বার্সেলোনার গোলের তোড়ে ভেসে গেল রিয়াল

বার্সেলোনা কী করতে পারে সেটা দেখানোর উপযুক্ত মঞ্চ ক্লাসিকো- কোচের এমন উজ্জীবনী বার্তায় জেগে উঠল পুরো দল। খেলল অবিশ্বাস্য সুন্দর ফুটবল। দখল নিল মাঝমাঠের, আক্রমণভাগ হয়ে উঠল বিধ্বংসী। খেই হারানো রিয়াল মাদ্রিদ কোনো জবাব খুঁজে পেল না। ক্লাসিকোয় চিরপ্রতিদ্বন্দীদের উড়িয়ে কাতালান ক্লাবটি যেন দিল বার্তা- পালাবদলের অধ্যায় শেষ, নতুন মোড়কে ফিরছে পুরনো বার্সেলোনা।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 March 2022, 09:53 PM
Updated : 21 March 2022, 11:14 AM

ম্যাচের আগে যে ফল কেউ ভাবতে পারেনি, সেটাই স্কোরলাইনে ধরা দিল। বিস্ময়ের সব মাত্রা ছাপিয়ে সান্তিয়াগো বের্নাবেউয়ে গোল উৎসব করল বার্সেলোনা। রিয়ালকে গুঁড়িয়ে দিল ৪-০ গোলে।

দুই অর্ধে দুটি করে গোল করে বার্সেলোনা। পিয়েরে-এমেরিক অবামেয়াং দলকে এগিয়ে দেওয়ার পর ব্যবধান দ্বিগুণ করেন রোনালদ আরাহো। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই ফেররান তরেস জালে বল পাঠানোর খানিক পরই নিজের দ্বিতীয় গোলটি করেন অবামেয়াং।

এই গোলগুলো বাদেও পুরো ম্যাচে অসংখ্য সুযোগ তৈরি করেছে বার্সেলোনা। প্রায় ৬০ শতাংশ সময় বল দখলে রেখে গোলের উদ্দেশ্যে ১৮টি শট নেয় তারা, যার ১০টি লক্ষ্যে। অবামেয়াং, ফেররান, উসমান দেম্বেলে নিশ্চিত কয়েকটি সুযোগ নষ্ট না করলে ব্যবধান হতে পারত আরও বড়।

চোটে খেলতে না পারা করিম বেনজেমার অনুপস্থিতি রিয়ালের আক্রমণভাগে ফুটে ওঠে প্রকটভাবে। তাদের ১৪ শটের কেবল চারটিই থাকে লক্ষ্যে।

ফরাসি তারকার শূন্যতা পূরণে আনচেলত্তি যে ৪-১-৪-১ ফরমেশন সাজান, তা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। মাঝমাঠের দখল হারানোর পাশাপাশি রক্ষণ হয়ে পড়ে উন্মুক্ত। যার সুবিধা শতভাগ কাজে লাগিয়েছে প্রতিপক্ষ।

চলতি মৌসুমে লিগে রিয়ালের এটি তৃতীয় হার। আগের দুটি ছিল, গত অক্টোবরে এস্পানিওলের বিপক্ষে ২-১ ও জানুয়ারিতে গেতাফের বিপক্ষে ১-০। ঘরের মাঠে হারল এই প্রথম।

বিপরীতে শাভি এরনান্দেসের ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া বার্সেলোনা যেন হারতেই ভুলে গেছে। কিছুদিন আগেও যারা এক ম্যাচ জিতলে পরের ম্যাচে জয়ের পথ ভুলে যেত, তারাই এই নিয়ে লিগে জিতল টানা ৫ ম্যাচ। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে অপরাজিত রইল টানা ১২ ম্যাচ, এর মধ্যে জয় ৯টি।

দারুণ ছন্দে থাকা দুই দলের লড়াই শুরুতেই উত্তাপ ছড়ায়। ম্যাচ শুরুর ১২ সেকেন্ডের মাথায় ফেররানকে আটকাতে ফাউল করেন রিয়াল ডিফেন্ডার এদের মিলতাও।

প্রথম উল্লেখযোগ্য সুযোগ রিয়াল পায় পঞ্চম মিনিটে। ডান দিক দিয়ে ডি-বক্সে ঢুকে রদ্রিগোর নেওয়া শট হয় লক্ষ্যভ্রষ্ট। দুই মিনিট পর গতির ঝলক দেখিয়ে বক্সে ঢুকে আরাহোকে কাটিয়ে কাটব্যাক করেন ভিনিসিউস জুনিয়র। ছুটে এসে ফেদে ভালভেরদের নিচু শট ঝাঁপিয়ে ঠেকান মার্ক-আন্ড্রে টের স্টেগেন।

দ্বাদশ মিনিটে থিবো কোর্তোয়ার ডাবল সেভে বেঁচে যায় রিয়াল। ফেররানের পাস ছয় গজ বক্সের বাইরে ফাঁকায় পেয়ে অবামেয়াংয়ের নেওয়া শট দারুণ রিফ্লেক্সে ঠেকিয়ে দেন গোলরক্ষক। আলগা বল পেয়ে দেম্বেলের শট কোনোমতে ঝাঁপিয়ে ঠেকান কোর্তোয়া।

চার মিনিট পর প্রায় ২২ গজ দূর থেকে ফেররানের শট দূরের পোস্ট ঘেঁষে বাইরে যায়। ২৪তম মিনিটে সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারেননি এই স্প্যানিশ ফরোয়ার্ড। পেদ্রির উঁচু বল বক্সে পেয়ে তার নেওয়া শট দারুণভাবে ব্লক করেন এদের মিলিতাও।

২৯তম মিনিটে আর বাঁচতে পারেনি রিয়াল। ক্যারিয়ারে নতুন উদ্যম খুঁজে পাওয়া দেম্বেলে ডান দিক থেকে দারুণ ক্রস বাড়ান আর কোনাকুনি হেডে ঠিকানা খুঁজে নেন অবামেয়াং। রিয়ালের দুঃস্বপ্নময় রাতের শুরুও হয়।

গোল পেয়ে আরও উজ্জ্বীবিত হয়ে ওঠে বার্সেলোনা। ৩৫তম মিনিটে অবশ্য সমতা টানার দারুণ সুযোগ পেয়েছিলেন ভিনিসিউস। প্রতি-আক্রমণে সবাইকে পেছনে ফেলে ওয়ান-অন-ওয়ানে গোলরক্ষককে কাটাতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলেন ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড। ভারসাম্য হারিয়ে নিজেই পড়ে যান।

এর তিন মিনিট পর রিয়াল সমর্থকদের স্তব্ধ করে দেয় আরাহোর গোল। অ্যাসিস্টের ভূমিকায় আবারও দেম্বেলে। তার আরেকটি দারুণ ক্রসে লাফিয়ে হেডে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন উরুগুয়ের ডিফেন্ডার।

চলতি মৌসুমে অনেকবার দেখা গেছে, খাদের কিনারা থেকে রিয়ালের ঘুরে দাঁড়ানোর ঘটনা। এখানে তাদের সেই সুযোগই দেয়নি বার্সেলোনা।

বিরতির পর ম্যাচ শুরুর ১৭ সেকেন্ডের মাথায়ই প্রতি-আক্রমণে গোলরক্ষককে একা পেয়ে যান ফেররান। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে বাইরে মেরে বসেন তিনি।

পরের মিনিটেই সেই হতাশা মুছে দেন ফেররান। অবামেয়াংয়ের ছোট পাস বক্সে পেয়ে গোলরক্ষককে পরাস্ত করেন ম্যানচেস্টার সিটি থেকে জানুয়ারিতে কাম্প নউয়ে আসা এই তরুণ।

তিন গোল খেয়ে দিশা হারিয়ে ফেলা রিয়াল চার মিনিট পরই হজম করে চার নম্বরটি। নিজেদের অর্ধ থেকে ফেররানের উদ্দেশ্যে উঁচু করে বল বাড়ান জেরার্দ পিকে। সঙ্গে লেগে থাকা ডিফেন্ডারের বাধা এড়িয়ে তিনি পাস দেন অবামেয়াংকে। লক্ষ্যভেদে কোনো ভুল করেননি তিনি। এসময় পেছনেই ছিলেন মিলিতাও, কিন্তু তারা সবাই যেন ভেবেই নিয়েছিলেন বাজবে অফসাইডের বাঁশি। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে ভিএআর জানায় গোল এবং স্কোরলাইন ৪-০।

ঠিক এক মাস আগে লিগে ভালেন্সিয়ার বিপক্ষে হ্যাটট্রিক দিয়ে বার্সেলোনার জার্সিতে গোলের খাতা খুলেছিলেন অবামেয়াং। গ্যাবনের এই ফরোয়ার্ডের এখন গোল হয়ে গেল ৯টি।

রিয়ালের বিপক্ষে অবামেয়াংয়ের গোলের পরিসংখ্যানটাও বিস্ময় জাগানিয়া। তাদের বিপক্ষে এই নিয়ে পাঁচবার খেলতে নেমে প্রতি ম্যাচেই জালের দেখা পেলেন তিনি এবং এই ম্যাচগুলোয় তার গোল হলো ৭টি। ২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপ পর্বে বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের হয়ে চার ম্যাচে করেছিলেন আগের ৫ গোল।

পরিসংখ্যানের একটা পাতায় প্রথমও হয়ে গেছেন অবামেয়াং; একবিংশ শতাব্দীতে রিয়ালের বিপক্ষে আর কেউ টানা পাঁচ ম্যাচে গোল করতে পারেনি।

৫৭তম মিনিটে অবামেয়াংয়ের হ্যাটট্রিকও হতে পারত। কিন্তু বাঁ থেকে জর্দি আলবার পাস ছয় গজ বক্সে ফাঁকায় পেয়ে শট লক্ষ্যে রাখতে পারেননি তিনি। তিন মিনিট পর ফেররানের জোরাল শট ঝাঁপিয়ে ঠেকান কোর্তোয়া।

এরপরেও তারা সুযোগ তৈরি করেছে আরও কয়েকটি। ৬৪তম মিনিটে যেমন আরও একবার উন্মুক্ত হয়ে পড়ে রিয়ালের রক্ষণ। তবে ফেররানের এই শটও রুখে দেন বেলজিয়ান গোলরক্ষক।

চার গোল খেয়ে রিয়াল অনেকটাই ছন্নছাড়া হয়ে পড়ে। তাদের খেলোয়াড়দের শরীরী ভাষাতেও ফুটে উঠছিল তা। বাকি সময়ে কয়েকটি সুযোগ অবশ্য তৈরি করেছিল তারা, কিন্তু সান্ত্বনাসূচক গোলের জন্যও তা যথেষ্ট হয়নি।

লিগে আগের চার ক্লাসিকোতেই হেরেছিল বার্সেলোনা, সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে সংখ্যাটা ছিল পাঁচ। এ ম্যাচেও রিয়ালের জয়ের সম্ভাবনাই দেখেছিল অনেকে। সব সম্ভাবনাকে মিথ্যে প্রমাণ করে দিল বার্সেলোনা।

এখানে হারলেও লিগ টেবিলে রিয়ালের শীর্ষে অবস্থান অবশ্য সুসংহতই থাকছে। ২৯ ম্যাচে ২০ জয় ও ৬ ড্রয়ে তাদের পয়েন্ট ৬৬। ৫৭ পয়েন্ট নিয়ে দুইয়ে সেভিয়া।

এক ম্যাচ কম খেলা বার্সেলোনা ৫৪ পয়েন্ট নিয়ে আছে তৃতীয় স্থানে।