টানা পতনের কারণ খুঁজছেন পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা

দেশের পুঁজিবাজারে আবারও নিম্নমুখী ধারা শুরু হয়েছে। মাঝের তিন দিনের সাময়িক বিরতির পর চলতি সপ্তাহে আবার দরপতনের বৃত্তে ফিরেছে বাজার। বুধবারও অর্ধশত পয়েন্টের বেশি হারিয়েছে ডিএসইর প্রধান সূচক।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Nov 2021, 02:44 PM
Updated : 3 Nov 2021, 02:44 PM

সাম্প্রতিক সময়ে চাঙ্গা হয়ে ওঠা বাজারে অক্টোবরের মাঝামাঝিতে সূচক নিম্নমুখী হলে, তখন বাজার বিশ্লেষকরা সেটিকে দর সংশোধন হিসেবে উল্লেখ করলেও এখন তা দীর্ঘ পতনে রূপ নিয়েছে।

অক্টোবরজুড়ে টানা আট দিনের পতনের পর গত সপ্তাহের শেষ তিন দিন সূচক বাড়লেও ৩১ অক্টোবর রোববার শুরু হওয়া চলতি সপ্তাহের শুরু থেকে আবার দরপতন শুরু হয়েছে।

বুধবারও এ ধারা বজায় ছিল উভয় পুঁজিবাজারে। বিশ্লেষকরা এ জন্য বেশ কিছু কারণও চিহ্নিত করেছেন।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদ ওসমান ইমাম বাজারে ‘অলস’ টাকার প্রবাহ কমে যাওয়াকে এর একটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

করোনাভাইরাস মহামারীকালে দীর্ঘ লকডাউনের সময় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকা অনেক অলস টাকা বাজারে এসেছিল। এখন আবার শিল্পোদ্যোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য গতিশীল হওয়ায় অনেকেই টাকা তুলে নেওয়ার প্রভাব পড়েছে বাজারে।

অধ্যাপক মাহমুদ বলেন, “অর্থনীতিতে যে দুই লাখ কোটি টাকার ‘অলস’ তারল্য ছিল আগের চেয়ে তা কমে গেছে। গত এক থেকে দেড় মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক মানি মার্কেট থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে।

“এর মধ্যে ২০ থেকে ২২ হাজার কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে ট্রেজারি বন্ড বিক্রি করে। বাকি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে ডলার বিক্রি করে।”

অক্টোবরের শেষ দিকে বিভিন্ন কোম্পানির লভ্যাংশ সংক্রান্ত ঘোষণার প্রভাবও দেখা গেছে বাজারে। অনেক কোম্পানির ভালো মুনাফা ঘোষণার বিপরীতে বেশ কিছুর নামমাত্র বা কোনো লভ্যাংশ না দেওয়ার প্রভাবও ফেলেছে এই দরপতনে।

ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বছরের এই সময় বেশ কিছু কোম্পানি তাদের লভ্যাংশ এবং মুনাফার তথ্য দেয়। এসময় বিনিয়োগকারীরা শেয়ারগুলো বিক্রি করে দিয়ে বসে থাকেন।”

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) মহাসচিব রিয়াদ মতিন বলেন, “ লভ্যাংশ দেওয়ার এসময়ে প্রায় প্রতি বছর পুঁজিবাজারে সূচক একটু কমে যায়। পরে আবার বাড়ে।

“এখন অনেকেই ‘সেল মুডে’ আছে। প্রাতিষ্ঠানিক থেকে শুরু করে সাধারণ বিনিয়োগকারী সবাই শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে মুনাফা তুলে নিচ্ছে। সবাই মনে করছেন সূচক আরও কমে যাবে। এখন শেয়ার বিক্রি করে দিলে পরে আবার কম দামে কিনতে পারবেন এই আশায়।”

চলতি দরপতনকে উসকে দিয়েছে গুজব ও গুঞ্জণ। কারসাজির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা ফেইসবুকসহ বিভিন্নভাবে গুজব ছড়িয়ে বাজারের মধ্যে আতংক তৈরি করছেন বলে অভিযোগ আব্দুর রাজ্জাকের।

তার ভাষ্য, কারসাজির সঙ্গে জড়িতরা পরে কম দামে শেয়ার কিনতেই এমন অপচেষ্টা চালিয়ে থাকেন।

চলতি সপ্তাহের দরপতনের কারণ হিসেবে কেউ কেউ নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তিদের দেশের বাইরে অবস্থানকেও চিহ্নিত করেছেন।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহমুদও মনে করেন লেনদেনে এর প্রভাব পড়েছে।

বিনিয়োগ আকর্ষণে লন্ডনে রোড শো আয়োজন করা হয়েছে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিও এর অংশীদার। এ সম্মেলনে যোগ দিতে সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা সেখানে অবস্থান করছেন। অন্যান্য বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদেরও এতে অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে।

সার্বিক এ দরপতনের মধ্যে বিনিয়োগকারীদের দুশ্চিন্তায় ফেলেছে গত দুই তিন দিনের লেনদেন কমে যাওয়া।

বিএমবিএ মহাসচিব রিয়াদ মতিন বলেন, “পুঁজিবাজারে সূচক বাড়লে কমতেই পারে, কিন্তু লেনদেন কমে যাওয়াটা হচ্ছে বড় সমস্যার কারণ।“

এই পতনের মধ্যে বাজারে কিছু শেয়ারের দাম অনেক কমে গেছে বলে নতুন করে ক্রেতা তৈরি হবে বলে মনে করছেন অধ্যাপক মাহমুদ।

বাজার ঘুরে দাঁড়াতে যা ভূমিকা রাখবে বলেও ধারণা তার। 

বাজার চিত্র

সপ্তাহের চতুর্থ দিন বুধবার দিন শেষে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিন থেকে ৫৬ দশমিক শূন্য ৭ পয়েন্ট বা দশমিক ৮১ শতাংশ কমে ৬ হাজার ৮৯৮ দশমিক ২৮ পয়েন্টে অবস্থান করছে।

এ নিয়ে চলতি সপ্তাহের চার দিনে সূচক কমলো ১৬৪ পয়েন্ট। শতাংশের হিসাবে যা ২ দশমিক ৩২ শতাংশ। 

এদিন সূচকের সঙ্গে লেনদেনও আগের দিনের তুলনায় ১০ দশমিক ৮৬ শতাংশ বা ১৪০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা কমে এক হাজার ১৫৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকায় নেমেছে। আগের কর্মদিবসে যা ছিল ১ হাজার ২৯৫ কোটি ১২ লাখ টাকা।

বুধবার ডিএসইতে ৩৭৫টি কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিটের মধ্যে দর বেড়েছে ৮৯টির ও কমেছে ২৪৬টির। অপরিবর্তিত রয়েছে ৪০টির দর।

ঢাকার অন্য দুই সূচকের মধ্যে ডিএসইএস বা শরীয়াহ সূচক ৭ দশমিক শূন্য ২ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ৪৬১ দশমিক ১৬ পয়েন্টে।

ডিএস৩০ সূচক ২০ দশমিক ১৪ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ২ হাজার ৫৮৫ দশমিক ৮০ পয়েন্টে।

লেনদেনের শীর্ষ ১০টি কোম্পানি

বেক্সিমকো লিঃ,  অরিয়ন ফার্মা, আইএফআইসি ব্যাংক, বিএটিবিসি, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স, লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ, কাট্টলি টেক্সটাইল, সাইফ পাওয়ার, আলিফ ম্যানুফেকচারিং ও বেক্সিমকো ফার্মা।

দাম বাড়ার তালিকায় শীর্ষ ১০টি কোম্পানি

বিডি ল্যাম্পস, জেমিনি সি ফুড, ফার্মা এইডস, কাট্টলি টেক্সটাইল, ঢাকা ডাইং, ন্যাশনাল ফিড মিল, আনলিমা ইয়ার্ন, দেশ গার্মেন্টস, এম্বি ফার্মা ও লিব্রা ইনফিউশন।

দর হারানো শীর্ষ ১০টি কোম্পানি

আলিফ ম্যানুফেকচারিং, শাহজিবাজার পাওয়ার, শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজ, মোজাফ্ফর হোসেন স্পিনিং মিল, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, প্রাইম টেক্সটাইল, অরিয়ন ফার্মা, মেট্রো স্পিনিং, মিথুন নিটিং ও জুট স্পিনার্স।

এদিন চট্টগ্রামের পুঁজিবাজারেও সূচক ও লেনদেন কমেছে। 

এ বাজারের প্রধান সূচক সিএএসপিআই ২১৬ দশমিক ৫৪ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ২০ হাজার ১৮৭ দশমিক ৬৩ পয়েন্টে।

এ বাজারে লেনদেন আগের দিনের তুলনায় ২৮ দশমিক ১৭ শতাংশ বা ১২ কোটি ২৬ লাখ টাকা কমেছে।

এদিন মোট ৩১ কোটি ২৬ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে, যা আগের দিন ছিল ৪৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।

সিএসইতে ২৮৮টি কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড কেনাবেচা হয়েছে। এর মধ্যে দর বেড়েছে ৫৯টির, কমেছে ২০১টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ২৮টির দর।