পুঁজিবাজারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা

পতনের ধারা থেকে পুঁজিবাজারকে তুলতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ চেয়েছেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ।

সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Jan 2020, 03:11 PM
Updated : 15 Jan 2020, 05:21 PM

পুঁজিবাজারে ধসে বিনিয়োগকারীদের ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে বুধবার সংসদে অনির্ধারিত আলোচনায় এ প্রসঙ্গ তোলেন বিরোধী দলের এই সংসদ সদস্য।

বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এক দশকের মাথায় আরও একটি বড় ধসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক আবার নেমে এসেছে ভিত্তি পয়েন্টেরও নিচে।

বাজারের এই করুণ দশায় ফের রাস্তায় নেমেছেন ছোট বিনিয়োগকারীরা। পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে তারা মঙ্গলবার মতিঝিলে ডিএসই ভবনের সামনে মানববন্ধন করেন।

পুঁজিবাজারের অবস্থা তুলে ধরে ফিরোজ রশীদ বলেন, “সমস্ত পত্রিকায় নিউজ হচ্ছে শেয়ার বাজার নিয়ে। আজকে লিড নিউজ হয়েছে, ‘মাটিতে শুয়ে গেছে শেয়ার বাজার’, বিক্ষোভ করছে বিনিয়োগকারীরা।

“শেয়ার মার্কেট নিয়ে কেন এমন হল? বিশেষজ্ঞরা বলছে, মার্কেটে সুশাসনের অভাব। বিনিয়োগকারীরা ভরসা পাচ্ছে না। এটা বাজারের জন্য অশনি সঙ্কেত।”

“যদি প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করেন তবে বাজার ফিরে আসতে পারে,” বলেন জাতীয় পার্টির এই নেতা।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের কাজ নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।

ফিরোজ রশীদ বলেন, “এটা কেন হচ্ছে? মাননীয় মন্ত্রী মিটিং করেছিলেন। সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন ছিল। স্টেক হোল্ডাররা ছিল। আমাদের মন্ত্রীর সামনে আমি কিছু প্রস্তাব তুলে ধরেছিলাম। বলেছিলাম দুর্বল কোম্পানিগুলো যেগুলো, তার লিস্টিং যাতে না নেয়।”

সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সমালোচনা করে তিনি বলেন, “ইতিমধ্যে শেয়ার মার্কেট ডিমিউচুয়ালাইজেশন হয়ে গেছে। বলা হল এটা করা হলে আমাদের কাছ থেকে ৭ বছর ট্যাক্স নেওয়া হবে না। দুই বছর পর আমাদের ওপর ট্যাক্স আরোপ করা হচ্ছে। 

“এই যে শেয়ার মার্কেটের অবস্থা একমাত্র কারণ দুর্বল কোম্পানিকে শেয়ার  বাজারে লিস্টিং দেওয়া হয়েছে। আমাদের কিছু করার থাকে না। লিস্টিং দেয় সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন। আমরা বারবার বলি এই কোম্পানির লিস্টিং দিতে পারব না। কিছু মার্চেন্ট ব্যাংক, ইস্যু বরোয়ার এসব দুর্বল ও পচা কোম্পানি নিয়ে আসছে বাজারে। বিনিয়োগকারীদের রাস্তায় বসিয়ে দিয়েছে।

“এসইসি যারা দেখাশোনা করবে, তারা পচা কোম্পানিগুলো গছিয়ে দিচ্ছে। এই কোম্পানির শেয়ার  নেমে আসতে ৭,৮, ১০ টাকায় নেমে আসে। মূল দামের নিচে চলে আসে। বিনিয়োগকারীরা শেষ হয়ে যাচ্ছে। ১০ টাকার শেয়ার ১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পড়ে ১৫ টাকায় নেমে এসেছে। বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় বসে গেছে।”

শেয়ার বাজারে টানা দরপতনে মঙ্গলবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে মানববন্ধন করেন একদল ক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারী।

ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে জাতীয় পার্টির এই নেতা বলেন, “৩০ বছর ধরে শেয়ারবাজারে যাতায়াত করে, এখন পায়ে জুতা নেই। তারা বলে আমাদের দেখার কী কেউ নেই? আমাকে বলেছে সংসদে গিয়ে বলতে।

“সমস্ত দোষ বিনিয়োগকারীদের দেওয়া হয়। তারা (বিএসইসি) যে পচা কোম্পানি আনছে, সে ব্যাপারে কিছু করা হচ্ছে না। কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত নেওয়া হয় নাই। ১০ টাকার শেয়ার ৩০ টাকা প্রিমিয়াম হতে পারে না। কীভাবে বাজারে আসল? ইস্যু ম্যানেজারকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। মার্চেন্ট ব্যাংককে জবাবদিহির আওতায় আনা হচ্ছে না।”

ফিরোজ রশীদ বলেন, “প্রশান্ত হালদার নামে একটা লোক নন-ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান করে ৩ হাজার ৫শ কোটি টাকা নিয়ে গেছে। উনি এখন উধাও হয়ে গেছে। এভাবে টাকা চলে যাচ্ছে কার জবাব কে নেবে, কার জবাব কে দেবে। কোনো জবাবদিহিতা নেই।”

পরে বিএনপির হারুনুর রশীদ বলেন, “মন্ত্রীরা বিপর্যয় দেখতে পান না। তারা বলেন, সঙ্কট নাই। আমরা হতভম্ভ হয়ে যাই, বিস্মিত হয়ে যাই। গত এক সপ্তাহ ধরে মানুষ শেয়ারবাজারের জন্য রাস্তায় শুয়ে পড়েছে। কান্নায় বিপর্যস্ত। লক্ষ লক্ষ পরিবার ধুলায় মিশে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকার দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে আমরা আশ্বস্ত হতে পারছি না।

“পত্রিকায় খবর এসেছে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা চলে যাচ্ছে, অথচ আমরা আজ মুজিববর্ষ পালন করছি, বলছি দেশে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এত উন্নতি, চারদিকে বিশাল বিশাল স্থাপনা বানাচ্ছি। অথচ অর্থনীতির কী বিপর্যয়কর অবস্থা!”

পরে সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের  আলোচনায়ও পুঁজিবাজার নিয়ে কথা বলেন বিএনপির সংরক্ষিত আসনের সদস্য রুমিন ফারহানা।

তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আর শেয়ার বাজার ধ্বংস, এটা সমার্থক। ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের পর এখন আবার শেয়ার বাজার ধসে পড়েছে। শেয়ার বাজার সবচেয়ে বড় ক্যাসিনো। লাখ লাখ মানুষকে পথে বসানো হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে।”

সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো এখন বিপজ্জনক অবস্থায় আছে দাবি করে রুমিন বলেন, “শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা একটা মন্দার পূর্বাভাস দিচ্ছেন। এটা নিয়ে কোনো দিক নির্দেশনা নেই রাষ্ট্রপতির ভাষণে।”

সম্প্রচারে বিঘ্ন সৃষ্টির অভিযোগ

সংসদে বিএনপির বক্তব্যের সময় সম্প্রচারে বিঘ্ন সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন হারুনুর রশীদ।

তিনি বলেন, “গতকাল আমি ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছিলাম। মাননীয় দুজন সিনিয়র সংসদ সদস্য জবাব দিয়েছেন। আমি বাইরে গিয়ে চেষ্টা করলাম। বলা হল, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে সম্প্রচার বন্ধ ছিল। কোথাও আমরা ওই বিষয়টা খুঁজে পাচ্ছি না। প্রতিনিয়ত সংসদ লাইভ প্রচার করা হয়। আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য। আশঙ্কা করতেই পারি, আমাদের কথা বলার সময় যদি প্রচার বন্ধ হয়ে যায় তাহলে ধরে নেব কথাগুলো প্রচারে বিঘ্ন সৃষ্টি করা হচ্ছে।”

প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেন, “আবারও অনুরোধ করছি এখানে সংসদ নেতা আছেন।  প্রতিনিয়ত পত্রিকায় নিউজ হচ্ছে যে  হুমকি-ধমকি, প্রচারে বাধা দেওয়া হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পোস্টার টাঙাতে বাধা দিচ্ছে। এগুলো সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচনের পথে অন্তরায়। এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।”

ভিপি নুর কেন বারবার মার খায়?

সংসদে একটি জনগুরুত্বপূর্ণ নোটিসের আলোচনায় বিএনপির রুমিন ফারহানা ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরের উপর একের পর এক হামলা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

তিনি বলেন, “ডাকসুর ভিপি নুর কেন বারবার মার খায়- স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো আমারও এই প্রশ্ন। এর জবাব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে।”

রুমিন বলেন, “বারবার মার খায়, কারণ প্রথমবার মার খাওয়ার পর কোনো বিচার হয়নি। (এটা) প্রমাণ করে যে এই দেশে আইনের শাসন তার নিজ গতিতে চলে না, চলে সরকারের গতিতে।”

রুমিন বলেন, “দেশে আইনের শাসনের অনুপস্থিতি ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের কিছু নজির আমরা দেখতে পেলাম আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাম্প্রতিক রিপোর্টে। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে ধর্ষণের সংখ্যা বেড়ে আগের বছরের চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে।

“২০১৯ সালে গড়ে প্রতিদিন একজনের বেশি মানুষ বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড খুব সম্ভব বৈধ হতে যাচ্ছে। কারণ গতকাল আমরা দেখেছি সরকার ও বিরোধী দল, দুদলই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পক্ষে কথা বলেছে।“

রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপর আলোচনায় রুমিন বলেন, “ভিন্নমত দমন করে রাষ্ট্রপতির জাতীয় ঐকমত্যের ডাক জাতির সাথে প্রহসন ছাড়া কিছু নয়।”

গত ৯ জানুয়ারি সংসদের শুরুর দিন সাংবিধানিক নিয়ম রক্ষার ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। মন্ত্রিসভার ঠিক করে দেওয়া ভাষণে গণতন্ত্র ও উন্নয়নকে স্থায়ী রূপ দিতে জাতীয় ঐক্যমতের ডাক দেন রাষ্ট্রপতি।

রুমিন বলেন, “বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে, বিএনপির এক লাখ কর্মীর নামে মামলা দিয়ে, মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে জাতিকে বিভাজন করে, ভিন্নমত দমন করে রাষ্ট্রপতির জাতীয় ঐকমত্যের ডাক জাতির সাথে প্রহসন ছাড়া কিছু নয়।”

দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সমালোচনা করে তিনি বলেন, “বাকস্বাধীনতা হুমকির মুখে। বিজ্ঞাপনদাতাদের চাপ দিয়ে গণমাধ্যমের মুখ বন্ধ করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভয়ে মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কথা বলতে পারছে না। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে মতিউর রহমান, মাহফুজ আনামের মতো প্রখ্যাত সাংবাদিকরা সেল্ফ সেন্সরশিপের কথা বলছেন।”

দুর্নীতিবিরোধী অভিযান নিয়ে রুমিন বলেন, “আওয়ামী লীগ আর দুর্নীতি সমার্থক। সাম্প্রতিক তথাকথিত শুদ্ধি অভিযানে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের তৃতীয় চতুর্থ সারির নেতারা হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন। কোটি কোটি টাকার বান্ডিল পাওয়া গেছে। এর থেকে বোঝা যায় ওপরের সারির নেতাদের কী অবস্থা।”