ফ্লিকের ছোঁয়ায় জার্মান ফুটবলে আশার আলো

চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দল। তিনবারের ইউরো জয়ী। অর্জনের ঝুলিতে আছে একটি ফিফা কনফেডারেশন্স কাপও। কেবল এসব সাফল্যই নয়, আক্রমণাত্মক কৌশলে দাপুটে ফুটবলের জন্যও পরিচিত দল জার্মানি। ফুটবল বিশ্বের এই পরাশক্তিই কিনা গত কয়েক বছর ধরে নিজেদের হারিয়ে খুঁজছিল। পরপর দুটি মেজর টুর্নামেন্টে ব্যর্থতা, একের পর এক বাজে পারফরম্যান্সে দলটি যেন হয়ে পড়েছিল গৌরবময় অতীতের কঙ্কাল। তবে হান্স ফ্লিকের কোচিংয়ে আলোর রেখা খুঁজে পেয়েছে তারা। আবারও পুরনো রুপে ফিরতে শুরু করেছে সবশেষ ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ জয়ীরা।

আবু হোসেন পরাগবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Oct 2021, 10:06 AM
Updated : 13 Oct 2021, 10:57 AM

বেশিদিন আগের কথা নয়। ছয় মাস আগে নিজেদের ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অঘটনগুলোর একটির শিকার হয় জার্মানি। গত মার্চে নর্থ মেসিডোনিয়ার বিপক্ষে প্রথমবারের মতো খেলতে নেমে তারা হেরে যায় ২-১ গোলে। নিজেদের ইতিহাসে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ঘরের মাঠে যা তাদের মাত্র তৃতীয় হার। একই সঙ্গে থেমে যায় বাছাইয়ে তাদের ৩৫ ম্যাচের অপরাজেয় যাত্রাও। ২০১৮ বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়ার পর ওই হারকে জার্মান ফুটবলের দুর্দশার আরেকটি উদাহরণ হিসেবে দেখছিল অনেকেই।   

ওই ম্যাচের সপ্তাহ তিনেক আগে ইওয়াখিম লুভ জানিয়ে দেন, ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের পর শেষ হবে জার্মানির কোচ হিসেবে তার ১৫ বছরের পথচলা। পরে ইউরোপিয়ান আসরও ভালো কাটেনি দলটির জন্য। গ্রুপ পর্বে তিন ম্যাচের মধ্যে জিততে পারে স্রেফ একটি। শেষ ষোলো থেকে বিদায় নেয় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২-০ গোলে হেরে। 

মাঝে উয়েফা নেশন্স লিগের দুই আসরেও ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খায় জার্মানি। টুর্নামেন্টের অভিষেক আসরে চার ম্যাচ খেলে জয়শূন্য থাকে দলটি। তিন দলের গ্রুপে সবার নিচে থাকায় পরের আসরে লিগ ‘এ’ থেকে লিগ ‘বি’তে নেমে যেতে হতো তাদের। কিন্তু পরের আসর থেকে নিয়মে পরিবর্তন (গ্রুপে একটি দল বাড়ে) আসায় লিগ ‘এ’তে টিকে যায় জার্মানরা। 

দলটির পারফরম্যান্সে অবশ্য তেমন পরিবর্তন আসেনি। আসরের তৃতীয় ম্যাচে গিয়ে পায় (টুর্নামেন্টের দুই আসর মিলিয়ে সপ্তম ম্যাচে) প্রথম জয়ের স্বাদ। মাঝে স্পেনের কাছে হারে ৬-০ গোলে, প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে যা জার্মানির সবচেয়ে বাজে হারের রেকর্ড। ছয় ম্যাচের মধ্যে দুটি জিতে নিজেদের গ্রুপে দুইয়ে থেকে আসর শেষ করে তারা।

লুভের কোচিংয়ে জার্মানি ২০১৪ বিশ্বকাপ জিতলেও গত কয়েক বছরের বাজে পারফরম্যান্সে সেই সাফল্য যেন মনে হচ্ছিল সুদূর অতীত।

বায়ার্ন মিউনিখের কোচ হিসেবে সাফল্যমণ্ডিত ১৮ মাসের অধ্যায় শেষে জার্মানির দায়িত্ব নেন ফ্লিক। এরপরই যেন পুরনো রূপে ফিরতে শুরু করে মানুয়েল নয়ার ও তার সতীর্থরা।

নর্থ মেসিডোনিয়ার বিপক্ষে ওই হারের পর ব্যর্থ ইউরো মিশন শেষে ফ্লিকের কোচিংয়ে বাছাইয়ে ফিরে জিততে শুরু করে দলটি। প্রথম চার ম্যাচের সবকটিতে জয়ের পথে প্রথম তিনটিতে নিজেদের জাল অক্ষত রেখে তারা প্রতিপক্ষের জালে বল পাঠায় ১২ বার। চলে আসে বিশ্বকাপের টিকেট পাওয়ার খুব কাছে।

এরপর গত সোমবার মেসিডোনিয়াকেই ৪-০ গোলে উড়িয়ে পুরনো ক্ষতে প্রলেপ দেয় তারা। একই সঙ্গে প্রথম দল হিসেবে বাছাই পেরিয়ে কাতার বিশ্বকাপের মূল পর্বে জায়গা করে নেয় জার্মানি। বাছাইয়ে এখনও তাদের ম্যাচ বাকি দুটি।      

গত মার্চে মেসিডোনিয়ার বিপক্ষে যখন হারে জার্মানি, তাদের প্রতিপক্ষরা তখন র‍্যাঙ্কিংয়ে ছিল ৬৫তম স্থানে। ম্যাচটিতে চরমভাবে ফুটে ওঠে লুভের মেয়াদের শেষ দিকের কৌশলগত দুর্বলতা। ম্যাচে যথারীতি বল দখলে আধিপত্য ছিল জার্মানির। তবে সময় যত গড়ায়, ধীরে ধীরে নিচে নেমে খেলতে শুরু করে তারা। আক্রমণে ছিল না ধার। মেসিডোনিয়ার রক্ষণকেও তাই খুব একটা পরীক্ষায় পড়তে হয়নি।

আরও বড় দুর্ভাবনা ছিল, পজেশন হারিয়ে ফেলার পরও তা পুনর্দখলে জার্মানদের মাঝে দেখা যায়নি মরিয়া ভাব। 

ফ্লিক আসায় যেন গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে জার্মান ফুটবল। বায়ার্নে যে কৌশল অবলম্বন করে সফল হয়েছিলেন এই জার্মান কোচ, একই কৌশল তিনি প্রয়োগ করেন জার্মানি জাতীয় দলেও। তাতে দলটির প্রতিপক্ষের ওপর চাপ বাড়ানোর সক্ষমতা বেড়েছে। কিছুদিন আগেও যেখানে তারা বেছে নিত নিরাপদ পথ, রক্ষণভাগ নিয়ে থাকত দ্বিধায়। ফ্লিক সেখানে রক্ষণভাগকে বেশ খানিকটা ওপরে তুলে আনেন, তাতে প্রতিপক্ষের খেলার জায়গা কমিয়ে সাফল্যও মেলে ঢের।

এই ধরনই বায়ার্নের ফুটবলীয় পরিচয়ের আদর্শ বৈশিষ্ট্য। আর যেহেতু জার্মানি দলের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েক জন খেলোয়াড় বায়ার্নের, তাই জাতীয় দল আরও বেশি ‘বাভারিয়ান’ হয়ে উঠেছে। তাদের খেলার সেই ধরন ফিরে এসেছে, যার ওপর ভর করেই ২০০৬ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে একটু একটু করে উঁচুতে উঠেছিল তারা।

এর মানে এই নয় যে, ফ্লিক তার দলে শুধু বায়ার্নের খেলোয়াড়দের দিকেই বেশি নজর দিচ্ছেন এবং অন্য ক্লাবে সেভাবে দৃষ্টি রাখছেন না। বরং চেলসির কোচ টমাস টুখেল, ম্যানচেস্টার সিটির পেপ গুয়ার্দিওলা ও পিএসজির মাওরিসিও পচেত্তিনোর সঙ্গেও তার ভালো যোগাযোগ রয়েছে। তিন জনের দলেই জার্মান জাতীয় দলের খেলোয়াড় আছে।

দলে কৌশলগত পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ফ্লিকের আগে-পরের ভাবনাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যেমন, লেরয় সানেকে ডান দিক থেকে সরিয়ে বাম উইংয়ে নিয়ে আসার আগে তিনি আলোচনা করেন বায়ার্নের বর্তমান কোচ ইউলিয়ান নাগেলসমানের সঙ্গে। নিশ্চিত করেন, দুজন একই পথে আছেন। তাৎক্ষণিকভাবে এর সুফলও মিলেছে।

ফ্লিক জানেন, শুধু আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের আক্রমণ স্বত্বার ওপর নির্ভর করলে চলবে না, তাদের জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা। আর্মেনিয়া ও আইসল্যান্ডের বিপক্ষে সানেকে তাই টাচলাইনের কাছাকাছি খেলান তিনি, যাতে বায়ার্নের এই ফরোয়ার্ড ওয়ান-অন-ওয়ানে আক্রমণে যেতে পারেন। যেখানে তার সক্ষমতা দারুণ। আর সের্গে জিনাব্রি ডান দিকে বিপরীত ভূমিকা পালন করেন। পরিকল্পনা সফল হয়; বারবার প্রতিপক্ষের বিপদসীমায় ভীতি ছড়ানোর পাশাপাশি তিনটি গোল করেন বায়ার্নের এই ফরোয়ার্ড।

ফ্লিকের ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে আক্রমণভাগের জন্য জার্মানির প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড়দের একটি গ্রুপ রয়েছে। অভিজ্ঞ সানে, জিনাব্রি, মার্কো রয়েস, টমাস মুলারদের পাশাপাশি উঠে এসেছে বায়ার্নের জামাল মুসিয়ালা, বায়ার লেভারকুজেনের ফ্লোরিয়ান ভিরৎজ, চেলসির কাই হার্ভাটজের মতো দারুণ প্রতিভাবান সব খেলোয়াড়। তারাই হয়তো এই দশকের পরের অংশে নেতৃত্ব দেবে জার্মানিকে।

সম্ভাবনার তালিকায় আরেক নাম করিম আদেইয়েমি। কয়েক বছর এটাকিং মিডফিল্ডারদের ওপরে তুলে খেলানোর পর জার্মানি সালসবুর্কের ১৯ বছর বয়সী এই স্ট্রাইকারের মাঝেই আবারও পেতে পারে সত্যিকারের ‘নাম্বার নাইন’। 

গুঞ্জন আছে, আগামী গ্রীষ্মের দলবদলে আদেইয়েমিকে পেতে আগ্রহী বায়ার্ন মিউনিখ ও বরুশিয়া ডর্টমুন্ড। মিউনিখে জন্ম নেওয়া এই ফুটবলারকে শৃঙ্খলাজনিত কারণে ১০ বছর বয়সে বায়ার্নের একাডেমি থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। আবারও হয়তো তিনি তার নিজের শহরে ফিরতে চান এবং পরতে চান বায়ার্নের জার্সি। একদিক থেকে তার জন্য ভালোই হয়েছে, বাভারিয়ান ধরনে খেলার স্বাদ পেয়ে যাচ্ছেন তিনি জাতীয় দলেই। 

২০০৬ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত জার্মানি জাতীয় দলে সহকারী কোচ হিসেবে কাজ করা ফ্লিক যখন বায়ার্নের দায়িত্ব নেন, তখন কঠিন সময় পার করছিল ক্লাবটিও। একের পর এক বাজে পারফরম্যান্সে বুন্ডেসলিগায় চারে নেমে গিয়েছিল তারা। নিকো কোভাচকে বরখাস্ত করে অন্তর্বর্তীকালীন কোচ হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় ফ্লিককে। পরের মাসেই তার সঙ্গে স্থায়ী চুক্তি করে কর্তৃপক্ষ।

ফ্লিকের হাত ধরে ধরে ২০১৯-২০ মৌসুমে ইতিহাস লেখে বায়ার্ন। বার্সেলোনার পর দ্বিতীয় দল হিসেবে বছরে ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক মিলিয়ে ছয় শিরোপার সবগুলোই ঘরে তোলে তারা।

জার্মানিকে তিনি কতটা সাফল্য এনে দিতে পারবেন, তা সময়ই বলে দেবে। তবে শুরুটা যেভাবে আলো ঝলমলে হয়েছে, তাকে ঘিরে নতুন আশায় বুক বাঁধতেই পারে দলটির সমর্থকরা।

জার্মান মিডফিল্ডার লেয়ন গোরেটস্কা অবশ্য পা মাটিতেই রাখছেন। কাতারের টিকেট নিশ্চিত হওয়ার পর সতীর্থদের আরও উন্নতির তাগিদ দিলেন তিনি।

“আমাদের দলটা মানসম্পন্ন। কিন্তু আমাদের দল হিসেবে একসঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। এজন্য আমাদের প্রতিটি অনুশীলন সেশন কাজে লাগাতে হবে। আমরা সঠিক পথেই আছি, কিন্তু এখনও অনেক কাজ বাকি আছে।”

সবশেষ পাঁচ ম্যাচে বায়ার্ন গোল করেছে ১৮টি। যদিও তাদের প্রতিপক্ষ ছিল লিখটেনস্টাইন, আর্মেনিয়া, রোমানিয়া, আইসল্যান্ড ও নর্থ মেসিডোনিয়া, যারা ইউরোপের বড় দলগুলোর থেকে শক্তিমত্তায় অনেক পিছিয়ে।

তবে এখান থেকে পাওয়া আত্মবিশ্বাস সামনের পথচলায় কাজে লাগবে বলে মনে করেন মেসিডোনিয়ার বিপক্ষে একটি গোল করা হার্ভাটজ।

“গত কয়েকটা ম্যাচে আমরা দেখিয়েছি আমাদের দলের মান কেমন, বিশেষ করে ইউরোর পরে। ওই টুর্নামেন্টে তিক্ত অভিজ্ঞতার পর আমরা দ্রুত বিশ্বকাপের মূল পর্বে জায়গা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলাম।”

“এটা (টানা জয়) আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে। তবে আমাদের সামনে এখনও দীর্ঘ পথ বাকি।”