‘ইতালিয়ান ফুটবলের পুনর্জাগরণ’

১৩ নভেম্বর ২০১৭, মিলানে যেন অস্তমিত হয় ইতালিয়ান ফুটবলের সূর্য। সেদিন সুইডেনের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করে ও দুই লেগ মিলিয়ে হেরে বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব উতরাতে ব্যর্থ হয় ইতালি। বিশ্ব ফুটবলের পরাশক্তি, চার বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, ফুটবল আভিজাত্যের দেশই কিনা জায়গা করে নিতে পারেনি ৩২ দলের বিশ্বকাপে! বলা হচ্ছিল, ইতালিয়ান ফুটবলের অন্ধকারতম অধ্যায়। সময়ের পালায় সেই ইতালিই এখন উদ্ভাসিত আলোয় ভাস্বর। ইউরোপ সেরার গর্বে উজ্জ্বল।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 July 2021, 06:09 AM
Updated : 12 July 2021, 10:22 AM

অনেক ইতিহাসের স্বাক্ষী লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে রোববার রচিত হলো ইতালিয়ান ফুটবলের নতুন গৌরবগাঁথার। ৬৭ হাজারের বেশি দর্শকে ভরা স্টেডিয়ামে, যাদের বেশির ভাগই গলা ফাটিয়েছেন ইংল্যান্ডের হয়ে, টাইব্রেকারে তাদেরকে স্তব্ধ করে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতে নিল ইতালি। মাঝরাতের উৎসবে যেন উদিত হলো ইতালিয়ান ফুটবলের নতুন সূর্য।

ইতালি কোচ রর্বেতো মানচিনি বলছেন, “একটা চক্র পূরণ হলো, তিন বছরের চক্র।” তা বটে, ২০১৮ সালের মে মাসে তিনি দায়িত্ব নিয়ে ক্রমে বদলে দিলেন ইতালিকে। চিরায়ত ধারার শেকল ভেঙে ইতালি ছুটতে থাকল আগ্রাসী ও গতিময় ফুটবলের রথে।

সেই রথের কোনো থামাথামি নেই। নিজেদের রেকর্ড অপরাজেয় যাত্রায় এখন তারা ইউরোপের সেরা। ৫৩ বছর পর ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের চ্যাম্পিয়ন।

সুইডেনের সঙ্গে ড্র করে নিজেদের দর্শকদের দুয়ো শুনে যেদিন মাঠ ছাড়তে হয়েছিল, সেদিন মুখ লুকানোদের দলে ছিলেন লিওনার্দো বোনুচ্চি। এখন তিনিই নায়ক। রোববারের ফাইনালে ইতালিকে সমতায় ফেরানো গোল তার। পরে টাইব্রেকারেও খুঁজে নেন জাল।

টাইব্রেকার শেষ হতেই, যখন থেমে গেছে স্বাগতিক দর্শকদের ‘ইটস কামিং হোম’ গর্জন, ক্যামেরার সামনে মুখ এনে বোনুচ্চি চিৎকার করছিলেন, ‘ইটস কামিং টু রোম।’

ফাইনালের ম্যাচ সেরা ৩৪ বছর বয়সী এই ডিফেন্ডারই। ফাইনাল জয়ের পর তার উচ্ছ্বাসে মিশে থাকল ইংল্যান্ডের আঙিনায় জয় আর ইউরোপের সেরা হওয়ার গর্ব।

“ডেনমার্ক ম্যাচের (ইংল্যান্ডের সেমি-ফাইনাল জয়) পর থেকেই আমরা প্রতিদিন শুনছিলাম, ‘কাপ আসছে হোমে লন্ডনে।’ তাদের জন্য দুঃখিত। কারণ কাপ আসলে যাচ্ছে রোমে। বিশ্বজুড়ে ইতালিয়ানরা এখন এই সাফল্য উপভোগ করতে পারে।”

ইতালির সাফল্যের দুই নায়ক, অভিজ্ঞ দুই সৈনিক কিয়েল্লিনি ও বোনুচ্চি।

“এই ট্রফি তাদের জন্য (সমর্থক), এটা আমাদের জন্য। প্রথম দিন থেকে বলেছি, আমরা বিশ্বাস করি যে আমরাই এটা পারব। বিশ্বের সব প্রান্তে আজকে উদযাপনের অধিকার তাই কেবল ইতালিরই আছে।”

২০১২ ইউরোর ফাইনালে স্পেনের কাছে ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত হওয়া দলে ছিলেন বোনুচ্চি। ২০১৭ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের সেই ব্যর্থতারও স্বাক্ষী তিনি। তবে অনেক বেদনা সয়েও ভেঙে পড়েননি, হারাননি বিশ্বাস। 

“বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব পেরুতে না পারার হতাশা ছিল আমাদের। তবে বিশ্বাস সবসময় রেখে যেতে হয়। হাল না ছেড়ে সেরা হওয়ার লড়াই চালিয়ে যেতে হয়।”

“এটা অবশ্যই ইতালিয়ান ফুটবলের পুনর্জাগরণ। আমি নিশ্চিত, এই দল ও কোচ সামনে অনেক খবরের শিরোনাম হবে। আমরা স্পেশাল, কারণ যেদিন আমরা একসঙ্গে হয়েছি, একদম সেদিন থেকেই বিশ্বাস রেখেছি যে আমরা পারব।”

শুধু বোনুচ্চিই নয়, বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ব্যর্থ সেই দলের জর্জো কিয়েল্লিনি, জর্জিনিয়ো, চিরো ইম্বোবিলেসহ অনেকেই সেই ব্যর্থতাকে পেছনে ফেলে এবার সাফল্যে রাঙাতে পেরেছেন নিজেদের, ইতালিয়ান ফুটবলকেও।

এই আসরে বোনুচ্চির সঙ্গে রক্ষণে দুর্ভেধ্য দেয়াল গড়ে তুলেছিলেন কিয়েল্লিনি। বয়স হয়ে গেছে ৩৬, কিছুদিন আগেও তার শেষ দেখে ফেলেছিলেন কত জনে! সেই তিনিই অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখিয়ে দলের আস্থা হয়ে রইলেন ম্যাচের পর ম্যাচ। নেতৃত্বের ভারও ছিল তার কাঁধেই।

এটিই হয়ে থাকতে পারে কিয়েল্লিনির শেষ বড় টুর্নামেন্ট। অভিজ্ঞ এই ডিফেন্ডারের তৃপ্তি তাই বেশি। বোনুচ্চির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে তিনিও বললেন টিম স্পিরিটের কথা।

“চোখের পানি ফেলেছি আমি। এই সাফল্য আমাদের প্রাপ্য। এই বয়সে আমরা আরও বেশি করে বুঝতে পারি যে এরকম একটি ট্রফি জয়ের অর্থ কী।”

“মে মাস থেকেই আমরা বলাবলি করছিলাম, এবার যেন আবহই কেমন জাদুকরি, বাতাসেই কিছু যেন আছে। সময়ের সঙ্গে তা বেড়েছে। এবার অন্যরকম একটা আবহ ছিল। এটা অবিশ্বাস্য যে দিনের পর দিন একসঙ্গে কাটিয়েও আমরা পরস্পরের সংস্পর্শে ক্লান্ত হইনি।”