জেনে-বুঝে শেয়ার কিনুন, লোকসান এড়ান: হাফিজ

পুঁজিবাজার বা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বৈশিষ্ট্যগতভাবেই ঝুঁকিপূর্ণ। জেনে-বুঝে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার ভিত্তিতে বিনিয়োগ না করলে লোকসানের সমূহ সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু অনেকেই দ্রুত বেশি লাভের আশায় ঝুঁকি বিবেচনা না করেই প্রভাবিত হয়ে বাজারে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত শেয়ার কিনে লোকসানে পড়ে কপাল চাপড়ান।

নিজস্ব প্রতিবেদকফারহান ফেরদৌস, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Nov 2017, 01:14 PM
Updated : 19 Nov 2017, 01:19 PM

বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিজের দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে কিছু পরামর্শ তুলে ধরেছেন বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ এ হাফিজ।

তিনি বলেন, “নতুন বিনিয়োগকারী আসছে, তাদেরকে পুঁজিবাজার সম্পর্কে জানানোর দায়িত্ব আমাদের, তাদের জানতে হবে কীভাবে বিনিয়োগ করতে হয় ।”

না জেনে-বুঝে শেয়ার ব্যবসায় জড়িত হওয়াকে নিরুৎসাহিত করে তিনি বলেন, “এ ব্যবসাটা সবার জন্য না ।এটা তো আলু পটলের ব্যবসা না যে আপনি কিনলেন, আর দুই দিনে বিক্রি করে দিলেন।”

আড়াই দশক ধরে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সঙ্গে জড়িত হাফিজ নিজে দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন; একটি ব্রোকারেজ হাউজের সঙ্গেও তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।

তার মতে, কোনো শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মৌলিক দিকনির্দেশনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির পরিচালনায় থাকা ব্যক্তিদের সম্পর্কেও খোঁজখবর নেওয়া উচিত।

হাফিজ বলেন, “একটি কোম্পানি কারা চালাচ্ছে, তারা ভাল লোক কি না; হঠাত্ করে ‘আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ’ হওয়া মানুষ কিনা- এসব দেখে কোম্পানির শেয়ার কিনতে হবে।

“আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া লোকের কোম্পানির শেয়ার কিনলে ধরা খেতেই হবে ।”

ব্যবসায় প্রশাসনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী এই বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ বলেন, যেসব কোম্পানি ‘নিয়ম ও কাঠামোর’ মধ্যে ভালভাবে ব্যবসা করে বিনিয়োগকারীদের ভাল মুনাফা দেয়, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সেসব কোম্পানিকে বিবেচনায় নিতে হবে।

হাফিজ বলেন, কোম্পানির শেয়ারপ্রতি মুনাফা, প্রাইস আর্নিং রেশিও (কোম্পানির শেয়ারের বাজার দরকে তার শেয়ারপ্রতি মুনাফা দিয়ে ভাগ করে পাওয়া), নেট অ্যাসেট ভ্যালু (মোট সম্পদ থেকে মোট দায় বাদ দিয়ে যা থাকে) দেখে ‘যদি আপনি শেয়ার কেনেন তাহলে শেয়ারে লোকসান হবে না’।

“কোনো কোম্পানির তৈরি পণ্য বাজারে কেমন করবে, সেসব ভেবে সেই কোম্পানির শেয়ার কেনা উচিত।”

গুজবে কান দিয়ে কোনো কোম্পানিতে বিনিয়োগ সাবধান করেন ফাস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের এই পরিচালক।

“শেয়ারটা ভাল কি মন্দ, কোম্পানিটা ভাল লোকে চালাচ্ছে কিনা, কোম্পারি ফিউচার প্রসপেক্ট- এসব না দেখে শেয়ার কিনলে সেখানে লোকসান হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে ।”

বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মানুষের হুজুগে মেতে উঠার প্রবণতা বোঝাতে পুঁজিবাজারে সদ্য তালিকাভুক্ত বিদেশিদের পরিচালনায় একটা কোম্পানির শেয়ারের উদাহরণ দেন তিনি।

“শেয়ারটা হঠাত্ করে পাবলিক কেনা শুরু করল ৫৪, ৫৫ ও ৫৬ টাকায় ।শেয়ারটা কেনার জন্য ফেসবুকে মানুষকে ইনভাইট করা হচ্ছিল। আমার পরিচিত একজন শেয়ারটা কিনলেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি শেয়ারটা কেন কিনলে?’ সে বললো, ‘এই কোম্পানির পরিচালকরা সব বিদেশি।

হাফিজের প্রশ্ন, কেনার জন্য যথেষ্ট অন্য শর্তগুলো পূরণ না করলে শুধু মালিকানা বিদেশি বলেই কোনো কোম্পানির শেয়ার কেনা কতটা যৌক্তিক।

“বিদেশি মালিকানার কোম্পানিতো আরও অনেক আছে। এগুলোর কোনো উত্তর আসলে নাই, যারা বোঝে না তাদেরকে বোঝানো যাবে না ।”

তিনি বলেন, বাজারে নতুন আসার কারণে একটি ইন্সুরেন্স কোম্পানির শেয়ার ৩৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যেখানে বাজারে সব ইন্সুরেন্স কোম্পানি শেয়ারের দাম ২০ টাকার নিচে।

“সেই ইন্সুরেন্স কেন কিনল? শেয়ারটা নতুন এসেছে তাই কিনেছে- এই যে না বুঝে যারা শেয়ার কিনবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না তো আমি হব?

“কাউকে বোঝানো যাচ্ছে না- দিস ইজ দ্য মোস্ট আনফর্চুনেট পার্ট অব আওয়ার মার্কেট।”

বিনিয়োগ করে মুনাফা বাড়ানো বা লোকসান পুষিয়ে নেওয়ার কৌশলও জানিয়ে দেন এএএ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান হাফিজ।

“পুঁজিবাজারে কখনোই সমস্ত টাকা একবারে বিনিয়োগ করা ঠিক না, আপনার পুরো টাকাকে ভাগ করে করে রাখতে হবে।”

বিনিয়োগের জন্য প্রস্তুত সেই টাকার একটা অংশ দিয়ে কোনো কোম্পানির কিছু শেয়ার কেনার পর যদি শেয়ারটির দাম কমে যায়, তখন বাকি টাকা থেকে আরও শেয়ার কিনে শেয়ারপ্রতি লোকসান কমাতে হবে।   

“এভাবে কমে কিনে শেয়ারের দাম একটি যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে রাখতে হবে ।তাহলে মুনাফা হবে, লোকসান এড়ানো যাবে।”

তবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ‘শতভাগ সঠিক কোনো ফর্মুলা’ নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমার সবচেয়ে বড় মূলধন হচ্ছে আমার অভিজ্ঞতা ।… এখানে ১০০ শতাংশ সঠিক বলে কোন ফর্মুলা নেই।”

হাফিজ বলেন, ২৫ বছরে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে এখন অনেক পরিণত।

“আমাদের মার্কেট আগে থেকে কিছু হলেও ম্যাচিউরিটি অর্জন করেছে ।”

১৬ বছরের ব্যবধানে দেশের পুঁজিবাজারে বড় দুটি ধসের ফলে বড় ধনের গুণগত পরিবর্তনের কথা তুলে ধরেন তিনি।

“১৯৯৬ সালের ধসের পরে পুঁজিবাজারের লেনদেন অটোমেটেড হয় এবং ২০১০ সালের ধসের পরে পুঁজিবাজার ডিমিউচুয়ালাইজ হয়। এর ফলে পুঁজিবাজারের উপর আস্থা দেশে এবং বিদেশে অনেক বেড়ে গেছে।”

পুঁজিবাজারের প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন নিয়ে নিজের ভূমিকার কথা তুলে ধরে হাফিজ বলেন, “আমি বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে আছি যখন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন যখন তৈরিই হয়নি, তখন থেকে; সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সব চেয়াম্যানের সঙ্গে কাজ করেছি।

পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক এই সংস্থার যারা চেয়ারম্যান ছিলেন তাদের সবাই পুঁজিবাজার ভাল বুঝতেন না বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এখন পুঁজিবাজার বোঝেন এমন লোক পাওয়াতে পুঁজিবাজারের উন্নয়ন হয়েছে।

“অনেক দিন ধরে যে শেয়ার মার্কেট সূচক ভাল একটা অবস্থানে আছে- এটা কিন্তু তাদের অবদান ।”