চেলসির ‘ব্রাত্য’ জর্জিনিয়োই ইতালির আলো

বড় কোনো তারকা নন তারা। কেউ কেউ তো ক্লাব ম্যাচে নিয়মিত খেলার সুযোগও পান না। সেই তারা জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চড়ালেই যেন সেরা হয়ে ওঠেন। আজকের ইতালি দলের ছুটে চলার পেছনের গল্প এটাই; সব পজিশনে কার্যকর খেলোয়াড়দের নিয়ে ইউরোপ সেরা হওয়ার এক ধাপ দূরে দাঁড়িয়ে রবের্তো মানচিনির দল।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 July 2021, 03:12 PM
Updated : 9 July 2021, 03:12 PM

টানা ৩৩ ম্যাচ ধরে অপরাজিত থেকে, এবারের ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম পাঁচ ম্যাচের সবকটি জিতে এবং সেমি-ফাইনালে স্পেনকে টাইব্রেকারে হারিয়ে ফাইনালে উঠেছে ইতালি। তাদের ধারাবাহিক সফল এই পথচলার অন্যতম নায়ক মাঝমাঠের সেনা জর্জিনিয়ো। তিনি ওই সব নামগুলোর একজন, যারা কখনোই তারকাখ্যাতি পান না; কিন্তু দেশের হয়ে খেলতে নামলে নিজের কাজটুকু করতে পারদর্শী।

জার্মানির মিরোস্লাভ ক্লোসাও এমন একজন। বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি, জার্মানির ইতিহাসেও; কিন্তু বিশ্বসেরা তারকাদের অভিজাত ক্লাবে কখনোই রাখা হয়নি তাকে। বলা যায় ফ্রান্সের ইতিহাসের সেরা গোলদাতাদের তালিকায় কিংবদন্তি মিশেল প্লাতিনিরও ওপরে দুইয়ে অবস্থান অলিভিয়ে জিরুদের কথাও। ক্লাব ফুটবলে কখনোই তিনি তার দলের অপরিহার্য হতে পারেননি।

জর্জিনিয়োর গল্পটা ঠিক তেমনি। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে চেলসিতে নাম লেখানোর পর থেকে এই বছরের শুরুর আগ পর্যন্ত ক্লাব সমর্থকদেরও মন জয় করতে পারেননি তিনি। নিজের পজিশনে তার মাটি কামড়ে থাকার স্টাইল অনেকেরই পছন্দ নয়। তার তুলনায় আক্রমণাত্মক এনগোলো কঁতেকেই পছন্দ সবার।

ফুটবল বিশেষজ্ঞদেরও প্রশংসা পাননি কখনও। গত মাসে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে চেলসির জয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল জর্জিনিয়োর। কিন্তু ওই ম্যাচের আগেও চেলসি দলে তার জায়গা পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। চেলসির সাবেক মিডফিল্ডার জো কোল যেমন ফাইনালের শুরুর একাদশে তার থাকা নিয়ে বলেছিলেন, ‘তার খেলায় ঘাটতি আছে’।

এত এত সমালোচনা জর্জিনিয়ো শুনেছেন ও অনুভব করেছেন। তবে আত্মবিশ্বাস হারাননি তিনি, হাল ছাড়েননি, লড়াই বন্ধ করেননি।

গত মাসে জর্জিনিয়োকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, টমাস টুখেলের কৌশলে অবশেষে কী মানুষ তার মূল্য বুঝতে পারবে? জবাবে ব্রাজিলে জন্ম নেওয়া এই মিডফিল্ডার বলেছিলেন, “আশা করি। আর যদি এখনও না পারে তাহলে তারা ফুটবল বোঝে না।”

“ফল, সংখ্যাতেই প্রমাণ হয়। তাই কারো যদি ভিন্ন মত থাকে, তারা তা বলতে পারে। কিন্তু সেটা আমার ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না। সমালোচনা সবসময় থাকবেই। বিষয়টা একজন কীভাবে নিবে, সেটাই আসল। আমার জন্য এটা আরও কঠিন পরিশ্রম করার প্রেরণা।”

টুখেলের কোচিংয়ে জর্জিনিয়ো এতটাই উজ্জ্বল ও দলে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন যে চেলসির সমর্থকরা এখন তার প্রশংসায় মেতেছে। গতবছরও সাবেক কোচ ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের কোচিংয়ে চিত্রটা এমন ছিল না।

চলতি বছরের শুরুতে টুখেল চেলসির দায়িত্ব নেওয়ার পর এনগোলো কঁতে ও জর্জিনিয়োকে পাশাপাশি খেলানোর কৌশল বের করেন এবং দিন শেষে তা যথেষ্ট কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। যদিও কঁতের আক্রমণাত্মক ধরনের সঙ্গে জর্জিনিয়োর বল পজেশন রাখার মানসিকতার মাঝে অনেক সমর্থক ফরাসি তারকাকেই সেরার কাতারে দেখেন।

তবে চেলসিতে চিত্রটা যাই হোক না কেন, ইতালি দলে জর্জিনিয়োর গুরুত্ব অপরিসীম।

তার জাতীয় দল সতীর্থ লরেন্সো ইনসিনিয়ে ইউরোর শুরুর দিকে যেমন বলেছিলেন, “চেলসিতে সে দারুণ কয়েকটি বছর কাটিয়েছে এবং আমি তাকে আমাদের দলে পেয়ে গর্বিত।” 

এরই মধ্যে জর্জিনিয়োর ব্যালন ডি’অর জয়ের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। ইনসিনিয়েও বিশ্বাস করেন তাই।

“ব্যালন ডি’অর তার প্রাপ্য কি-না, সেটা আমি নির্ধারণ করার কেউ না। তবে আশা করি, সে সংক্ষিপ্ত তালিকায় থাকবে। সে এর যোগ্য। আমি তাকে প্রফেসর বলে ডাকি এবং আমরা সবাই তার সঙ্গে খেলতে পেরে খুশি।”

ইতালির গণমাধ্যমও এ বিষয়ে আওয়াজ তুলতে শুরু করেছে। ফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ইতালি চ্যাম্পিয়ন হলে জর্জিনিয়ো বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কারটি জিতেও যেতে পারে বলে তাদের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে। এর পেছনের যুক্তি হিসেবে তারা দেখাচ্ছে, একই মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের পর ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ জয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার বিষয়টিকে। 

ইতালি দলে নিকোলা বারেল্লা জ্বালানির যোগান দেন এবং মার্কো ভেরাত্তি ‘ইঞ্জিন’ এর মতো সবকিছু পরিচালিত করেন আর মাঝমাঠের এই ত্রয়ীর হাল ধরে থাকেন ঠাণ্ডা মাথার জর্জিনিয়ো। যিনি চার ডিফেন্ডারের সঙ্গে রক্ষণ সামলানোয়ও গুরুত্বপূর্ণ রাখেন।

স্পেনের বিপক্ষে ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে আটবার প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নেন জর্জিনিয়ো, গত দুই আসরে এক ম্যাচে যা কোনো খেলোয়াড়ের রেকর্ড। অধিকাংশ সময়ই পরিসংখ্যানের এই সংখ্যাগুলো আলোচনায় আসে না। তাই বলে কোনো দলের সাফল্যে এটা মোটেও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

ইংল্যান্ড কোচ গ্যারেথ সাউথগেট যেমন এবারের আসরে অনেকবার কৌশল বদলেছেন। কিন্তু একটা জায়গায় কখনও কোনো বদল আনেননি-দুই হোল্ডিং মিডফিল্ডার রাখা যারা আক্রমণ ও রক্ষণ দুটোর জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ।

আর ইতালি দলে এই দায়িত্বটা একা সামলান জর্জিনিয়ো, দলে যার অবদান অবশেষে পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছে।