রোনালদোকে পেয়ে সোনালী দিনে ফেরার স্বপ্ন ইউনাইটেডের

এক যুগ আগে ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো যখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে বিদায় বলেছিলেন, তখন তার মতো ক্লাবটিও ছিল সাফল্যের চূড়ায়। কিন্তু রোনালদো নামের নক্ষত্রটি খসে যাওয়ার পর সময়ের পালাবদলে ইংলিশ দলটি এখন ক্ষয়ে যাওয়া এক শক্তির নাম। বয়সের ভারকে তুড়ি মেরে রিয়াল মাদ্রিদ, ইউভেন্তুসে আলো ছড়ানো তারাটি ফিরে এসেছে ইউনাইটেডের আকাশে। সোনালী যুগ ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে ইউনাইটেড। দলটির সমর্থকরাও।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 August 2021, 12:17 PM
Updated : 28 August 2021, 02:23 PM

দুদিন আগেও রোনালদোর ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ফেরার কোনো সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছিল না। উল্টো জোর গুঞ্জন ছিল, ম্যানচেস্টারেরই আরেক ক্লাব সিটিতে পা রাখতে যাচ্ছেন পাঁচবারের বর্ষসেরা ফুটবলার। ইউনাইটেড তা হতে দেবে কেন? পিতৃতুল্য অ্যালেক্স ফার্গুসনের এক ফোন কলেই মত বদলে ফেললেন সময়ের সেরা দুই ফুটবলারের অন্যতম তারকা। সাবেক-বর্তমান সতীর্থরাও দু’হাত বাড়িয়ে দিলেন।

ফলাফল-কয়েক ঘণ্টার নাটকীয়তায় পুরনো ঠিকানায় ফেরার আনুষ্ঠানিকতা সেরে ফেললেন রোনালদো। এক টুইটে শুক্রবার ঘরের ছেলের ঘরে ফেরার বিষয়টি নিশ্চিত করে ইউনাইটেড। চুক্তির মেয়াদ ও ট্রান্সফার ফির বিষয়ে অবশ্য কিছু জানানো হয়নি।

২০০৩ সালে ফার্গুসনের হাত ধরে ১৮ বছর বয়সে ইউনাইটেডে পা রেখেছিলেন রোনালদো। তার ওপর কিংবদন্তি ওই কোচের আস্থা ছিল অনেক, যার এতটুকুও ভুল ছিল না। নতুন ঠিকানায় পা রেখে কঠিন চ্যালেঞ্জ জিতেছিলেন অল্প সময়েই। পাঁচ বছরের মাথায় দলকে প্রিমিয়ার লিগ ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতিয়ে উঁচিয়ে ধরেন বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার ব্যালন ডি’অর ও ফিফা বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। হয়ে ওঠেন ফার্গুসনের প্রিয়পাত্র।

২০০৭-০৮ এর আগে-পরের মৌসুমেও লিগ শিরোপা জিতেছিল ইউনাইটেড। টানা তিনটি প্রিমিয়ার লিগ জিতে ২০০৯ সালে ওই সময়ের রেকর্ড ট্রান্সফার ফিতে রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেন রোনালদো।

২০০৩ সালের অগাস্টে প্রিমিয়ার লিগে অভিষেক ও ২০০৯ সালে শেষ ম্যাচের মাঝের সময়ে ইংল্যান্ডের শীর্ষ প্রতিযোগিতাটিতে তার চেয়ে বেশি গোল আছে কেবল থিয়েরি অঁরির; রোনালদোর গোল ৮৪টি, অঁরির ৯২।

ইউনাইটেডের ২০০৮-০৯ মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ফাইনালে ওঠায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল রোনালদোর। ক্লাবটির হয়ে ইউরোপ সেরা প্রতিযোগিতায় ৫২ ম্যাচ খেলে ১৫টি গোল করেছিলেন তিনি। এর মাঝে ২০০৭-০৮ আসরের ফাইনালে চেলসির বিপক্ষে করেছিলেন গোল।

ইউনাইটেডের জার্সিতে কেবল রুড ফন নিস্টলরয়ই চ্যাম্পিয়ন্স লিগের এক আসরে রোনালদোর চেয়ে বেশি গোল করেছেন।

রিয়ালে গিয়ে নিজেকে আরও উঁচুতে তুলে ধরেন রোনালদো। সেখানে ৯ বছরের ক্যারিয়ারে চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও দুটি লা লিগাসহ জেতেন অনেক শিরোপা। ক্লাবটির ইতিহাসে ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সর্বোচ্চ গোলসহ গড়েন অনেক অনেক রেকর্ড।

ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে এখনও প্রিয় রোনালদো। ইউনাইটেড ছেড়ে গেলেও ক্লাবটির সমর্থকদের মনে ঠিকই রয়ে গেছেন তিনি। ২০১৩ সালে রিয়ালের হয়ে পা রেখেছিলেন ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের চেনা আঙিনায়। গোল করে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে সাবেক দলকে বিদায় করে দিয়েছিলেন; তারপরও রেড ডেভিলস সমর্থকদের প্রিয় পাত্র হয়েই ছিলেন তিনি। গ্যালারিতে পুরো ম্যাচেই তার নামে গান শোনা গেয়েছিল।

রোনালদোর মনেও অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে ইউনাইটেড। বিশেষ করে ফার্গুসনের অবদানের কথা কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করেছেন অনেকবার, “ফুটবলে তিনি আমার পিতার সমান, আমার ক্যারিয়ারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একজন।”

বয়স পেরিয়ে গেছে ৩৬, পায়ের সেই তেজ স্বাভাবিকভাবে কমেছে কিছুটা; তবে রোনালদোর গোল করার ক্ষুধা এখনও আছে আগের মতোই অটুট। সেরি আর গত মৌসুমেও শীর্ষ গোলদাতা তিনি। গত মাসে শেষ হওয়া ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপেও করেন সর্বোচ্চ ৫ গোল। ছাড়িয়ে যান আন্তর্জাতিক ফুটবলে আগের রেকর্ড গোলদাতা আলি দাইকে।

কিন্তু ১৮ বছর আগে টিনএজার হিসেবে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে যোগ দিয়ে যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন রোনালদো, আজ তা আরও বেশি কঠিন; পথটাও বন্ধুর। সেদিনের ইউনাইটেড ছিল প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়ন আর আজ তারা শীর্ষ চারে লড়াই করা এক দল। কিন্তু রোনালদো ফেরায় নতুন করে স্বপ্নের জাল বুনছে দলটি।

ইউনাইটেড সবশেষ লিগ শিরোপা জিতেছে সেই ২০১২-১৩ মৌসুমে। এরপর তারা শুধু জিতেছে একটি করে ইউরোপা লিগ, এফএ কাপ, লিগ কাপ ও কমিউনিটি শিল্ড। ২০১১ সালের পর থেকে পেরুতে পারেনি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার-ফাইনাল বাধা।

এবার সফল গ্রীষ্মকালীন দলবদলের পর নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে প্রিমিয়ার লিগের রেকর্ড ২০ বারের চ্যাম্পিয়নরা। তরুণ সম্ভাবনাময় মিডফিল্ডার জেডন স্যানচো ও অভিজ্ঞ ডিফেন্ডার রাফায়েল ভারানের পর এবার রোনালদোকে পেল ক্লাবটি।

ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে কাটিয়ে দেওয়া সাবেক ইংলিশ ডিফেন্ডার গ্যারি নেভিলের তো দৃঢ় বিশ্বাস, রোনালদোকে পেয়ে ঘুরে দাঁড়াবে ইউনাইটেড। স্কাই স্পোর্টসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি শোনান সেই আশার কথা।

“রোনালদো আসছে শিরোপা জিততে, ব্যক্তিগত অর্জন সমৃদ্ধ করতে, প্রিমিয়ার লিগকে আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতাময় করে তুলতে। এই রোনালদো ভিন্ন, সবার সেটাই আশা।”

“গত সপ্তাহান্তে চেলসির খেলা দেখে আমি কিছুটা ভয়ই পেয়েছিলাম, জানি সিটি শক্তিশালীই থাকবে, লিভারপুল ভার্জিল ফন ডাইককে ফিরে পেয়েছে(চোট থেকে)। (আগের অবস্থায়) ইউনাইটেড উন্নতি করতে পারতো, তবে শেষ করত ওদের নিচে থেকে। কিন্তু এই খবর (রোনালদোর ফেরা) আমাকে আশা দেখাচ্ছে, তারা দারুণ একটি মৌসুম কাটাবে।”

ইউনাইটেড কোচ, খেলোয়াড় ও সমর্থকরা এবং নেভিলের মতো সাবেকদের কেউ কেউ স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেও অনেক সংশয়বাদীও আছে! তারা আবার অতটা ভরসা পাচ্ছে না! অনেক কারণের মাঝে একটি হতে পারে, চাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের যে লক্ষ্য নিয়ে ইউভেন্তুসে পাড়ি দিয়েছিলেন রোনালদো, তা গত তিন বছরে পূরণ করতে পারেননি তিনি। এই সময়ে প্রতিযোগিতাটির শেষ আটের গণ্ডিই পার হতে পারেনি তুরিনের ক্লাবটি। যদিও ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে ইউভেন্তুসেও উজ্জ্বল ছিলেন তিনি।

গণমাধ্যমের খবর, রোনালদোকে পেতে দুই কোটি পাউন্ডের বেশি খরচ হয়েছে ইউনাইটেডের। সপ্তাহে নাকি তাকে দিতে হবে চার লাখ ৮০ হাজার পাউন্ড, ৩৬ বছর বয়সী একজন খেলোয়াড়ের জন্য অঙ্কটা বেশ বড়ই বলা যায়।

ইউনাইটেড সমর্থকরা অবশ্য অতসব নিয়ে ভাবতে রাজি নয়। নগর প্রতিদ্বন্দ্বী সিটির মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে ঘরের ছেলেকে ফেরানো গেছে, এটাই অনেক বেশি। রোনালদোর অভিজ্ঞতা ও কারিশমায় ভর করে আবারও ক্লাবের সোনালী যুগ ফিরিয়ে আনার একটা জোর সম্ভাবনা দেখছে তারা। যদিও পথটা মসৃণ নয়, কিন্তু ফিরে আসা তারাটির নাম রোনালদো বলেই, ওল্ড ট্র্যাফোর্ড আবারও আলোকিত হওয়ার সম্ভাবনা তো থাকছেই।