প্রথাগত ‘নাম্বার নাইন’ পজিশনে ফরোয়ার্ড প্রতিপক্ষের রক্ষণের ঠিক সামনে থাকে। তাকে নির্ভর করতে হয় সতীর্থদের কাছ থেকে বল পাওয়ার চিরায়ত ছকের ওপর। সেখানে ‘ফলস নাইন’ এর অবস্থান প্রতিপক্ষের সেন্ট্রাল ডিফেন্স ও সেন্ট্রাল মিডফিল্ডের মাঝামাঝি। ভূমিকার কলেবরও বিস্তৃত। গেম বিল্ডআপ, প্লেমেকারের দায়িত্ব পালন, আক্রমণ তৈরি থেকে শুরু করে গোলের কাজটিও করতে হয়। গুয়ার্দিওলার এই ছকপ্রীতির কথা মেসিও বলেছিলেন গত বছর।
“গুয়ার্দিওলার অফিসে আমাকে ডাকা হলো এবং (গেলাম); তিনি বললেন, আমাকে ফলস নাইন পজিশনে খেলানোর কথা ভেবেছেন। সামুয়েল এতো ও থিয়েরি অঁরিকে বাইরে খেলাবেন এবং আমাকে খেলতে হবে ফলস সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে।”
আক্রমণাত্মক ফুটবলের এই নতুন কৌশল প্রয়োগের দারুণ উদাহরণ ২০০৯ সালে সান্তিয়াগো বের্নাবেউয়ের ক্লাসিকো। সেবার প্রথমবারের মতো ‘ত্রিমুকুট’ জয়ের পথে রিয়াল মাদ্রিদকে ৬-২ গোলে রীতিমতো বিধ্বস্ত করেছিল বার্সেলোনা। ওই ম্যাচের পর দলটির সেসময়কার তারকা মিডফিল্ডার চাভি বলেছিলেন রিয়ালকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার নেপথ্যের ছক।
“এটা তখন হয়েছিল, যখন কোচ লিও মেসিকে ফলস নাইন পজিশনে খেলালেন। তিনি জানতেন মেসিকে মিডফিল্ডে পিছিয়ে এনে খেলালে মাদ্রিদের ডিফেন্ডাররা তাকে অনুসরন করবে না; যার অর্থ ছিল, মেসি-আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা এবং আমি যেন থ্রি-অন-টুতে মাঝমাঠে খেলতে পারি।”
‘ফলস নাইন’ কৌশল যে গুয়ার্দিওলাই প্রথম কোচ হিসেবে রপ্ত করেছিলেন, মাঠে প্রয়োগ করেছিলেন, তা নয়। কিন্তু স্ট্রাইকারকে একটু নিচে নামিয়ে খেলানোর কৌশলের প্রতি ওই ম্যাচের পর তার নিজস্ব ভালোবাসা, আস্থা জন্মেছিল।
সাধারণত ম্যাচের শেষ দিকে প্রতিপক্ষকে বোকা বানাতে এই ‘ফলস নাইন’ সেট-আপ ব্যবহার করেন গুয়ার্দিওলা। অবশ্য ম্যানচেস্টার সিটির এই মৌসুমের দিকে তাকালে দেখা যাবে, এই স্প্যানিশ কোচের কৌশল আগের মতো গোপন নেই, কিন্তু তা আরও ধারালো এবং অদম্য হয়ে উঠেছে।
সিটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা আগুয়েরো এবং জেসুস দুজনে মিলে এই লিগে মাত্র ২৫ ম্যাচে শুরুর একাদশে ছিলেন। এর কারণও গুয়ার্দিওলার ‘ফলস নাইন’ খেলানোর পরিকল্পনাকে প্রাধান্য দেওয়া।
এমনকি বড় ম্যাচগুলোতে, এর মধ্যে চলতি মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের নকআউট পর্বের ম্যাচও আছে, যেখানে তিনি প্রথাগত সেন্টার ফরোয়ার্ড খেলাননি। কেভিন ডে ব্রুইনে, ফিল ফোডেন, বের্নার্দ সিলভা, রাহিম স্টার্লিং, ফেররান তোরেস, রিয়াদ মাহরেজ, ইলকাই গিনদোয়ানরা সবাই একটু নিচে নেমে খেলা ফরোয়ার্ডের ভূমিকা পালন করেছেন।
কিন্তু কে এ পজিশনে খেলছে, সেটা বিষয় নয়। মূল কথা হচ্ছে, গুয়ার্দিওলা তার দলটাকে একটি নমনীয় এবং পরিপূর্ণ দল হিসেবে গড়ে তুলেছেন।
গত ডিসেম্বর ও মার্চের মধ্যে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে টানা ২১ ম্যাচ জেতা সিটির শীর্ষে থাকাকালীন সময়েও প্রশংসাকে পাশ কাটিয়ে গেছেন গুয়ার্দিওলা। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে বলেছিলেন, “দুর্দান্ত খেলোয়াড় কেনার জন্য অনেক টাকা আমাদের আছে।”
এরপর যখন এক রিপোর্টার প্রশ্ন করে বসেন, আপনি কি মনে করেন সিটির এই দলটা এবং তাদের ধন-সম্পদ দিয়ে লিগ শিরোপা জিততে পারবেন? তখন গুয়ার্দিওলার উত্তর ছিল, “কিন্তু আমরা তো গুটিয়ে গিয়ে কোঠরে ঢুকে খেলব না।”
এই মৌসুমে গুয়ার্দিওলার উচুঁ দরের কৌশলগত ভাবনার আরেকটি উদাহরণ জোয়াও কানসেলো। ২০১৯ সালে বড় অঙ্কের ট্রান্সফার ফিতে ইউভেন্তুস থেকে সিটিতে নোঙর ফেলা এই পর্তুগিজ ফুল ব্যাকের ইংল্যান্ডে প্রথম মৌসুমটা ছিল ভীষণ কঠিন। অথচ, সেই কনসালো এবার সিটির সাফল্যের সেরা কারিগরদের একজন।
দলের তালিকায় কানসেলো ফুল ব্যাক, কিন্তু যখন ম্যাচ শুরু হয়, তখন তার ভূমিকাটা হয়ে যায় উইং ধরে খেলা ফরোয়ার্ডের মতো, কিংবা আরও মাঝমাঠ কেন্দ্রীক। নিজের এই বদলে যাওয়া নিয়ে গুয়ার্দিওলার প্রশংসায় পঞ্চমুখ কানসেলো।
“আমি ড্রিবল করতে, গোলে অবদান রাখতে, কৌশলী এবং আকর্ষণীয় ফুটবল খেলতে ভালোবাসি। ফুল ব্যাক ভেতরের দিকে বেশি খেলে, গোল ঠেকায়…কিন্ত গুয়ার্দিওলা যে দৃষ্টি দিয়ে ফুটবলকে দেখেন, আমি তাতে অভ্যস্ত ছিলাম না। যখন অনুশীলন শুরু করলাম, আরও ভালো অনুভব করলাম।”
“তিনি ম্যাচের প্রতিটি বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরেন এবং আমি মনে করি, এই দলটার উন্নতিও ওই জায়গা থেকে এসেছে।”
ফুল ব্যাক থেকে অদম্য ‘ফলস নাইন’ এই বিস্তারিত বিষয়গুলোই সিটি এবং গুয়ার্দিওলাকে এনে দিয়েছে জয়ের ফর্মুলা। আগামী ২৯ মে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে চেলসির মুখোমুখি হবে তারা। ফুটবলপ্রেমীদের চোখও থাকবে প্রিয় কৌশলে দলকে প্রথমবারের মতো ইউরোপ সেরা করতে পারেন কিনা গুয়ার্দিওলা।