মেসির একান্ত স্মৃতি, আবেগ, দুঃখ

ফুটবলের সঙ্গে লিওনেল মেসির সখ্য সেই ছোটবেলা থেকে। সময়ের পরিক্রমায় হয়ে উঠেছেন বিশ্বের সেরা ফুটবলারদের একজন। তার ব্যক্তিগত ও দলগত সাফল্য অসংখ্য।  রেকর্ড গড়েছেন অগণিত। পেশাদার ক্যারিয়ারে দেড় যুগের বেশি সময়ের পথচলায় নতুন এক মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছেন আর্জেন্টাইন তারকা। পিছু ফিরে তাকালেন সেই ছোট্টবেলায়, ক্যারিয়ারের শুরুর দিনগুলোয়।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 May 2021, 04:46 PM
Updated : 22 May 2021, 05:25 PM

লা লিগায় শনিবার মৌসুমে নিজেদের শেষ ম্যাচ খেলতে নামবে বার্সেলোনা। শিরোপা দৌড়ে দল আগেই ছিটকে পড়ায় কোচের অনুমতি নিয়ে এই ম্যাচে না খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মেসি।

মৌসুম শেষে কাতালান দলটির সঙ্গে শেষ হবে তার চুক্তির মেয়াদ। রেকর্ড ছয়বারের বর্ষসেরা এই ফুটবলারকে বার্সেলোনার জার্সিতে আর কখনও দেখা যাবে কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে। 

আর্জেন্টিনার ক্রীড়া বিষয়ক দৈনিক ওলেকে দেওয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকার উঠে এসেছে তার মাঠের ভেতর ও বাইরের অনেক প্রসঙ্গ। বলেছেন ব্যক্তিগত অনেক ভালোলাগা-ভালোবাসা কথা। আছে কিছু না পাওয়ার কষ্টও।

গত এক যুগের বেশি সময় ধরে বার্সেলোনার সাফল্যের নায়ক মেসি

ফুটবলে মেসির গল্পের শুরু আর্জেন্টিনার রোসারিওর রাস্তায়। তাকে বড়দের দলে নিতে তার দাদি কীভাবে স্থানীয় একজন কোচকে রাজি করেছিলেন, বললেন সেই গল্প।  

“বড়দের একটি দলে একজন খেলোয়াড় অনুপস্থিত ছিল। আমার দাদি সেই দলের কোচকে চিনতেন। আমাকে নেওয়ার জন্য তিনি তাকে বলতে শুরু করলেন। ‘না, আমি কীভাবে তাকে খেলাব, সে কত ছোট দেখেছেন, আপনার মাথা ঠিক আছে? সে আঘাত পাবে’-কোচ বলেছিলেন। কিন্তু তিনি (দাদি) অনবরত বলছিলেন, ‘নিয়ে নিন, নিয়ে নিন।’ এরপর আমি সুযোগ পাই, কিছু করেছিলামও এবং এরপর থেকে…”

“এরপর দাদি কোচকে গিয়ে বললেন, ‘ওকে কিছু ফুটবল বুট কিনে দাও। আগামী সপ্তাহ থেকে ওকে অনুশীলনে নিয়ে যাব।’ এভাবেই সব শুরু হলো।”

তার প্রথম ‘এজেন্ট’ হিসেবে কী দারুণ কাজটাই না করেছিলেন মেসির দাদি! যদিও ফুটবলের সঙ্গে তার সখ্য আরও আগে থেকে। 

“৪ কিংবা ৫ বছর বয়সের আগেও আমি বল নিয়ে খেলতাম। ঠিক যখন থেকে হাঁটতে শিখেছিলাম। আমার বড় ভাই, বড় কাজিন ছিল, আমরা সবসময় একসঙ্গে খেলতাম।”

রেকর্ড ছয়বার বর্ষসেরা ফুটবলার হয়েছেন মেসি

“খুব অল্প বয়স থেকেই আমি খেলা শুরু করি। ৪ বছর বয়সে খেলা শুরু করেছিলাম ক্লাবে আর রাস্তায় তো সবসময় খেলেছি।”

কিশোর বয়সে ২০০০ সালে বার্সেলোনায় পাড়ি জমিয়েছিলেন মেসি। যুব দলে রাঙিয়ে ২০০৪ সালে তার অভিষেক হয় মূল দলে। এরপর শুধুই সামনে ছুটে চলা। গত এক যুগের বেশি সময় ধরে ক্লাবটির সাফল্যের নায়ক তিনি। কাম্প নউয়ে চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও ১০টি লা লিগাসহ জিতেছেন রেকর্ড ৩৫টি শিরোপা।

তবে মাত্র ১৩ বছর বয়সে বার্সেলোনায় যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তটা সহজ ছিল না তার জন্য।

“বলতে দ্বিধা নেই, আমি খুব বেশি ভাবিনি। কিন্তু সময়টা কঠিন ছিল। কারণ যখন বার্সায় আসি, তখন কাগজপত্রের ঝামেলায় খেলতে পারিনি। এরপর যখন খেলা শুরু করলাম, তখন চোটে পড়লাম।”

“প্রায় এক বছর আমি খেলতে পারিনি, আমি অনুশীলন করছিলাম, কিন্তু সেটা তো এক বিষয় নয়। আমি ভাগ্যবান যে এরপর সবকিছু খুব দ্রুত সামলে উঠতে পেরেছিলাম।”

কঠিন সময়টা পেরিয়ে সাফল্যের পথে ছুটতে শুরু করেন মেসি। কিন্তু ওই বয়সে বাড়ি থেকে এত দূরে থাকা, বাড়িতে গিয়ে আবার ফিরে আসা; তার জন্য ছিল ভীষণ কঠিন।

“সবসময় আমি রোসারিও থেকে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে আসতাম। থাকতে চাইনি, আবার চেয়েছিলামও। আমি বার্সেলোনায় আসতে চাইতাম খেলা চালিয়ে যেতে, একই সঙ্গে সবকিছু পেছনে ফেলে আসাও ছিল কঠিন।”

তিন সন্তানের সঙ্গে মেসি

“আমি অনেক বন্ধু হারিয়েছি, ওই সময় যোগাযোগ রাখাটা বেশ কঠিন ছিল। এখন যেকোনো ১৩-১৪ বছর বয়সী বাচ্চার কাছে ফোন আছে। তখন বিষয়টি এরকম ছিল না। যোগাযোগের সমস্যা ও দূরত্বের কারণে আমি অনেক মানুষের সান্নিধ্য হারিয়ে ফেলেছি।”

বিশ্বে এখন তিনি সুপারস্টার। যেখানে যান সবাই চিনে ফেলে। তাই সইতে হয় বিড়ম্বনাও।

“অন্য সব কিছুর চেয়ে, বাইরে বেরুনোই বেশি সমস্যা। বের হতে হবে যেন কেউ খেয়াল না করে, যেখানে মানুষ বেশি, যেমন ধরুন শপিং সেন্টার, সেখানে যাওয়া খুবই কঠিন। ছবি তোলার জন্য অনুরোধ থাকবে না, এমনটা হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই।”

“অনেক সময় থাকে, যখন ওই চাপ ছাড়া থাকতে ইচ্ছা করে। অনেক সময় উদ্ভট মুহূর্তের সম্মুখীন হতে হয়...মানুষ আপনার ছবি তোলার বা অটোগ্রাফ নেওয়ার অনুরোধ করে, আপনি এর কিছুই তখন চান না।”

নিজের সন্তানদের নিয়ে মাঝেমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি পোস্ট করেন মেসি। স্টেডিয়ামে বাবার খেলাও দেখতে যান তারা। তাদের দিকেও তাই বাড়তি নজর থাকে লোকজনের, গণমাধ্যমের। কীভাবে নেয় তারা বিষয়টা?

“থিয়াগো (বড় ছেলে) বিষয়টি পছন্দ করে না…সে খুব লাজুক। তবে মাতেও (মেঝো ছেলে) একেবারে বিপরীত, সে এসব বিষয়ে ভাবে না। তার সম্পর্কে কেউ কিছু বললেও তার কাছে সেটি কোনো ব্যাপার নয়।”

চলতি মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও লা লিগা থেকে খালি হাতে ফিরলেও কোপা দেল রের শিরোপা জিতেছে বার্সেলোনা। এক যুগের মধ্যে গতবার প্রথম শিরোপাশূন্য মৌসুম কাটানোর পর এই সাফল্য ভীষণ প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন মেসি।

“সত্যিটা হলো, আমরা যে সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম তাতে কোপা দেল রের শিরোপা ছিল বিশেষ কিছু। ফলাফল ও শিরোপা-খরা মিলিয়ে ক্লাব বছর দুয়েক খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল।”

“কারণ দলটা তরুণ। অনেক নতুন মুখ আছে। এই কোপা দেল রের শিরোপা তাই দলের জন্য টার্নিং পয়েন্ট এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

কোপা দেল রের ট্রফি হাতে মেসির উল্লাস

ম্যাচ শেষে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের সঙ্গে জার্সি বদল করার রীতিটা মেসি পালন করেন নিয়মিতই। তবে বেশিরভাগ সময়ই প্রতিপক্ষের অনুরোধে। কিছু খেলোয়াড়ের জার্সি নিতে না পারার আক্ষেপও আছে তার।

“ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে যাদের মুখোমুখি হয়েছিলাম, তাদের জার্সি নিতে না পারাটা আমার জন্য আক্ষেপের। যেমন, রোনালদো (ব্রাজিলিয়ান), রবের্তো কার্লোস...তাদের জার্সি সংগ্রহে থাকলে বেশ ভালো লাগত।”

আগে কেন দাড়ি রাখতেন না, আর এখন কেন রাখেন, সেই গল্পটাও শোনালেন মেসি।

“আমি দীর্ঘদিন নিয়মিত শেভ (দাড়ি কামানো) করতাম। আমি জিলেটের সঙ্গে ছিলাম এবং তারা আমাকে শেভ করতে বলত। যখন তাদের সঙ্গে চুক্তি শেষ হলো, তখন আমি শেভ না করার সিদ্ধান্ত নিই।”

“আমার মনে হয়, সময়টা ছিল ২০১৬ সালে, যুক্তরাষ্ট্রে কোপা আমেরিকার সময়। সেখানে অনেক দাড়িওয়ালা ফুটবলার ছিল। আমার চুলের ক্ষেত্রেও বিষয়টি একই রকম। এটি হয় বড়, না হয় ছোট।”