ফুটবল দুনিয়ায় ঝড় তোলা খবরটি আসে রোববার রাতে। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের প্রতিদ্বন্দ্বী ইউরোপিয়ান সুপার লিগের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয় এতে যোগ দেওয়া ১২টি ক্লাব; রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, আতলেতিকো মাদ্রিদ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, ম্যানচেস্টার সিটি, লিভারপুল, আর্সেনাল, চেলসি, টটেনহ্যাম হটস্পার, ইউভেন্তুস, এসি মিলান ও ইন্টার মিলান।
প্রস্তাবিত এই টুর্নামেন্টের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আরও তিনটি ক্লাব শিগগিরই যোগ দিবে। প্রতিষ্ঠাকালীন এই ১৫ দল এবং প্রতি বছর কোয়ালিফাই করে আসা আরও পাঁচটি মিলিয়ে ২০ দল নিয়ে এই ইউরোপিয়ান সুপার লিগ আয়োজনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
মাঠে গড়ানোর মতো কাঠামো তৈরি হলেই প্রতিযোগিতাটি শুরু করতে চায় কর্তৃপক্ষ। সম্ভব হলে আসছে অগাস্টেই। সুপার লিগের প্রথম চেয়ারম্যান ও রিয়াল মাদ্রিদ সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেস সোমবার রাতে আবারও বলেন, উয়েফার সঙ্গে তারা সংঘাতে জড়াতে চান না। আর তাই প্রয়োজনে টুর্নামেন্ট শুরু করতে আরেক বছর অপেক্ষা করতেও তাদের আপত্তি নেই।
উয়েফা অবশ্য শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে। সোমবার পেরেস ওই কথা বলার আগেই উয়েফা প্রধান আলেকসান্দের চেফেরিন কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “এফএ, লা লিগা, সেরি আ, ফিফা, এফইএফ, প্রিমিয়ার লিগ সবাই এই উদ্ভট পরিকল্পনার বিরুদ্ধে। আমরা এই পরিবর্তনের অনুমতি দিচ্ছি না। এই লিগে অংশ নেওয়া খেলোয়াড়রা তাদের জাতীয় দলের হয়ে খেলতে পারবে না।”
সুপার লিগের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসার কয়েক ঘণ্টা আগেই উয়েফা নানা রকম হুমকি দিয়ে বিবৃতি দিয়েছিল। বলেছিল, এই সব ক্লাবকে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে সব ধরনের আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আর উয়েফা এতটা কড়া পদক্ষেপ নিলে ঘরোয়া লিগে খেলার পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে এই ১২ দলের। দলগুলোর খেলোয়াড়রা নিষিদ্ধ হতে পারেন উয়েফার আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টগুলোয়।
বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্তা সংস্থা ফিফাও গত জানুয়ারিতে এমনই হুমকি দিয়েছিল। তবে রোববার যে বিবৃতি সংস্থাটি দিয়েছে, তাতে আগের অবস্থান থেকে তারা কিছুটা সরে এসেছে বলেই মনে হচ্ছে। শান্ত থেকে এবং অর্থপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করার পক্ষে মত দিয়েছে ফিফা।
ফিফা ও উয়েফা বরাবর নিজেদের অবস্থান, ইচ্ছা ও পরিকল্পনা জানিয়ে একটি চিঠি দিয়েছে সুপার লিগ কর্তৃপক্ষ। পিএ দেখেছে এই চিঠি।
“আমরা আশা করি, এই চিঠির প্রেক্ষিতে আপনাদের জবাব আগের মতো হবে না। আমাদের মতো আপনার প্রতিষ্ঠানও সুপার লিগের ইতিবাচক দিক ও তাৎক্ষণিক সুবিধাগুলো বুঝতে পারবেন।”
“কীভাবে এটি ফুটবলের চলমান ধারায় যোগ করা যায়, সে বিষয়ে আমরা আপনাদের সমর্থন ও সাহায্য কামনা করি। আশা করি, লক্ষ্য অর্জনে আপনারা আমাদের সঙ্গে কাজ করবেন।”
এরপরই ওই চিঠিতে তুলে ধরা হয়েছে উয়েফার হুমকির কথা। মূলত ওই কারণেই নিজেদের নিরাপদ রাখতে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
“আপনাদের আনুষ্ঠানিক বিবৃতিই আমাদের বাধ্য করেছে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেদের জন্য প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে। এ কারণে শুধু তহবিল গঠনই ঝুঁকিতে পড়বে না, একই সঙ্গে এটি বেআইনিও।”
“এ কারণেই, প্রাসঙ্গিক আদালতে অনুমতি চেয়ে এসএলসি একটি আবেদন করেছে যেন নির্বিঘ্নে কাজ করা যায় এবং আইন অনুযায়ী এর কার্যক্রমে কোনো বাধা না আসে।”
তবে বিশ্বজুড়ে ফুটবলের ভক্ত-সমর্থকরা যে শক্ত অবস্থান নিয়েছে তাতে সুপার লিগের অবস্থান শুরুর আগেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। কেননা, দিনশেষে সমর্থকদের ছাড়া ফুটবলের সেই সৌন্দর্য্য আর থাকে না। তাছাড়া যে উদ্দেশ্যে ওই ১২ ক্লাবের ‘বিদ্রোহ’, সমর্থকদের ছাড়া সেই আয়ের পথটাও ছোট হয়ে আসবে।
বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানদের কাছেও গুরুত্ব পাচ্ছে না বিচ্ছিন্ন প্রতিযোগিতাটি। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন যেমন বলেছেন, ইউরোপিয়ান সুপার লিগ ‘সমর্থকদের জন্য ভালো কিছু নয়।’ সেই সঙ্গে ফুটবল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মিলে প্রস্তাবিত টুর্নামেন্টটি যেন মাঠে না গড়ায় সেটা নিশ্চিত করতে সবকিছু করার কথাও বলেছেন তিনি।
ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (এফএ) সাবেক চেয়ারম্যান গ্রেগ ডাইকও বিশ্বব্যাপী এমন প্রতিরোধের মুখে সুপার লিগের মাঠে গড়ানোর সম্ভাবনা দেখছেন না।
বিবিসি রেডিও ফোরকে তিনি বলেছেন, “আমার মনে হয় না, এটা হবে। আমার কাছে পুরো বিষয়টাই যেন একটা খেলা। তবে কোনোভাবেই এটা ফুটবলের জন্য ভালো কিছু বলে মনে হয় না। উয়েফার অনুমতি ছাড়া, বিশেষ করে ফিফার অনুমতি ব্যতিত এর বাস্তবায়ন করা খুব কঠিন।”
“আমার মতে, এটা একটা বড় ভুল। আমি ভাবছি এর বিপক্ষে ওঠা মত নিয়ে, সব জায়গায় যা একইরকম। এখনও পর্যন্ত এর পক্ষে কিছুই শুনিনি। সম্ভবত এটা বন্ধ হয়ে যাবে।”
সুপার লিগের তেমন কোনো ভবিষ্যৎ দেখছেন না যুক্তরাজ্যের লিডসের ক্রীড়া আইনজীবী রিচার্ড ক্রেমার। তার মতে, উয়েফা ও প্রিমিয়ার লিগ কর্তৃপক্ষ আইনগতভাবে শক্ত অবস্থান নিলেই ভেস্তে যাবে নতুন এই প্রতিযোগিতা।
“মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই টুর্নামেন্টের পথচলা আইনি বাধার মুখে শুরুতেই ভেস্তে যেতে পারে। এখন পর্যন্ত যা মনে হচ্ছে, উয়েফা এটিকে বন্ধ করতে তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।”
“সুপার লিগ বন্ধ করতে তারা কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। তারা ক্লাবগুলোর অংশগ্রহণেও নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে, এটাই সম্ভবত উয়েফার হাতে থাকা প্রাথমিক উপায়।”
তবে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আইন বিশেষজ্ঞ মার্ক ওর্থ সুপার লিগের মাঠে গড়ানোর ভালো সম্ভাবনা দেখছেন। স্পোর্টসমেইলকে এই জার্মান বলেছেন, বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ালে সুপার লিগ কর্তৃপক্ষ সফল হবে। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন প্রতিযোগিতার গঠনতন্ত্র ও এর আগে অনেকটা একই ধরনের মামলায় আদালতের সিদ্ধান্তের ধরন।
সাম্প্রতিক সময়ে অন্য ক্রীড়াতেও অনেকটা একই ধরনের দুটি ঘটনা ঘটেছিল এবং উভয় ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ওই ক্রীড়া সংস্থার অভিযোগ উল্টে রায় দিয়েছিল আদালত। ওই দুই ঘটনার বিবেচনায় এবার উয়েফার মামলাও আদালতে আলোর মুখ দেখবে না বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।
স্পিড স্কেটারদের অনেক বেশি অর্থ উপাজর্নের টুর্নামেন্টে অংশ নিতে আন্তর্জাতিক স্কেটিং ইউনিয়ন যে বাধা দিয়েছিল, তা বাতিল করে দেয় ইউরোপিয়ান কমিশন। আর কমিশনের ওই সিদ্ধান্ত গত ডিসেম্বরে সমর্থন করে রায় দেন ইউরোপের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আদালত, লুক্সেমবার্গের জেনারেল কোর্ট।
আর গত জানুয়ারিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রেসলিং ফেডারেশন নতুন একটি প্রতিযোগিতা শুরুর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালে তাদের বিরুদ্ধে রায় দেয় জার্মানির একটি আদালত।
সুইডেন ও ইতালিতেও এমন কিছু ঘটনার উদাহরণ আছে বলে জানান ওর্থ।
সুপার লিগের প্রতিষ্ঠাকালীন ১৫ দল প্রতি বছরই এখানে খেলবে। এর বাইরে শুধু পাঁচটি ক্লাব আসবে বাছাই পেরিয়ে। প্রথম ১৫ দল শুধু অংশ নেওয়ার জন্যই প্রত্যেকে পাবে ৩১ কোটি পাউন্ড। আর বাইরে থেকে যারা এটা দেখবে তারা শুধু বলবে, সুপার লিগ ঘরোয়া ফুটবলকে ধ্বংস করে দিবে।
ভক্ত-সমর্থক, রাজনীতিবিদ, ফুটবল কর্মকর্তা এবং ফুটবল দুনিয়ার কিছু বিখ্যাত ব্যক্তিও এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং নেবে। কিন্তু আদালতে এসবের কোনো মূল্য নেই বলেও উল্লেখ করেন ওর্থ।
আরেকটি বিষয় আলোচনায় না আনলেই নয়-উয়েফার হুমকি কার্যকর হলে প্রিমিয়ার লিগে আর দেখা যাবে না শীর্ষ ছয় ক্লাবকে। স্পেনের লা লিগা ও ইতালির সেরি আ থেকে বাদ যাবে তিনটি করে বড় ক্লাব। ওই দলগুলোর অনুপস্থিতিতে এই লিগগুলোর সৌন্দর্য্য কমবে নিশ্চিতভাবে, চাহিদাও কমে যাবে অনেকখানি।
করোনাভাইরাস মহামারীতে এমনিতেই ফুটবলের আয় কমে গেছে অনেক। মূলত সেই কোণঠাসা অবস্থা কাটিয়ে উঠতেই এই সুপার লিগের আয়োজন বলে দাবি করা হয়েছে।
তাহলে এই দলগুলোর অনুপস্থিতিতে ঘরোয়া লিগ হলে সেটার আয় স্বাভাবিকভাবে কমে যাবে আরও। সেই ধাক্কা কি পুষিয়ে উঠতে পারবে টুর্নামেন্টগুলো। এর বিরূপ প্রভাব আরও বেশি করে পড়বে ছোট দলগুলোর ওপর।
সবকিছুর বিবেচনায়, সুপার লিগ যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে তা বহাল থাকলে আগামীর ফুটবল দুনিয়ার চিত্র আমূল বদলে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।