ইতালিকে হারিয়ে চতুর্থবারের মতো বিশ্বকাপ জেতে ব্রাজিল।
Published : 15 Nov 2022, 10:06 AM
দলে সৃষ্টিশীল খেলোয়াড় আর তারকার কোনো অভাব নেই। প্রতিটি বিশ্বকাপেই থাকে ফেভারিটদের তালিকায়। তবুও ফিরতে হয় শূন্য হাতে। চার আসরের মধ্যে তিন শিরোপা জেতা ব্রাজিল হারাল কোথায়? সেই প্রশ্নের জবাব মিলিয়ে ১৯৯৪ আসরে সিংহাসনে বসেন রোমারিও-বেবেতোরা।
যুক্তরাষ্ট্রে ১৭ জুন থেকে ১৭ জুলাই বসে বিশ্বকাপের পঞ্চদশ আসর। ১৯৮৮ সালের ৪ জুলাই জুরিখে ফিফার অধিবেশনে ব্রাজিল ও মরক্কোকে ভোটে হারিয়ে স্বাগতিক হয় উত্তর আমেরিকার দেশটি। ২৪ দলের টুর্নামেন্ট শেষ হয় এই আসর দিয়েই। এরপর থেকে অংশ নেয় ৩২ দল।
গ্রিস, নাইজেরিয়া ও সৌদি আরবের অভিষেক হয় ১৯৯৪ আসর দিয়ে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়া আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে অংশ নেয় প্রথমবার। ১৯৩৮ সালের পর ‘প্রথমবার’ অংশ নেয় জার্মানি। ১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর মিলে যায় দেশটির দুই অংশ।
বরাবরের মতোই স্বাগতিক যুক্তরাষ্ট্র ও শিরোপাধারী জার্মানি খেলে সরাসরি। বাছাই পর্ব পেরিয়ে আসে বাকি ২২ দেশ।
ইউরোপের মোট ১৩টি দেশ অংশ নেয়। লাতিন আমেরিকা থেকে আসে চারটি, আফ্রিকা থেকে তিনটি, এশিয়া থেকে দুটি এবং কনকাকাফ অঞ্চল থেকে দুটি।
প্রথম পর্ব
২৪ দলকে ভাগ করা হয় ৬ গ্রুপে। প্রতিটি গ্রুপের সেরা দুই দল এবং তৃতীয় সেরা চারটি দল যায় পরের রাউন্ডে।
১৬ দলের দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে শুরু হয় নকআউট পর্ব। সেখান থেকে ধাপে ধাপে হয় কোয়ার্টার-ফাইনাল, সেমি-ফাইনাল ও ফাইনাল।
গ্রুপ ‘এ’: যুক্তরাষ্ট্র, রোমানিয়া, সুইজারল্যান্ড, কলম্বিয়া
গ্রুপ ‘বি’: ব্রাজিল, সুইডেন, রাশিয়া, ক্যামেরুন
গ্রুপ ‘সি’: জার্মানি, স্পেন, বলিভিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া
গ্রুপ ‘ডি’: আর্জেন্টিনা, নাইজেরিয়া, বুলগেরিয়া, গ্রিস
গ্রুপ ‘ই’: ইতালি, আয়ারল্যান্ড, মেক্সিকো, নরওয়ে
গ্রুপ ‘এফ’: নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, সৌদি আরব, মরক্কো
গ্রুপ ‘এ’ থেকে শেষ ষোলোয় যায় রোমানিয়া, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র। দুটি জয়ে ৬ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ সেরা হয় রোমানিয়া। একটি করে জয় ও ড্রয়ে সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের পয়েন্ট ৪। গোল পার্থক্যে পিছিয়ে থেকে তৃতীয় হয় স্বাগতিকরা। এক জয়ে ৩ পয়েন্ট নিয়ে চতুর্থ হয় কলম্বিয়া।
যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে লাতিন আমেরিকার দেশটির ২-১ গোলের হারে আত্মঘাতী গোল করে বসেন আন্দ্রেস এসকোবার। টুর্নামেন্ট থেকে কলম্বিয়ার বিদায়ের পর দেশে ফিরে যান এই ডিফেন্ডার। সেখানে আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান তিনি।
গ্রুপ ‘বি’ থেকে শেষ ষোলোয় যায় ব্রাজিল ও সুইডেন। দুই জয় ও এক ড্রয়ে ৭ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ সেরা হয় ব্রাজিল। এক জয় ও দুই ড্রয়ে ৫ পয়েন্ট নিয়ে রানার্সআপ সুইডেন। এক জয়ে ৩ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় হয় রাশিয়া। এক ম্যাচ ড্র করে তলানিতে থেকে বিদায় নেয় ক্যামেরুন।
আফ্রিকার এই দেশটির বিপক্ষেই ইতিহাস গড়েন ওলেহ সালেঙ্কো। রাশিয়ার ৬-১ ব্যবধানের জয়ে একাই করেন পাঁচ গোল। বিশ্বকাপে এক ম্যাচে যা আজও সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড।
গ্রুপ ‘সি’ থেকে পরের ধাপে যায় জার্মানি ও স্পেন। দুই জয় ও এক ড্রয়ে ৭ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ সেরা হয় জার্মানি। এক জয় ও দুই ড্রয়ে ৫ পয়েন্ট নিয়ে রানার্সআপ স্পেন। দুটি ম্যাচ ড্র করে ২ পয়েন্ট পায় দক্ষিণ কোরিয়া। এক ড্রয়ে এক পয়েন্ট বলিভিয়ার।
গ্রুপ ‘ডি’ থেকে পরের ধাপে যায় নাইজেরিয়া, বুলগেরিয়া ও আর্জেন্টিনা।
দুটি করে জয়ে ৬ পয়েন্ট ছিল তিনটি দলেরই। গোল পার্থক্যে গ্রুপ সেরা হয় নাইজেরিয়া। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে গ্রুপ পর্বে জয়ের জন্য রানার্স আপ হয় বুলগেরিয়া। গ্রুপগুলোর তৃতীয় দলগুলোর সেরা চারের একটি হয়ে পরের ধাপে ওঠে আর্জেন্টিনা।
সব ম্যাচে হেরে শূন্য হাতে বিদায় নেয় গ্রিস। হজম করে ১০ গোল, দিতে পারেনি একটিও। ২১ জুন তাদের বিপক্ষে ৪-০ গোলের জয়ে আসরের প্রথম হ্যাটট্রিক করেন আর্জেন্টিনার তারকা স্ট্রাইকার গাব্রিয়েল বাতিস্তুতা।
মাদক পরীক্ষায় ধরা পড়ে নিষিদ্ধ হন দিয়েগো মারাদোনা। বুলগেরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ ছিল বিশ্বকাপে ফুটবলের এই মহাতারকার শেষ ম্যাচ।
গ্রুপ ‘ই’ থেকে শেষ ষোলোয় যায় মেক্সিকো, আয়ারল্যান্ড ও ইতালি। অবিশ্বাস্য লড়াইয়ে এই তিন দলের সঙ্গে নরওয়রও পয়েন্ট ছিল সমান ৪। প্রতিটি দলেরই জয় ও ড্র একটি করে! গোল পার্থক্যও সমান, ০। চার দলের সমান পয়েন্ট ও সমান গোল পার্থক্য থাকা খুবই বিরল। গোল বেশি দেওয়ায় গ্রুপ সেরা হয় মেক্সিকো, রানার্স আপ আয়ারল্যান্ড। ইতালি হয় তৃতীয়। কেবল ১ গোল দিতে পারা নরওয়ে বিদায় নেয় টুর্নামেন্ট থেকে।
গ্রুপ ‘এফ’ থেকে শেষ ষোলোয় যায় নেদারল্যান্ডস, সৌদি আরব ও বেলজিয়াম। ‘ডি’ গ্রুপের মতোই এই তিন দেশ দুটি করে জয়ে ৬ পয়েন্ট করে পায়। গোল পার্থক্যে পিছিয়ে থেকে তৃতীয় হয় বেলজিয়াম। নিজেদের মধ্যে ম্যাচে জেতায় গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয় নেদারল্যান্ডস। সৌদি আরব হয় রানার্স আপ।
তিন ম্যাচেই হেরে বিদায় নেয় মরক্কো। তবে লড়াই কম করেনি তারা। তিনটি হারই ছিল ন্যূনতম ব্যবধানে।
দ্বিতীয় রাউন্ড
শেষ ষোলোর লাইন এমন: জার্মানি-বেলজিয়াম, স্পেন-সুইজারল্যান্ড, রোমানিয়া-আর্জেন্টিনা, সৌদি আরব-সুইডেন, নেদারল্যান্ডস-আয়ারল্যান্ড, ব্রাজিল-যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো-বুলগেরিয়া ও ইতালি-নাইজেরিয়া। এই রাউন্ডে প্রতিদিন ২টি করে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়।
জার্মানি-বেলজিয়াম ম্যাচের গোল উৎসবে শুরু হয় নকআউট পর্ব। প্রথম ৩৮ মিনিটে হয় চার গোল। এর তিনটি দেয় জার্মানরা, একটি বেলজিয়াম। পরে ৯০তম মিনিটে ব্যবধান আরও কমায় তারা। তবে এড়াতে পারেনি হার। ৩-২ ব্যবধানে জিতে কোয়ার্টার-ফাইনালে যায় জার্মানি।
দিনের অন্য ম্যাচে সুইজারল্যান্ডকে ৩-০ গোলে হারায় স্পেন।
সৌদি আরবকে ৩-১ গোলে হারিয়ে এগিয়ে যায় সুইডেন। রোমানিয়ার বিপক্ষে ৩-২ গোলে হেরে যায় মারাদোনার নিষেধাজ্ঞায় এলোমেলো হয়ে যাওয়া আর্জেন্টিনা।
আয়ারল্যান্ডকে ২-০ গোরে হারায় নেদারল্যান্ডস। বেবেতোর একমাত্র গোলে যুক্তরাষ্ট্রকে বিদায় করে দেয় ব্রাজিল।
ইতালিকে বিদায়ের দুয়ার থেকে ফেরান রবের্তো বাজ্জিও। ৮৮তম মিনিটে গোল করে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে সমতা ফেরান সেই সময়ের এই তারকা স্ট্রাইকার। পরে ১০২তম মিনিটে সফল স্পট কিকে এগিয়ে নেন দলকে। ৮৭তম মিনিট পর্যন্ত ১-০ গোলে পিছিয়ে থাকা ইতালি ২-১ ব্যবধানে জিতে যায় কোয়ার্টার-ফাইনালে।
নির্ধারিত সময় ১-১ ড্র থাকার পর মেক্সিকো ও বুলগেরিয়ার ম্যাচ যায় অতিরিক্তি সময়ে। সেখানে জালের দেখা পায়নি কেউই। টাইব্রেকারে ৩-১ গোলে জিতে শেষ আটে যায় বুলগেরিয়া।
কোয়ার্টার-ফাইনাল
শেষ আটে মুখোমুখি: ইতালি-স্পেন, ব্রাজিল-নেদারল্যান্ডস, জার্মানি-বুলগেরিয়া ও রোমানিয়া-সুইডেন। এই রাউন্ডেও প্রতিদিন ২টি করে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়।
৯ জুলাই, দুই বাজ্জিওর গোলে স্পেনকে হারিয়ে সেমি-ফাইনালে যায় ইতালি। উত্তেজনায় ঠাসা অন্য ম্যাচে নেদারল্যান্ডসকে ৩-২ গোলে হারায় ব্রাজিল। পাঁচটি গোলই হয় দ্বিতীয়ার্ধে!
পরদিন ৪৭তম মিনিটে সফল স্পট কিকে জার্মানিকে এগিয়ে নেন লোথার মাথেউস। এরপর নাটকীয়ভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে ৭৫ ও ৭৮তম মিনিটে দুটি গোল করে বসে বুলগেরিয়া! ২-১ গোলের নাটকীয় হারে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেয় শিরোপাধারী জার্মানি।
৯০ মিনিটে ১-১ সমতা থাকার পর রোমানিয়া ও সুইডেনের লড়াই যায় অতিরিক্ত সময়ে। সেখানেও দুই দল গোল করে একটি করে। পরে টাইব্রেকারে ৫-৪ ব্যবধানে জিতে এগিয়ে যায় সুইডেন।
সেমি-ফাইনাল
১৩ জুলাই, ফাইনালে যাওয়ার লড়াইয়ে মুখোমুখি হয় ইতালি ও বুলগেরিয়া। ২১ ও ২৫ মিনিটে দুই গোল করেন রবের্তো বাজ্জিও। ৪৪তম মিনিটে একটি গোল শোধ করে বুলগেরিয়া। কিন্তু ইতালির প্রবল প্রতিরোধ ভেঙে সমতা আর ফেরাতে পারেনি তারা।
২-১ গোলের জয়ে ফাইনালে ওঠে ইতালি।
অন্য সেমি-ফাইনালে ব্রাজিলের একের পর এক আক্রমণ রুখে দিতে থাকে সুইডেন। অবশেষে ৮০তম মিনিটে জাল খুঁজে নেন রোমারিও। ১-০ গোলের জয়ে ফাইনালে যায় ব্রাজিল।
তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে সুইডেনের বিপক্ষে ৪-০ গোলে হেরে চতুর্থ হয় বুলগেরিয়া। এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে এটাই তাদের সেরা ফল।
ফাইনাল
আগের আসরে প্রথম দল হিসেবে ফাইনালে গোল করতে ব্যর্থ হয়েছিল আর্জেন্টিনা। এবার নির্ধারিত ৯০ মিনিটের পর অতিরিক্ত সময়েও গোল করতে ব্যর্থ হলো ব্রাজিল ও ইতালি।
রোজ বোল স্টেডিয়ামে ৯৪ হাজারের বেশি দর্শক প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনালে দেখেন টাইব্রেকার। স্নায়ুর চাপ ধরে রেখে ৩-২ ব্যবধানে জিতে চতুর্থ শিরোপা জয়ের উল্লাসে মাতে ব্রাজিল, ১৯৭০ আসরের পর প্রথম।
এক নজরে পঞ্চদশ বিশ্বকাপ
· স্বাগতিক: যুক্তরাষ্ট্র
· চ্যাম্পিয়ন: ব্রাজিল
· রানার্সআপ: ইতালি
· মোট ম্যাচ: ৫২
· মোট গোল: ১৪১
· গোল গড়: ২.৭১
· সর্বোচ্চ গোলদাতা: রিস্তো স্তইচকভ (বুলগেরিয়া), ওলেগ সালেঙ্কো (রাশিয়া)- ৬ গোল
· সেরা খেলোয়াড়: রোমারিও (ব্রাজিল)