০০ কর্মী করছে। এই কর্মীদের একটা বিশাল অংশ এখনও কর্ক-এ, যাদের মধ্যে একদম প্রথমদিকের কিছু কর্মীও রয়েছেন, আর এখন অ্যাপলের বৈশ্বিক পদচিহ্নের অংশ হিসেবে বিস্তৃত বৈচিত্র্যের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অসংখ্য বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান অ্যাপলকে অনুসরণ করে কর্ক-এ বিনিয়োগ করেছে আর সেখানকার অর্থনীতি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী।

কর্ক-এ অ্যাপলের উন্নতিতে জ্বালানী হিসেবে কাজ করা সাফল্য, আমাদের গ্রাহকদের  উল্লসিত করা উদ্ভাবনী সব পণ্য থেকে এসেছে। পুরো ইউরোপ জুড়ে, অ্যাপলে ১৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থা তৈরি ও বজায় রাখতে এটি সহায়তা করেছে, অ্যাপ স্টোর-এর উপর নির্ভর করা কয়েক লাখ সৃজনশীল অ্যাপ ডেভেলাপারের কর্মসংস্থান করেছে। অসংখ্য ছোট আর মাঝারি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাপলের উপর নির্ভর করে, আর আমরা তাদের সমর্থন দিতে গর্ববোধ করি।

দায়িত্ববান কর্পোরেট সিটিজেন হিসেবে, আমরা ইউরোপজুড়ে স্থানীয় অর্থনীতিতে আর সম্প্রদায়গুলোতে আমাদের অবদান নিয়েও গর্বিত। বছরের বড় বছর আমাদের ব্যবসায় উন্নত হওয়ায়, আমরা আয়ারল্যান্ডে সর্বোচ্চ করদাতা, যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ করদাতা আর সারা বিশ্বেও সর্বোচ্চ করদাতায় পরিণত হয়েছি।

সময়ের সঙ্গে আমরা কীভাবে আইরিশ কর আইন মেনে চলতে হবে তা নিয়ে আইরিশ কর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্দেশনা পেয়েছি- একই রকম নির্দেশনা এখানে ব্যবসায় করা যে কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্যই প্রযোজ্য। আয়ারল্যান্ড আর আমাদের কার্যক্রম রয়েছে এমন প্রতিটি দেশে অ্যাপল আইন মেনে চলে আর আমরা আমাদের দেনা সব কর পরিশোধ করি।

ইউরোপিয়ান কমিশন ইউরোপে অ্যাপলের ইতিহাস নতুন করে লেখার একটি প্রচেষ্টা শুরু করেছে; আয়ারল্যান্ড-এর কর আইন এড়িয়ে এই প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক কর আইন আরোপ করেছে। ৩০ অগাস্ট করা অভিযোগে একটি মত দেওয়া হয়েছে যে, আয়ারল্যান্ড আমাদের করের উপর অ্যাপলকে একটি বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে। অথচ এই দাবির কোনো ভিত্তি বা আইন নেই। আমরা কোনো বিশেষ সুবিধা কখনও চাইনি, এমনকি পাইওনি। আমরা আমাদের এখন এমন একটা অবস্থায় দেখছি যে, আমাদের পরিশোধ করা করের চেয়ে আর বেশি পাওনা নেই বলে জানানো একটি সরকারকে বিশাল পরিমাণে বাড়তি কর দিতে আদেশ দেওয়া হয়েছে।

কমিশনের এমন পদক্ষেপ নজিরবিহীন আর এটি গুরত্বপূর্ণ, এর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এটি কার্যত কমিশন যেমনটা চায় তেমন আইনে আইরিশ কর আইন প্রতিস্থাপন করতে চাচ্ছে। এটি ইইউ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নিজেদের কর বিষয়ে একটি বিধ্বংসী আঘাত। আয়ারল্যান্ড কমিশন-এর এমন রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে আর অ্যাপলও একই কাজ করবে। আমরা আত্মবিশ্বাসী যে কমিশনের আদেশ ঘুরিয়ে নেওয়া হবে।

এর মূলে, কমিশনের মামলা অ্যাপল কত কর দিচ্ছে তা নিয়ে নয়। এটি হচ্ছে কোন সরকার অর্থ সংগ্রহ করছে সে বিষয়ে।

কর বিষয়ে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য জটিল, তারপরও সারাবিশ্বে একটি মৌলিক আদর্শ রয়েছে: একটি প্রতিষ্ঠানের লাভের উপর সে দেশেই কর ধার্য করা হবে যে দেশে এর হিসেব করা হয়। অ্যাপল, আয়ারল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবাই এই আদর্শের সঙ্গে একমত।

অ্যাপলের ক্ষেত্রে, আমাদের প্রায় সব গবেষণা আর উন্নয়ন ক্যালিফোর্নিয়ায় করা হয়, এ কারণে আমাদের অধিকাংশ লাভের উপর যুক্তরাষ্ট্রেই কর দেওয়া হয়। ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যারা যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসায় করছে তারাও এই একই আদর্শ মেনে কর দিচ্ছে। কিন্তু কমিশনটি এখন এই নীতিমালা ব্যাপকহারে বদলাতে বলছে।

স্পষ্টভাবে অ্যাপল-কে লক্ষ্য করা ছাড়াও, এই আদেশের সবচেয়ে গভীর ও ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে ইউরোপের বিনিয়োগ আর কর্মসংস্থান সৃষ্টি খাতে। কমিশনের তত্ত্ব ব্যবহার করে, আয়ারল্যান্ড আর ইউরোপের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান হঠাৎ এমন এক আইনে কর ঝুঁকির মুখে পড়বে যার কখনও অস্তিত্বই ছিল না।

সহজবোধ্যতা আর স্পষ্টতাকে লক্ষ্য রেখে অ্যাপল দীর্ঘসময় ধরে আন্তর্জাতিক কর ব্যবস্থা পুনর্গঠনে সমর্থন দিয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি এই পরিবর্তনগুলো সঠিক আইনি প্রক্রিয়ায় আনা উচিত, যে প্রক্রিয়ায় প্রভাবিত দেশগুলোর নেতা আর নাগরিকদের মধ্যে প্রস্তাব আর আলোচনা থাকবে। আর নতুন যে কোনো আইনের ক্ষেত্রেই তা সামনের দিকে নিতে নিতে বাস্তবায়িত করতে হয়, বিশালাকারে নয়।

আমরা আয়ারল্যান্ডের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ আর আমরা তদন্ত অব্যাহত রাখার, উন্নতি বজায় রাখার আর আমাদের গ্রাহকদের একই ধৈর্য আর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেবা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছি। প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি এই বিষয়গুলো এবং যে আইনি নিতিমালার উপর ভিত্তি করে ইইউ প্রতিষ্ঠিত, সেগুলো শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে।