টানা পতনের জেরে মঙ্গলবার ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫০ পয়েন্ট হারিয়ে নেমে এসেছে ৪ হাজার ২৮১ পয়েন্টে। তাতে ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার ৬৬২ কোটি টাকায়।
অথচ এক বছর আগে ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি ডিএসইএক্স ছিল ৫ হাজার ৬৫৫ পয়েন্টে। সেদিন বাজার মূলধন ছিল ৪ লাখ ১ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা।
এক বছরে ৭০ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা বাজার মূলধন হারানোকে ‘উদ্বেগজনক’ বলে মনে করছেন এইমস অব বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইয়াওয়ার সায়ীদ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পুঁজিবাজারকে আর্থিক ব্যবস্থাপনা কাঠামোর বাইরের কিছু ভাবলে হবে না। সামগ্রিক আর্থিক অবস্থা ভালো না। এখানে বাজারকে আলাদাভাবে দেখার কিছু নেই।”
বাংলাদেশের জিডিপির আকার ২৫ লাখ ৪২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। সে হিসেবে ডিএসইর বাজার মূলধন জিডিপির মাত্র ১৩ শতাংশ।
দ্য গ্লোবাল ইকোনমি ডটকমের সর্বশেষ হিসাবে, ২০১৮ সালে বিশ্বের জিডিপির তুলনায় পুঁজিবাজারের গড় বাজার মূলধন ছিল ৭০ দশমিক ৯৫ শতাংশ। পাশের দেশ ভারতে তা ৭৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ। সে হিসেবে ঢাকার পুঁজিবাজার অনেকটাই পিছিয়ে আছে।
রেমিটেন্স ছাড়া অর্ধনীতির সব সূচকের নেতিবাচক অবস্থানে থাকা, বাজারে তারল্য সঙ্কট, গ্রামীণফোনের সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থার টানাপড়েন, ডলারের বিপরীতে টাকার মান হারানো এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাজার ছেড়ে চলে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে বছরজুড়ে পুঁজিবাজার ভুগেছে। নতুন বছরে আরো জোরদার হয়েছে পতনের ধারা।
বছরের প্রথম দুদিন বুধ ও বৃহস্পতিবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স মাত্র ৬ পয়েন্টের মতো বেড়েছিল। শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির পর রবি ও সোমবার সূচক কমে ১২৭ পয়েন্ট।
সপ্তাহের তৃতীয় দিন মঙ্গলবার ডিএসইএক্স ৫০ পয়েন্ট হারিয়ে ৪ হাজার ২৮১ পয়েন্ট হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রধান সূচক ফিরে গেছে ৪৪ মাস আগের অবস্থানে। সূচক এর চেয়ে কম ছিল ২০১৬ সালের ১৫ মে, ৪ হাজার ২৭৫ পয়েন্ট।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে গুড গভার্নেন্সের বড় অভাব রয়েছে। আর সেটা নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে শুরু করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ক্ষেত্রেও সত্যি।
“এখন একটা বড় ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন। কারণ এই দুঃসময়ে আমরা কোনো পক্ষের কোনো জোরালো ভূমিকা দেখতে পাচ্ছি না। এক দিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তারল্য সংকটের ফলে পুঁজিবাজারে টাকা আসছে না। অন্যদিকে বিনিয়োগকারীরা আগেই লোকসান করে পুঁজিবাজার থেকে বের হয়ে গেছে।”
মিজানুর রহমান বলেন, “যে গুটিকয় বিনিয়োগকারী ছিল, তারাও শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। আর এ কারণেই ক্রমাগত পতন হচ্ছে।”
২০১০ সালে বড় ধসের পর ২০১৬ সালের শেষ দিকে বাজার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। ২০১৭ সালে মোটামুটি ভালোই গিয়েছিল বাজার। কিন্তু ২০১৮ সাল থেকে আবার পতন শুরু হয়। এবারের ধাক্কায় বাজার নেমে গেছে তলানীতে। তালিকাভুক্ত কোম্পানির এক চতুর্থাংশ শেয়ারের দাম অভিহিত মূল্যের (ফেস ভ্যালু, ১০ টাকা) নিচে নেমে এসেছে। বেশ কিছু কোম্পানির দর ৫ টাকারও কম।
ইয়াওয়ার সায়ীদ বলেন, “কিছু সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার আছে। যেমন নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে যদি ঢেলে সাজানো যায়, তাহলে হয়ত কিছুটা ভালো হবে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ভালো হওয়ার জন্য অন্য সাপোর্ট দরকার।”
পুঁজিবাজারের দুর্দশার পেছনে দেশের অর্থনৈতিক সূচকগুলোর নেতিবাচক অবস্থার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। বড় বড় প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার মাত্রা বেড়ে গেছে।”
নভেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ, অক্টোবর শেষে তা ছিল ১০ দশমিক ০৪ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতিতে যে লক্ষ্য ধরেছে, বর্তমান অংক তার থেকে প্রায় ৫ শতাংশ পয়েন্ট কম।
আর এ বিষয়টিকে ‘এ মুহূর্তে’ বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখছেন অর্থনীতির বিশ্লেষকরা।
চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ব্যাংক থেকে ৪৭ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফেলেছে সরকার। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকেই ৩৭ হাজার ২৬১ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে।
অথচ চলতি অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে সব মিলিয়ে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার। অর্থাৎ ১২ মাসে ব্যাংক থেকে সরকারের যে টাকা ধার করার কথা ছিল, তার পুরোটাই নিয়ে ফেলেছে পাঁচ মাসে।
বাজারের ভবিষ্যৎ কেমন দেখছেন- এ প্রশ্নে ইয়াওয়ার সায়ীদ বলেন, “পুঁজিবাজার তো হঠাৎ করে কয়েক দিনে খারাপ হয়নি যে হঠাৎ করেই ঘুরে দাঁড়াবে। যেহেতু দীর্ঘসময় ধরে খারাপ হচ্ছে, এটা ঘুরে দাঁড়াতেও সময় লাগবে।”