ফের বড় ধসের কবলে পুঁজিবাজার

এক দশকের মাথায় আরও একটি বড় ধসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার; ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক আবার নেমে এসেছে ভিত্তি পয়েন্টেরও নিচে। 

ফারহান ফেরদৌসআবদুর রহিম হারমাছি ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Jan 2020, 02:55 PM
Updated : 14 Jan 2020, 03:50 PM

মঙ্গলবার দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইএক্স ৮৭ পয়েন্ট কমে ৪ হাজার ৩৬ পয়েন্ট হয়েছে। ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে যখন ডিএসইএক্স চালু হয়েছিল, তখন এ সূচকের ভিত্তি পয়েন্ট ছিল ৪ হাজার ৫৫ পয়েন্ট।

নতুন বছরের প্রথম আট দিনেই ডিএসইএক্স ৯ দশমিক ৪ শতাংশ কমে গেছে। দরপতনের ধাক্কায় এক বছরে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে এক লাখ কোটি টাকা। শেয়ারের দাম ও আয়ের অনুপাত যেখানে নেমেছে, ততটা খারাপ দশা আর কখনও ছিল না।

বাজারের এই করুণ দশায় ফের রাস্তায় নেমেছেন ছোট বিনিয়োগকারীরা। পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে তারা মতিঝিলে ডিএসই ভবনের সামনে মানববন্ধন করেছেন।

বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজানুর রশীদ চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কারসাজি করে কয়েকজন বাজারের এই অবস্থা করেছে। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। সবাই আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি।… এই বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের কোনো আস্থা নেই।”

এ পরিস্থিতিতে আগামী ২০ জানুয়ারি মতিঝিলে আইসিবি কার্যালয়ে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের জরুরি বৈঠকে ডেকেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

মঙ্গলবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স হারিয়েছে ২ দশমিক ১১ শতাংশ। আর সোমবার সূচক কমেছিল ২ দশমিক ১২ শতাংশ। 

গত বছরের শেষ দিনের লেনদেনে ডিএসইএক্স ছিল ৪ হাজার ৪৫৩ পয়েন্ট। আট দিনে ৪১৭ পয়েন্ট হারিয়ে মঙ্গলবার দিন শেষে তা নেমে এসেছে ৪ হাজার ৩৬ পয়েন্টে।

শেয়ার বাজারে টানা দরপতনে মঙ্গলবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে মানববন্ধন করেন একদল ক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারী।

এর মধ্যে সাত দিনই লেনদেন ছিল ৩০০ কোটি টাকার নিচে। ২০১৯ সালের ১৪ জানুয়ারি বাজার মূলধন যেখানে ছিল ৪ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা,মঙ্গলবার তা ৩ লাখ ১৩ হাজার কোটিতে নেমে এসেছে।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৫৯টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে ৯৩টিই এখন বিক্রি হচ্ছে অভিহিত মূল্য বা ১০ টাকার নিচে। এর মধ্যে অর্ধশতাধিক শেয়ারের দাম নেমে গেছে ৫টাকার নিচে।

আর এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ারের দাম ও আয়ের অনুপাত বা প্রাইস টু আর্নিং রেশিওতে। মঙ্গলবার দিন শেষে পিই রেশিও হয়েছে ১০ দশমিক ৭১।

অথচ ২০১০ সালে বাজারে বড় ধস শুরুর পর ২০১২ সালেও পিই রেশিও ছিল ১৩ দশমিক ৬৮; ২০১৩ সালে ছিল ১২ দশমিক ০৭।

শেয়ার প্রতি আয়ের সঙ্গে শেয়ারের দামের তুলনাকেই বলে পিই রেশিও। বাজার অতিমূল্যায়িত না অবমূল্যায়িত আছে তা বুঝতে এই পিই রেশিও ব্যবহার করেন বিশ্লেষকরা। মূলত ঝুঁকি নিরূপনের কাজে এই অনুপাত ব্যবহার করা হয়। 

রশীদ ইনভেস্টমেন্ট সার্ভিস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আহমেদ রশীদ লালী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি মার্কেটের পিই রেশিও এত নিচে আর কখনও দেখিনি, ১২ পর্যন্ত দেখেছি। মার্কেট পিই রেশিও এগারর নিচে নেমে যাওয়া খুবই আশঙ্কাজনক।”

বাজারের এই পরিস্থিতির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লালী বলেন, “তারল্য সঙ্কট তো আগে থেকেই ছিল। গ্রামীণফোনের সঙ্গে বিটিআরসির দ্বন্দ্ব বাজারের অনেক ক্ষতি করেছে। এই দ্বন্দ্বের কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে তাদের শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে চলে যাচ্ছে। এদিকে কর্তৃপক্ষও সঙ্কট উত্তরণের কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না।”

শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ এমরান হাসানের মতে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে তিন কারণে। গ্রামীণফোন-বিটিআরসি দ্বন্দ্ব; টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার শঙ্কায় এবং দেশের অর্থনীতির সূচকগুলোর নেতিবাচক ধারা।

“এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের তিনটি পথ আমি দেখি। ব্যাংক ঋণ এবং আমানতের সুদ হার ৯ ও ৬ শতাংশ দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে। আর আমদানির আড়ালে বিদেশে টাকা পাচার বন্ধ করতে হবে।”

বাজার পরিস্থিতি

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স মঙ্গলবার ৮৭ পয়েন্ট কমে ৪ হাজার ৩৬ পয়েন্ট হয়েছে। এর আগে সর্বশেষ ২০১৫ সালের ৫ মে সূচক ৪ হাজার ১৪ পয়েন্টে নেমেছিল।

মঙ্গলবার এ বাজারে ২৬২ কোটি ৮১ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে, যা আগের দিনের চেয়ে ২৪ কোটি টাকা কম।

এদিন লেনদেনে অংশ নেওয়া ৩৫৫টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে ২৯৩টির দাম কমেছে, বেড়েছে মাত্র ৩২টির। আর অপরিবর্তিত রয়েছে ৩০টি কোম্পানির শেয়ার দর।

চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) প্রধান সূচক সিএএসপিআই মঙ্গলবার ২৭৪ দশমিক ৭৫ পয়েন্ট কমে ১২ হাজার ২৯৫ দশমিক ৩৫ পয়েন্ট হয়েছে।

এ বাজারে ৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে, যা সোমবারের চেয়ে প্রায় চার কোটি টাকা কম।

আর চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন হওয়া ২৪৪টি কোম্পানির শেয়ার ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে ২০৩টির দরপতনের বিপরীতে ২১টির দাম বেড়েছে। অপরিবর্তিত রয়েছে ২০টির দর।