বিশ্বকাপ মহাযজ্ঞে মানবেতর জীবন: বাংলাদেশি শ্রমিকের ছুটি ছাড়া ৩ বছর

‘আধুনিক যুগের দাসত্ব’-২০১৩ সালে ‘দ্য গার্ডিয়ানে’র এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে কাতার বিশ্বকাপের জন্য নির্মিতব্য বিভিন্ন স্থাপনায় কর্মরত শ্রমিকদের ‘অমানবিক’ জীবনযাপনের বর্ণনায় এমন মন্তব্য করা হয়েছিল। সেই থেকে দেশটির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ বারবার উঠেছে। বিরূপ পরিস্থিতি সামাল দিতে শ্রম আইনে কিছু পরিবর্তনও আনে দেশটি; কিন্তু আদৌতে মূল সমস্যার কতটা সমাধান হয়েছিল, তা তর্কসাপেক্ষ। ফুটবলের বৈশ্বিক আসরটি মাঠে গড়ানোর আর সাত মাসের মতো বাকি থাকতে পুরনো বিষয়টি আবারও নতুন করে সামনে এলো অ্যামনেস্টির একটি প্রতিবেদন।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 April 2022, 07:37 PM
Updated : 7 April 2022, 07:39 PM

সেখানেই আব্দুল নামের এক বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিক জানান-তিন বছর ধরে তিনি কোনো সাপ্তাহিক ছুটি পাননি।

কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা সেই শুরু থেকেই চলছে। ২০১৮ ও ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক নির্বাচন ঘিরে ঘুষ কেলেঙ্কারির অভিযোগও উঠেছে অনেকবার।

দুর্নীতির দায়ে নিষিদ্ধ হওয়া ফিফার সাবেক সভাপতি জেপ ব্লাটার কয়েকবার উপসাগরীয় দেশটিতে বিশ্বকাপ আয়োজনের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল বলেও স্বীকার করেছিলেন। সেসব এখন সুদূর অতীত। অনেক অভিযোগ, আলোচনা-সমালোচনার পথ মাড়িয়ে আগামী ২১ নভেম্বর মাঠে গড়াতে যাচ্ছে প্রতিযোগিতাটি।

তবে, দেশটিতে অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এখনও আছে আগের মতোই।

বিশ্বকাপ এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু প্রকল্পে কাজ করা নিরাপত্তা রক্ষীদের সঙ্গে কথা বলেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি। তাদের প্রতিবেদনে নিরাপত্তা রক্ষী, অভিবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের বিরূপ আচরণ, বিধি অনুযায়ী সাপ্তাহিক ছুটি না দেওয়াসহ নানা অসঙ্গতি উঠে এসেছে। এর প্রেক্ষিতে অ্যামনেস্টি প্রশ্ন তুলেছে-বাধ্যতামূলক শ্রমের সীমা কতটুকু?

গত শুক্রবার কাতারের দোহায় জমকালো আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বকাপের ড্র। এর কয়েক দিন পরই অ্যামনেস্টি প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। যেখানে আটটি বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানির ৩৪ জন কর্মীর সঙ্গে কথা বলে তাদের ‘মানবেতর’ জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিবাসী শ্রমিকরা কাতারে মাসের পর মাস, এমনকি বছরে পর বছর কাজ করেছেন কোনো সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়াই।

ওই শ্রমিকদের বেশিরভাগই জানিয়েছেন, কাতারের আইন অনুযায়ী সাপ্তাহিক যে ছুটি পাওয়ার কথা, তারা সেটা পাননি। আর যারা ওই ছুটি কাটিয়েছেন, তাদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে মজুরি কর্তন করে।

অ্যামনেস্টি বলছে, মধ্য প্রাচ্যের দেশটিতে কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিশ্বকাপের ফুটবল মাঠ এবং বিশ্বকাপের জন্য অপরিহার্য প্রকল্পগুলোর জন্য কর্মী সরবরাহ করেছিল।

কাতারে সম্প্রতি হওয়া ২০২০ ক্লাব বিশ্বকাপ এবং ২০২১ ফিফা আরব কাপের জন্য ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কমপক্ষে তিনটি প্রতিষ্ঠান নিরাপত্তা রক্ষী সরবরাহ করেছিল।

অ্যামনেস্টি জানিয়েছে, ফিফা কিংবা বিশ্বকাপের আয়োজক ‘সুপ্রিম কমিটি ফর ডেলিভারি অ্যান্ড লেগাসি’ (এসসি) ওই তিন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুটির সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করেনি। ফিফা কিংবা এসসি কোনো কর্তৃপক্ষই চুক্তি নবায়ন না করার বিষয়ে ‘দায়িত্বশীল এবং স্বচ্ছ্বভাবে’ বিস্তারিত কিছু বলেনি।

যথাসময়ে এবং যথাযথভাবে কর্মীদের সঙ্গে এমন আচরণের বিষয়টি শনাক্ত ও মোকাবেলা না করে কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো জটিল করে তুলেছে বলে মনে করে অ্যামনেস্টি।

এসসি অবশ্য তাদের বিবৃতিতে অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

“দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২০২০ ক্লাব বিশ্বকাপ ও ২০২১ আরব কাপের সময় ওই তিনটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বেশ কিছু ক্ষেত্রে অসঙ্গতি পাওয়া গিয়েছিল।”

অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে কাতারে হোটেলে নিরাপত্তা রক্ষীর কাজ করা কেনিয়ার এক নাগরিকের কথা। বাংলাদেশের ওই শ্রমিকের মতো তিনিও জানিয়েছেন, এমনও সময় গেছে যখন তিনি মাসের পর মাস কাজ করেছেন কোনো ছুটি ছাড়া।

দেশটিতে শ্রমিকদের ভাষা, জাতীয়তা ও বর্ণভেদেও বৈষম্য করা হয় বলে অভিযোগ এনেছে অ্যামনেস্টি।

কাতারের আইন অনুযায়ী, একজন শ্রমিকের ওভারটাইমসহ সাপ্তাহিক সর্বোচ্চ কর্মঘণ্টা ৬০ ঘণ্টা এবং প্রত্যেকের পুরো পারিশ্রমিকসহ সপ্তাহে একদিন বিশ্রাম (ডে-অফ) পাওয়ার কথা।

অ্যামনেস্টির দাবি, ৩৪ জন নিরাপত্তা রক্ষীর ২৯ জন তাদের জানিয়েছে, প্রতিদিন তারা নিয়মিত ১২ ঘণ্টা কাজ করেছেন। ২৮ জন বলেছেন, তাদেরকে সাপ্তাহিক ছুটি দেওয়া হয় না। যার অর্থ হচ্ছে, অনেক শ্রমিক প্রতি সপ্তাহে ৮৪ ঘণ্টা করে কাজ করেন।

দ্য গার্ডিয়ানের গত বছর ফেব্রুয়ারির এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, কাতার বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বত্ব পাওয়ার পর থেকে দেশটিতে সাড়ে ৬ হাজারের বেশি শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার নাগরিক ছিলেন তারা। 

এর অর্থ হলো, কাতারে ২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকে এই পাঁচ দেশের গড়ে ১২ জন করে শ্রমিক মারা গেছেন প্রতি সপ্তাহে।

২০১০-২০২০ পর্যন্ত সময়কালে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী বিশ্বকাপের দেশটিতে মারা গেছে ৫ হাজার ৯২৭ জন। কাতারে পাকিস্তানি দুতাবাসের দেওয়া তথ্যমতে, ওই ১০ বছরে মারা গিয়েছিল ৮২৪ জন।

মোট মৃত্যুর সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি বলেই ধারণা করা হয়। কারণ, মৃত্যুর ওই সংখ্যার মধ্যে ফিলিপিন্স ও কেনিয়ার মতো দেশগুলোর হিসাব নেই, যারা অনেক বেশি শ্রমিক কাতারে পাঠিয়েছে। ২০২০ সালের শেষ কয়েক মাসের তথ্যও এখানে যোগ করা হয়নি।

গার্ডিয়ানের গত বছরের ওই প্রতিবেদনের পরও কেটেছে অনেক সময়।