দেশের পুঁজিবাজারের স্বাভাবিক প্রবণতায় লভ্যাংশ ঘোষণার এই সময়ের আগে ও পরে ব্যাংকের শেয়ারের লেনদেন যেমন বাড়ে, ব্যবসা ভালো করা ব্যাংকগুলোর দামেরও উন্নতি হয়।
এ বছরে এই খাতের শেয়ারগুলোর চিত্র অনেকটাই উল্টো। সাম্প্রতিক সময়ে যেসব খাতের শেয়ারের লেনদেন ও দাম বাড়ছে, অর্থ্যাৎ ‘ট্রেন্ডিং’, সেগুলোতেই ঝুঁকছেন বিনিয়োগকারীরা। তাতে ব্যাংকের শেয়ারের কাটতি কমছে উল্লেখযোগ্য হারে।
এমনকি ২০২০ হিসাব বছর শেষে কিছু ব্যাংক ভালো লভ্যাংশ ঘোষণা করেও নজর কাড়তে পারেনি প্রাতিষ্ঠানিক বা ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের বড় অংশের। নিয়মিত বিরতিতে দাম কমলেও আগ্রহ বাড়ছে না এ খাতের শেয়ার কেনায়।
বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২০২০ সমাপ্ত হিসাব বছরে ১৯টি ব্যাংক লভ্যাংশ দেওয়ার সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে ৯টির লভ্যাংশ আগের বছরের চেয়ে বেড়েছে, ৪টির কমেছে এবং ৬টি ব্যাংকের নগদ ও স্টক মিলিয়ে মোট লভ্যাংশ সমান রয়েছে।
করোনাভাইরাস মহামারীতে ব্যাংকগুলো ‘তেমন মুনাফা করতে পারবে না’, বা ‘লভ্যাংশে ধস নামবে’ বলে যে ভয় ছিল, তা অনেকটা কেটেছে ওই ঘোষণায়।
লেনদেন পর্যালোচনা এবং বাজার বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, লভ্যাংশকেন্দ্রীক একটি বা দুটি ব্যাংকের লেনদেন একটু বাড়লেও তা সার্বিক খাতের বিবেচনায় বলার মত কিছু নয়, অন্যগুলোরও নড়াচড়া কম।
এক সময় লেনদেনের শীর্ষ দশে নিয়মিত অনেক ব্যাংকের আধিপত্য থাকলেও এখন তা হাতেগোনা। মাঝমধ্যে দু’একটি ব্যাংকের শেয়ারের লেনদেন ও দর বাড়তে দেখা গেলেও তা স্থায়ী হচ্ছে না।
মার্চেন্ট ব্যাংক লংকাবাংলার গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, গত বছর পুঁজিবাজারের মোট লেনদেনের ৮ শতাংশের বেশি ছিল ব্যাংকের শেয়ারের লেনদেন। গত কয়েক সপ্তাহে এ খাতের শেয়ারের কেনাবেচা মোট লেনদেনের ৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।
তালিকাভুক্ত ৩১ ব্যাংকের মধ্যে এখন পর্যন্ত ঘোষিত ১৯টির লভ্যাংশ তুলনামূলকভাবে ভালো হলেও শেয়ার কেনাবেচায় খরার পেছনে কিছু কারণও তুলে ধরেছেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, আমানতে ৬ এবং ঋণে ৯ শতাংশ সুদহার নির্দিষ্ট করে দেওয়া, করোনাভাইরাস মহামারীকালে ব্যাংকের ব্যবসা কমায় আয় নিম্নমুখী হয়েছে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধিনিষেধের কারণে অনেক কিছুতেই ছাড় দিতে হয়েছে ব্যাংকগুলোকে। এই দুই কারণে বিনিয়োগকারীদের অনেকের ধারণা হয়েছে, ব্যাংকগুলোর মুনাফা ভালো ‘নাও হতে পারে’ এবং সামনের দিনগুলোতে তাদের আর্থিক পরিস্থিতি উন্নতির সম্ভাবনা ‘অনিশ্চিত’।
বিনিয়োগকারীদের এমন ভাবনাই তাদের ব্যাংক খাতের শেয়ারে বিনিয়োগ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
মার্চেন্ট ব্যাংক আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বেশিরভাগ ব্যাংক যে মুনাফা দেখিয়েছে সেখানে প্রভিশনিং দেখানো হয়নি।
“এছাড়া ব্যাংকগুলোর মুনাফা করার ক্ষমতা কমে গেছে। ব্যাংকগুলো ৪ থেকে ৫ শতাংশে আমানত নিচ্ছে, আবার বড় বড় ব্যবসাকে ৭ শতাংশে টাকা ধার দিচ্ছে ফলে মুনাফা আগের মত হচ্ছে না।
“আগের মত ঋণ বিতরণও করতে পারছে না। ব্যবসা- বাণিজ্য নাই। তাই ব্যাংকগুলোর ব্যবসা আর আগের মত হচ্ছে না। অর্থনীতিতে অনেক অলস অর্থ জমে আছে।”
আবার বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যারা আগে বেশি দরে ব্যাংকের শেয়ার কিনেছিলেন, তারা আটকে আছেন। এদের বড় অংশ নিস্ক্রিয় থাকায় লেনদেনও বাড়ছে না, যার প্রভাবে মুনাফা বাড়ার পরও দামে উন্নতি নেই।
মার্চেন্ট ব্যাংক ট্রিপল এ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের পরিচালক মোহাম্মদ এ. হাফিজ বলেন, “একটা আতঙ্ক ছিল করোনাভাইরাসের কারণে দেশের পুঁজিবাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ার। যে কারণে লেনদেনও কমে গিয়েছিল। খারাপ এই সময়ে বিনিয়োগকারীরা ছোট পেইডআপের শেয়ারগুলোতে বেশি লেনদেন করছেন। এখন আবার আস্থা ফিরছে। সামনে ব্যাংকের শেয়ার আস্তে আস্তে লেনদেন হবে।”
তবে ব্যাংকের শেয়ারের কম দামের জন্য বেশি বোনাস লভ্যাংশকে দুষলেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জর (ডিএসই) পরিচালক শাকিল রিজভী।
তার মতে, শেয়ারের সরবরাহ বেশি থাকাতে ব্যাংকের শেয়ার কম দামে লেনদেন হচ্ছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সবগুলো কম দামে লেনদেন হচ্ছে তা নয়। কিছু কিছু ব্যাংক আছে তাদের অবস্থা খারাপ।
“দাম কমে যাওয়ার আরেকটা কারণ হচ্ছে ব্যাংকের শেয়ারের সরবরাহ অনেক বেশি। ব্যাংকগুলো প্রচুর বোনাস লভ্যাংশ দেয়। ৫ বছর আগে যেসব ব্যাংকের শেয়ার ৩০ টাকা ছিল সেগুলো যে হারে বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছে তাতে শেয়ারের দাম নেমে এসেছে ৭ থেকে ৮ টাকায়।”
লংকাবাংলার হিসাবে বর্তমানে ঢাকার পুঁজিবাজারের ট্রেইলিং পিই ১৭ দশমিক ৯৪ পয়েন্ট। সেখানে ব্যাংক খাতের ট্রেইলিং পিই ৭ দশমিক শূন্য ৬।
কোনো কোম্পানির শেয়ারের পিই রেশিও ১৫ থেকে ২০ এর মধ্যে হলে সেটিকে ‘ভালো’ হিসেবে বিবেচনা করেন বাজার বিশ্লেষকরা।
অবশ্য যেসব কোম্পানির সামনে ভালো করার সম্ভাবনা আছে সেগুলোর পিই আরো বেশি হতে পারে।
পিই রেশিও ১০ এর কম হলে সেই শেয়ার কম দামে লেনদেন হচ্ছে বলা যায়। তবে শেয়ার বেশি নাকি কম দামে লেনদেন হচ্ছে সেটা বুঝতে হলে ওই খাতের পিই রেশিওর সঙ্গে তুলনা করতে হবে।
ট্রেইলিং পিই হিসাব করা হয় কোনো শেয়ারের বর্তমান দামকে সর্বশেষ ১২ মাসের ইপিএস দিয়ে ভাগ করে। আর পিই (প্রাইস আর্নিং) রেশিও হলো মূল্য ও আয় অনুপাত।
ব্যাংকগুলোর ট্রেইলিং পিই এবং ২০২০ ও ২০১৯ সমাপ্ত হিসাব বছরের লভ্যাংশ
ব্যাংক | পিই পয়েন্ট) | লভ্যাংশ % (২০২০) | লভ্যাংশ % (২০১৯) |
এবি | ১৬.৩৭ | ৫ স্টক | ৫ স্টক |
আল আরাফাহ ইসলামী | ৬.২৬ | এখনও দেয়নি | ১৩ নগদ |
ব্যাংক এশিয়া | ৯.৯৪ | ১০ নগদ | ১০ নগদ |
ব্র্যাক | ১৩.১৬ | ১০ নগদ ও ৫ স্টক | ৭.৫ নগদ ও ৭.৫ স্টক |
দি সিটি | ৫.৬০ | ১৭.৫ নগদ ও ৫ স্টক | ১৫ নগদ |
ঢাকা | ৬.০৮ | এখনও দেয়নি | ৫ নগদ ও ৫ স্টক |
ডাচ্-বাংলা | ৬.৫৮ | ১৫ নগদ ও ১৫ স্টক | ১৫ নগদ ও ১৫ স্টক |
ইস্টার্ন | ৭.৭১ | ১৭.৫ নগদ ও ১৭.৫ স্টক | ১৫ নগদ |
এক্সিম | ৫.১৬ | এখনও দেয়নি | ১০ নগদ |
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী | ৩.৮৯ | এখনও দেয়নি | ১০ স্টক |
আইসিবি ইসলামী | ০.০ | লভ্যাংশ দেবে না | লভ্যাংশ দেয়নি |
আইএফআইসি | ১৩.৬৮ | ৫ স্টক | ১০ স্টক |
ইসলামী ব্যাংক | ৯.৩১ | ১০ নগদ | ১০ নগদ |
যমুনা | ৪.৭৭ | ১৭.৫০ নগদ | ১৫ নগদ |
মার্কেন্টাইল | ৪.৯০ | ১০ নগদ ও ৫ স্টক | ১১ নগদ ও ৫ স্টক |
মিউচুয়াল ট্রাস্ট | ৮.৮৮ | এখনও দেয়নি | ৫ নগদ ও ৫ স্টক |
ন্যাশনাল | ৫.৯৫ | এখনও দেয়নি | ৫ নগদ ও ৫ স্টক |
ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স | ৫.৮০ | ৭.৫ নগদ ও ৭.৫ স্টক | ১৫ নগদ ও ২ স্টক |
এনআরবিসি | ৩.৭০ | ৭.৫০ নগদ ও ৫ স্টক | ৯ নগদ ও ২ স্টক |
ওয়ান | ৬.৫৪ | ৬ নগদ ও ৫.৫০ স্টক | ৫ নগদ ও ৫ স্টক |
প্রমিয়ার | ৫.৫৯ | ১২.৫০ নগদ ও ৭.৫০ স্টক | ৫ নগদ ও ৫ স্টক |
প্রাইম | ৩.২৫ | ১৫ নগদ | ১৩.৫ নগদ |
পূবালী | ৬.৯৭ | ১২.৫০ নগদ | ১০ নগদ |
রূপালী | ১৫.৩৪ | এখনও দেয়নি | লভ্যাংশ দেয়নি |
শাহ্জালাল ইসলামী | ১০.৩৮ | ৭ নগদ ও ৫ স্টক | ৫ নগদ ও ৫ স্টক |
সোসাল ইসলামী | ১৬.৩৮ | এখনও দেয়নি | ৫ নগদ ও ৫ স্টক |
সাউথইস্ট | ৫.৬৯ | এখনও দেয়নি | ৭.৫০ নগদ ও ২.৫০ স্টক |
স্ট্যান্ডার্ড | ৮.৭৯ | ২.৫০ নগদ ও ২.৫০ স্টক | ৫ নগদ ও ৫ স্টক |
ট্রাস্ট | ৬.৩২ | এখনও দেয়নি | ৫ নগদ ও ৫ স্টক |
ইউসিবি | ৫.০৩ | এখনও দেয়নি | ৫ নগদ ও ৫ স্টক |
উত্তরা | ৫.৯৩ | ১২.৫০ নগদ ও ১২.৫০ স্টক | ৭ নগদ ও ২৩ স্টক |
** ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তি তালিকাটি তৈরি