বাংলাদেশ এখন লড়তে ও জিততে জানে: জেমি ডে

ফুটবলাররা ঈদের ছুটিতে। কোচ জেমি ডে হোটেলে ‘বন্দি’। ইংল্যান্ড থেকে ঢাকায় ফিরে পাঁচ দিনের কোয়ারেন্টিনে আছেন জাতীয় ফুটবল দলের কোচ। তবে একেবারে অলস সময় কাটছে না তার। পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন আগামীর চ্যালেঞ্জ নিয়ে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপ বাছাই, ঘরোয়া ফুটবলের খুঁটিনাটি, বয়সভিত্তিক পর্যায়ে বয়স আড়ালের অভিযোগ, প্রিয় ক্লাব আর্সেনাল থেকে শুরু করে আরও অনেক বিষয়ে কথা বললেন মন খুলে।

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 May 2021, 10:31 AM
Updated : 13 May 2021, 11:12 AM

এক মাস ছুটি কাটিয়ে গত সোমবার ঢাকায় ফিরেছেন জেমি। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী আছেন কোয়ারেন্টিনে। কোচকে ছাড়াই জুনের ২০২২ কাতার বিশ্বকাপ ও ২০২৩ এশিয়ান কাপের বাছাই উপলক্ষে গত মঙ্গলবার থেকে ক্যাম্প শুরু হয়েছিল। তবে ঈদ-উল-ফিতরের কারণে ফুটবলাররা ছুটি পাওয়ায় ক্যাম্পে বিরতি চলছে। আগামী রোববার ফের শুরু হবে ক্যাম্প।

কেমন আছেন? পরিস্থিতির কারণে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হচ্ছে। সময় কাটছে কিভাবে?

জেমি ডে: ভালো আছি। তবে একজন কোচের কাজ তো মাঠেই; কাজ ছাড়া থাকা কঠিন। আর হ্যাঁ, এ বছরে অনেকটা সময় কোয়ারেন্টিনে কাটিয়ে দিলাম (হাসি)। বিশ্বকাপ বাছাইয়ের পরিকল্পনা সাজানো, মুভি দেখা, এগুলো করেই সময় কাটাচ্ছি।

ক্যাম্পের দলে ৩৩ বছর বয়সী ডিফেন্ডার রেজাউল করিমকে ফিরিয়েছেন। তার অভিজ্ঞতার কারণে, নাকি অন্য কোনো কারণ?

জেমি ডে: আমার শুধু মনে হয়েছে, এই মৌসুমে সে ধারাবাহিকভাবে ভালো করেছে। তাই তাকে অনুশীলনে আরও কাছ থেকে দেখতে চেয়েছি।

প্রিমিয়ার লিগের দ্বিতীয় লেগে তিন ম্যাচে জুয়েল রানা দুই গোল করেছে। আরও কয়েকজন আছে ভালো করাদের তালিকায়, কিন্তু ক্যাম্পে ডাক পায়নি।

জেমি ডে: আমার বিশ্বাস, পজিশন অনুযায়ী সেরা খেলোয়াড়দেরই আমরা ক্যাম্পের জন্য বাছাই করেছি। আন্তর্জাতিক ফুটবলের মান বিপিএলের (বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ) চেয়ে অনেক উচুঁতে। আগামী জুনে আমাদের কাতারে বিশ্বকাপ বাছাই খেলতে হবে। সেই প্রয়োজন অনুযায়ী দল গোছাতে হবে; খেলোয়াড়ও সেভাবে বাছাই করতে হয়েছে।

মানের প্রসঙ্গই যেহেতু উঠল, দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় আমাদের ফুটবলারদের পারিশ্রমিক বেশি। উদাহরণ হিসেবে টানা যেতে পারে নেপালকে। তাহলে বাংলাদেশের কমতি কোথায়?

জেমি ডে: অনেক পরিবর্তন প্রয়োজন। বিনিয়োগ করতে হবে। আমার মনে হয়, ভারতের ফুটবলাররা বাংলাদেশের ফুটবলারদের চেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পায়। তবে ভারতের ক্লাবগুলো অনেক পেশাদার। তরুণ খেলোয়াড়দের গড়ে তুলতে প্রতিটি ক্লাবের বয়সভিত্তিক দল আছে। অনুশীলনের ভালো সুবিধা আছে; মানের উন্নতি করতে এই পরিবর্তনগুলো প্রয়োজন।

ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, স্পেন, ইল্যান্ডের মতো ব্যক্তিগত নৈপুণ্য এবং সৃষ্টিশীল ফুটবলার এই অঞ্চলে আমরা তেমন একটা দেখতে পাই না কেন?

জেমি ডে: অল্প বয়স থেকেই খেলোয়াড়দের সঠিক প্রক্রিয়ায় না আনলে এবং তাদের যথাযথ কোচিং করানো না হলে, বিশ্বমানের ফুটবলার পাওয়া যাবে না।

একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। আপনার প্রিয় দল আর্সেনাল প্রিমিয়ার লিগে এবারও ভালো করছে না! লিগ টেবিলে নবম স্থানে আছে…

জেমি ডে: হ্যাঁ, তারা খুব একটা ভালো করছে না এই মুহূর্তে এবং টেবিলের শীর্ষ দলগুলোর চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। এটা আমার জন্য পীড়াদায়ক। উপরের দিকে থাকলে ভালো লাগত; কিন্তু কি বলার আছে।

আর্সেনালে আপনার স্মরণীয় মুহূর্ত?

জেমি ডে: (হাসি), সবচেয়ে স্মরণীয় স্মৃতি তো মূল দলের হয়ে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ক্রিস্টাল প্যালেসের বিপক্ষে বদলি নেমে খেলা (১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে, ম্যাচটি ১-০ গোলে জিতেছিল আর্সেনাল)।

আর্সেনালের পরিবেশ, অবকাঠামো, আর্সেন ভেঙ্গার কিভাবে কাজ করতেন, সেগুলো কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা একটু বলুন।

জেমি ডে: এক কথায়, খেলোয়াড়দের খাদ্যভাস, ডায়েট থেকে শুরু করে অনুশীলন ও খেলার ধরণ, সবকিছুই বদলে দিয়েছিলেন ভেঙ্গার। ক্লাবে খুব ভালো একটা পরিবেশ তৈরি করেছিলেন, যেখানে সবাই একে অপরের জন্য কাজ করত।

‘ডায়েট’-এর প্রসঙ্গ যখন উঠল, আপনার শিষ্যদের খাদ্যাভাস কেমন? খেলোয়াড়দের ৯০ মিনিট খেলার দম নিয়ে অভিযোগ করেন অনেকে।

জেমি ডে: ২০১৮ সালে আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আমার মনে হয়, জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের খাদ্যাভাস, ফিটনেসও আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে। ছেলেরা আগের চেয়ে আরও অনেক বেশি পেশাদার। অবশ্য, সব ক্ষেত্রে আরও উন্নতির সুযোগ সবসময়ই থাকে।

ছেলেরা ৯০ মিনিট খেলার পর্যায়ে নেই, এটা আমার মনে হয় না। তারা পুরোটা সময়ই খেলতে সক্ষম। সমস্যা হচ্ছে, বছরজুড়ে খেলা থাকার কারণে ছেলেরা বিশ্রাম পায় না। এ কারণে ক্লান্তি পেয়ে বসে।

প্রাসঙ্গিকভাবে খেলোয়াড়দের বয়স নিয়ে প্রশ্নটা আসে। প্রতিবেশী দেশের অনেক কোচকেই আমাদের বয়সভিত্তিক দলের খেলোয়াড়দের বয়স নিয়ে প্রশ্ন তুলতে দেখি। বয়স লুকোছাপা করলে তার প্রভাব জাতীয় দলে পড়াটাই তো স্বাভাবিক, তাই না?

জেমি ডে: এ বিষয়ে কথা বলতে আমি সঠিক লোক নই। কিন্তু এটা বলতে পারি, যুক্তরাজ্যে খেলোয়াড়দের সঠিক বয়স অনুযায়ী বয়সভিত্তিক সব পর্যায়ের দলগুলোতে খেলা নিশ্চিত করা হয়।

অনুশীলনে বাংলাদেশ ফুটবল দল। ফাইল ছবি

এখন পর্যন্ত দলে কোন বিষয়ে পরিবর্তন আনতে পেরে আপনি সবচেয়ে খুশি? আর কোন না পারা নিয়ে আছে আক্ষেপ?

জেমি ডে: সন্তুষ্টির জায়গা হচ্ছে, আমরা এখন জিততে পারি এবং র‌্যাঙ্কিংয়ের উপরের সারির দলগুলোর বিপক্ষে কিভাবে লড়তে হয়, সেটা জানি। আমার জানা মতে, আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগে বাংলাদেশ ২৮ ম্যাচের মধ্যে তিনটিতে জিতেছিল। আর আক্ষেপের জায়গা হচ্ছে, সবশেষ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের গ্রুপ পর্ব থেকে ছিটকে যাওয়াটা। কেননা, আমরা আরও এগিয়ে যাওয়ার যোগ্য ছিলাম।

বিশ্বকাপ বাছাইয়ের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। কাতারে শেষ তিন ম্যাচ থেকে আসলে কী প্রত্যাশা আপনার? যেহেতু হোম ম্যাচগুলো নিজেদের মাঠে খেলতে পারছেন না।

জেমি ডে: নিজেদের মাঠে খেলতে না পারার কারণে ম্যাচগুলো আমাদের জন্য খুব কঠিন হয়ে গেছে। আগের পাঁচ ম্যাচের মধ্যে আমরা মাত্র একটি ম্যাচ নিজেদের মাঠে খেলতে পেরেছি। আমার মনে হয়, আমাদের গ্রুপে আমরাই একমাত্র দল, যাদের বেলায় এমনটা হয়েছে।

বাকি ম্যাচগুলোয় আমরা কেমন করতে বা কি অর্জন করতে চাই, সেটা নিয়ে প্রত্যেকের নিজস্ব ভাবনা থাকবে। আমাদের খেলোয়াড়-স্টাফদের মধ্যে যে প্রত্যাশা আছে, সেটা বলতে চাই না।

বাছাইয়ে এখনও জয়ের দেখা পাননি। সল্ট লেকে (২০১৯ সালের অক্টোবরে) জিততে পারলে দেশের মানুষের কাছে কিন্তু নায়ক হয়ে যেতে পারতেন! ওই ড্র নিয়ে কি কোনো দুঃখ আছে?

জেমি ডে: (হাসি), মনে হয় না, বাংলাদেশ খুব বেশিবার ভারতকে হারিয়েছে। সল্ট লেকের ওই ম্যাচটাতে চমৎকার খেলেছিলাম আমরা। প্রতিপক্ষের মাঠে গিয়ে দারুণ খেলেও জয় না পাওয়ায় হতাশা আছে। তবে কোনো দুঃখ নেই। বরং ওই ম্যাচটা নিয়ে শুধু ভালো স্মৃতিই আছে আমার।

আপনার প্রিয় ক্লাব তো আর্সেনাল, জাতীয় দল প্রিয় কোনটি? প্রিয় ফুটবলার?

জেমি ডে: অবশ্যই ইংল্যান্ড। আর প্রিয় খেলোয়াড় ডেনিস বার্গকাম্প(নেদারল্যান্ডস ও আর্সেনালের সাবেক তারকা ফরোয়ার্ড)।

কোচ হিসেবে আপনার অনুপ্রেরণা কে?

জেমি ডে: আমার ফেভারিট কোচ ববি রবসন এবং ডন হাউই।

কারণ?

জেমি ডে: খেলাটি সম্পর্কে তাদের ভালো জ্ঞান এবং ফুটবল ও খেলোয়াড়দের উন্নতিতে তাদের দারুণ নিবেদনের জন্য।

বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের জন্য কোনো বার্তা?

জেমি ডে: সবাইকে ঈদ মোবারক। পরিবার-পরিজন ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সবার দারুণ সময় কাটুক। নিরাপদ ও সুস্থ থাকুন।