খোলা চিঠিতে সব জানালেন জিদান

ক্লাব কর্তাদের থেকে আগের মতো মিলছিল না সমর্থন। উল্টো নানা অপ্রত্যাশিত ঘটনায় দিনে দিনে সবকিছু আরও কঠিন হয়ে উঠছিল। ছিল না ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সাজানোর যথেষ্ট রসদও। প্রতিটি সংবাদ সম্মেলন হয়ে উঠেছিল অসহনীয়। প্রতিদিন ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্নের জবাব দিতে আর কত ভালো লাগে। অবশেষে, লা লিগা শেষ হতেই রিয়াল মাদ্রিদ কোচের দায়িত্ব ছেড়ে দেন জিনেদিন জিদান।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 May 2021, 09:34 AM
Updated : 31 May 2021, 09:46 AM

দুইবারই মেয়াদ শেষের আগে দায়িত্ব ছাড়লেন এই ফরাসি। ২০১৮ সালে সরে গিয়েছিলেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগে হ্যাটট্রিক শিরোপার মুকুট পরে। এবারের শেষ মৌসুমটা শূন্য হাতে। স্প্যানিশ ক্রীড়া পত্রিকা এএসে খোলা চিঠিতে জিদান জানালেন, তার এবারের বিদায়ের প্রেক্ষাপট।

প্রিয় মাদ্রিস্তিরা,

“সেই প্রথম যেদিন মাদ্রিদ শহরে পা রাখলাম আর সাদা জার্সি পরলাম, সেদিন থেকে ২০ বছর ধরে আপনাদের ভালোবাসা পেয়ে আসছি। সব সময়ই অনুভব করেছি, আমাদের মধ্যে বিশেষ কিছু একটা আছে। ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্লাবটির খেলোয়াড় ও কোচ হওয়ার অসাধারণ সম্মান আমি পেয়েছিলাম, কিন্তু সব কিছুর উপরে আমি কেবলই রিয়াল মাদ্রিদের আরেকজন খেলোয়াড়। এই সব কিছুর জন্য বিদায় জানাতে এবং কোচের দায়িত্ব ছাড়ার কারণ জানাতে এই চিঠিটা লিখতে চেয়েছি।”

“আট মাসের বিরতির পর ২০১৯ সালের মার্চে মাদ্রিদের কোচের দায়িত্বে ফিরতে রাজি হই, কারণ অবশ্যই প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেস আমাকে বলেছিলেন বলে এবং আপনারা সবাই প্রতিদিন বলতেন বলে। যখন আপনাদের কারো সঙ্গে আমার রাস্তায় দেখা হয়েছে আমি সমর্থনটা অনুভব করেছি এবং আবার দলের সঙ্গে নিজেকে দেখার তাগিদটা অনুভব করেছি। কারণ, আমিও মাদ্রিদিসমোর চেতনা ধারণ করি, এই ক্লাব হলো এর সদস্যদের, সমর্থকদের এবং সারা পৃথিবীর।

“আমি যা করেছি তা এই চেতনার আলোকেই করার চেষ্টা করেছি, আমি একটি উদাহরণ হয়ে থাকার চেষ্টা করেছি। মাদ্রিদে কাটানো ২০ বছর আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর ব্যাপার, এর জন্য আমি কৃতজ্ঞ। বিশেষ করে ফ্লোরেন্তিনো পেরেসের কাছে যিনি, ২০০১ সালে আমাকে নিয়ে বাজি ধরেছিলেন, আমার জন্য লড়াই করেছিলেন। কিছু মানুষ বিপক্ষে থাকারও পরও তিনি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন। হৃদয়ের গভীর থেকে বলছি, প্রেসিডেন্টের প্রতি আমি সবসময় কৃতজ্ঞ থাকব। চিরকাল।”

“এখন আমি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং আমি এর কারণ ব্যাখ্যা করতে চাই। আমি যাচ্ছি, কিন্তু হুট করে যাইনি এবং আমি অনুশীলনের জন্য ক্লান্ত নই। আড়াই বছর কোচিংয়ে অনেক শিরোপা আর জয়ের পর ২০১৮ সালে মে মাসে আমি বিদায় নিয়েছিলাম। তখন অনুভব করেছিলাম, শীর্ষ পর্যায়ে থাকতে দলের নতুন দিক নির্দেশনার প্রয়োজন।”

“আজ প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আমি চলে যাচ্ছি কারণ, অনুভব করেছি ক্লাব থেকে যে আত্মবিশ্বাস প্রয়োজন, সেটা পাচ্ছি না। মাঝারি কিংবা দীর্ঘ মেয়াদে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করতে যা প্রয়োজন, তোমন কোনো সমর্থন আমি পাইনি। ফুটবল কি আমি জানি, রিয়াল মাদ্রিদের মতো ক্লাবের চাহিদাও জানি। জানি, কিছু না জিততে পারলে চলে যেতে হবে। কিন্তু এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার সবাই ভুলে গেছে। দিনে দিনে আমি যা গড়ে তুলেছি, দলের আশেপাশে থাকা দেড়শ জনকে নিয়ে খেলোয়াড়দের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমি যে ভূমিকা রেখেছি, এর সবকিছু ভুলে যাওয়া হচ্ছে। আমি আজন্ম বিজয়ী, এখানে এসেছিলাম ট্রফি জিততে। কিন্তু এসবকে ছাড়িয়ে মানুষ, আবেগ, জীবন আছে। আমি অনুভব করেছি, এই ব্যাপারগুলোর মূল্যায়ন করা হয়নি। অসাধারণ একটি ক্লাবের এগিয়ে যাওয়ায় এই ব্যাপারগুলো ভূমিকা রাখে সেটা অনেকেই বুঝতে পারেনি। এমনকি একভাবে আমি, অপমানিত হয়েছি।”

“আমরা এক সঙ্গে যা করেছি সেগুলোকে আমি সম্মান জানাতে চাই। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ক্লাব ও প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অন্য কোচদের চেয়ে কিছুটা আলাদা হলে ভালো লাগত। আমি কোনো সুবিধা চাইনি, অবশ্যই না, স্রেফ চেয়েছিলাম একটু অতীতটা মনে থাকুক।”

“আজ বড় কোনো ক্লাবে একজন কোচের জীবন কেবল দুই মৌসুমের, এর বেশি নয়। এর চেয়ে বেশি থাকতে মানবিক সম্পর্ক খুব প্রয়োজন। অর্থের চেয়েও সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, খ্যাতির চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সব কিছুর চেয়েই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর খেয়াল রাখতে হয়। এ কারণেই এটা বেশি ব্যথা দেয় যখন আমি একটি হারের পর পত্রিকায় পড়ি, পরের ম্যাচে জিততে না পারলে তারা আমাকে ছাঁটাই করবে। বিষয়টা আমাকে ও পুরো দলকে ব্যথিত করত, কারণ ইচ্ছাকৃতভাবে এ সব বার্তা গণমাধ্যমে ফাঁস করা হতো যা স্টাফদের ক্ষেত্রে নেতিবাচত প্রভাব ফেলত, সংশয় তৈরি হতো এবং ভুল বোঝাবুঝি হতো। ভালো ব্যাপার হলো, আমি দারুণ সব খেলোয়াড়দের পেয়েছিলাম, যারা শেষ পর্যন্ত আমার সঙ্গে ছিল। যখন ব্যাপারগুলো খুব কদর্য হয়ে যেত তখন ওরা দারুণ সব জয়ে আমাকে রক্ষা করত। কারণ, আমার ওপর ওদের বিশ্বাস ছিল এবং ওরা জানে, আমি ওদের বিশ্বাস করি।”

“অবশ্যই আমি বিশ্বের সেরা কোচ নই। কিন্তু যে কোনো কর্মী, কোচিং স্টাফ এবং খেলোয়াড়দের তাদের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি ও আত্মবিশ্বাস যোগানোর সামর্থ্য আমার আছে। আমি জানি, একটা দলের ঠিক কি প্রয়োজন। মাদ্রিদে ২০ বছর থেকে আমি শিখেছি, আপনারা সমর্থকরা জয় চান। অবশ্যই আমরা সবাই তা চাই। কিন্তু সব কিছুর ওপরে আপনারা চান, ফুটবলাররা, কোচ, স্টাফ, কর্মীরা তাদের সামর্থ্যের সবটুকু দিক। আমি আপনাদের নিশ্চয়তা দিতে পারি, ক্লাবের জন্য আমরা শতভাগ দিয়েছি।”

“এই চিঠিতে আমি সাংবাদিকদেরও একটা বার্তা দিতে চাই। আমি শতশত সংবাদ সম্মেলন করেছি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা ফুটবল নিয়ে খুব কম কথা বলেছি। আমি জানি, আপনারাও ফুটবল ভালোবাসেন। এই খেলাটা আমাদের ঐক্যবদ্ধ করেছে। তবে সমালোচনার ভঙ্গি না করে বা শেখানোর চেষ্টা না করে, আমার ভালো লাগত যদি প্রশ্নগুলি সবসময় বিতর্কিত না হতো ও ফুটবল সম্পর্কিত হতো। বিশেষ করে খেলোয়াড়দের নিয়ে যদি হতো, যারা খেলাটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ হয়েই থাকবে। চলুন ফুটবলকে না ভুলি, ফুটবলের খেয়াল রাখি।”

“প্রিয় মাদ্রিদিস্তা, আমি সবসময় আপনাদের একজন হয়ে থাকব।”

“এগিয়ে যাও মাদ্রিদ!”

জিনেদিন জিদান।