মারাদোনা: প্রতিভা, মোহ, মাদক, দ্রোহ আর রোমাঞ্চ
স্পোর্টস ডেস্ক, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published: 26 Nov 2020 03:13 AM BdST Updated: 26 Nov 2020 04:16 PM BdST
বল পায়ে তিনি শিল্পী। নান্দনিকতার ঝংকারে মোহিত করে রাখা জাদুকর। নেতৃত্বে অনুপ্রেরণাদায়ী। আবেগ আর আত্মবিশ্বাস সেখানে মিলেমিশে একাকার। আর্জেন্টিনা ও নাপোলির অভাবনীয় সাফল্যের মহানায়ক। কখনও আবার তিনি ট্র্যাজেডির নায়ক। মাঠের ভেতরে-বাইরে বর্ণময় চরিত্র। বেহিসেবী, বিদ্রোহী, মাদকে বুঁদ, প্রাণশক্তিতে ভরপুর, বিতর্ক, উন্মাদনা, সব মিলিয়ে দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনা একজনই। তার মতো কেউ ছিল না। তার মতো কেউ হয়তো আর হবে না।
কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে বুধবার মারা গেছেন মারাদোনা। ফুটবল ইতিহাসের রোমাঞ্চকর এক অধ্যায়েরও সমাপ্তি ঘটল এতে।
তিনি বিশ্বজয়ী ফুটবলার। নেপলসের রাজা। ফুটবল ইতিহাসের সেরাদের একজন। অসংখ্য অর্জন, কীর্তি। সবকিছু বলেও যেন বলা হয় সামান্যই। ভিয়া ফিওরিতোর বস্তিতে ক্ষুধা ও দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে বেড়ে ওঠা কিশোর থেকে ‘ফুটবল ইশ্বর’ হয়ে ওঠার গল্প রূপকথার মতোই। কখনও কখনও তিনি হয়ে উঠেছেন ফুটবল খেলাটির চেয়েও বড়। ৬০ বছরে জীবনেই যাপন করেছেন যেন কয়েক জীবন!
যে জীবন মারাদোনার
১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর এক কারখানা শ্রমিকের ঘরে জন্ম মারাদোনার। বাবা-মার ৮ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম। ফুটবল বোঝার আগেই তার ফুটবল প্রেমের শুরু। উপহার পাওয়া ফুটবল নিয়ে ঘুমাতে যেত ছোট্ট দিয়েগো।
বস্তিতেই তার ফুটবল খেলার শুরু। দারিদ্রপীড়িত জীবনে মুক্তির অবলম্বন ছিল তাদের কাছে ফুটবল। ৮ বছর বয়সে তার ফুটবল প্রতিভা চোখে পড়ে এক স্কাউটের। তিনি মারাদোনাকে নিয়ে যান আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স ক্লাবে।
‘পৃথিবী যতদিন, মারাদোনা ততদিন’
মারাদোনার মৃত্যুতে কাঁদছে ফুটবলও
‘ঘৃণা ভুলে জাদুকর মারাদোনাকে মনে রাখো’
এরপর কেবলই ফুটবল জাদুতে মুগ্ধ করার পালা। ১৬তম জন্মদিনের আগেই ওই ক্লাবের হয়ে আর্জেন্টিনার প্রিমেরা ডিভিশনে অভিষেক। প্রতিযোগিতার ইতিহাসে তিনিই ছিলেন সেই সময় সর্বকনিষ্ঠ। প্রতিভার ঝলকে ১৬ বছর বয়সেই অভিষেক হয়ে যায় আর্জেন্টিনার হয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে।

বিশ্ব ফুটবল তখন এক মহাতারকা আগমণী বার্তা পেয়ে গেছে। তাকে নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সে ৫ বছরের অধ্যায় শেষে ১৯৮১ সালে তিনি যোগ দেন তার বোকা জুনিয়র্সে। শৈশবের প্রিয় ক্লাবের হয়ে অভিষেকেই করেন জোড়া গোল।
নতুন ক্লাবে কোচের সঙ্গে বনিবনা ভালো না হলেও দল জেতে শিরোপা। পরের বছরই সেই সময়ের রেকর্ড ট্রান্সফার ফিতে পাড়ি জমান তিনি বার্সেলোনায়।
বিশ্বকাপের বছরও ছিল সেটি। ১৯৮২ বিশ্বকাপে তিনি গিয়েছিলেন সম্ভাব্য নায়কদের একজন হিসেবে। হাঙ্গেরির বিপক্ষে দলের জয়ে দুটি গোল করলেও গোটা আসরে প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি তার পারফরম্যান্স। ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যাচে মাথা গরম করে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছেড়ে শেষ হয় তার ও দলের বিশ্বকাপ।
ক্লাব ফুটবলে তার বার্সেলোনা অধ্যায় খুব একটা সফল হয়নি চোট, অসুস্থতা আর নানা বিতর্ক মিলিয়ে। ১৯৮৪ সালে ট্রান্সফার ফির আরেক দফা রেকর্ড গড়ে তিনি পা রাখেন নেপোলিতে। নতুন ক্লাবে তাকে স্বাগত জানায় ৭৫ হাজার দর্শক। ক্লাব ও দেশের হয়ে তার সেরা সময়ের সূচনা তখন থেকেই।
নেপোলিতে দ্রুতই সমর্থকদের ভালোবাসা জয় করে নেন মারাদোনা। অধিনায়কত্বের আর্ম ব্যান্ডও পেয়ে যান। তার নেতৃত্বেই নেপোলি প্রথমবার সিরি আ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ পায়। পরে নেপোলিকে তিনি এনে দেন আরও একটি সিরি আ শিরোপা। সঙ্গে রানার্স আপ দুইবার। মাঝারি শক্তির দলকে ইতালিয়ান ফুটবলে পরাশক্তি করে তুলে তিনি হয়ে ওঠেন নেপলসের রাজা।
১৯৮৬ বিশ্বকাপে যান মারাদোনা আর্জেন্টিনার অধিনায়ক হিসেবে। অমরত্বের পথে তার পদচারণা শুরু সেই আসরেই। অসাধারণ পারফরম্যান্সে শিরোপা এনে দেন দলকে। দলের প্রতি ম্যাচের প্রতিটি মিনিট মাঠে ছিলেন তিনি। গোল করেন ৫টি, গোলে সহায়তা করেন ৫ বার।

কোয়ার্টার-ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জোড়া গোল করে কিংবদন্তির উচ্চতায় উঠে যান। টিভি রিপ্লেতে দেখা যায়, প্রথম গোলটি ছিল হেড করতে গিয়ে হাত দিয়ে করা। পরে যেটি পরিচিতি পেয়ে যায় ‘হ্যান্ড অব গড’ নামে। সেই গোল বিতর্কের খোরাক যেমন জোগায়, তাকে নিয়ে ‘মিথ’ ও উন্মাদনাও ছড়ায় আরও প্রবলভাবে।
হাত দিয়ে গোল করার মিনিট চারেক পরই ৫ জনকে কাটিয়ে, পরে গোলকিপারকেও কাটিয়ে গোল করেন আরেকটি। ফিফার জরিপে যেটি পরে বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেরা গোল ও শতাব্দীর সেরা গোল নির্বাচিত হয়।
সেমি-ফাইনালে বেলজিয়ামের বিপক্ষেও উপহার দেন দুই গোল। একটি গোল ছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় গোলটির মতোই অবিশ্বাস্য ড্রিবলিং ও স্কিলের ফসল। ফাইনালে পশ্চিম জার্মানি তাকে কড়া মার্কিংয়ে রাখে পুরোটা সময়। তার পরও দলের জয়সূচক গোলটি আসে তার পাস থেকে। মারাদোনার শ্রেষ্ঠত্ব লেখা হয়ে যায়।
মারাদোনার মৃত্যুতে ১০ নম্বর জার্সি বন্ধের আহ্বান
‘আমি মারাদোনা, আমি গোল করি, ভুলও করি’
১৯৯০ বিশ্বকাপে মাঝারি শক্তির দল নিয়ে ফাইনালে ওঠে আর্জেন্টিনা ফাইনালে ওঠে। চোটের কারণে মারাদোনার সেরাটা দেখা যায়নি এবার। তারপরও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন পারফরম্যান্স ও নেতৃত্বে। ফাইনালে পেনাল্টি গোলে তারা হেরে যায় পশ্চিম জার্মানির কাছে।
আলো থেকে আঁধারে
আশির দশক থেকেই মাদকের সঙ্গে তার সখ্যের শুরু। ধারণা করা হয়, ১৯৮৩ সালে বার্সেলোনায় থাকার সময় কোকেনে আসক্ত হন। মাদক নিয়েই বছরের পর বছর যেমন অসাধারণ পারফর্ম করেন, তেমনি তার পারফরম্যান্সে ও আচরণেও তা প্রভাব ফেলে অনেক অনেক সময়।
১৯৯০ বিশ্বকাপের পর থেকে ড্রাগ ও অ্যালকোহলের ছোবলে মিলিয়ে যেতে থাকে তার ফুটবল জাদু। ডোপ পরীক্ষায় ধরা পড়ে ১৯৯১ সালে তিনি নিষিদ্ধ হয় ১৫ মাসের জন্য।

এতকিছুর মধ্যেও ১৯৯৪ বিশ্বকাপের আগে নিজেকে খানিকটা গুছিয়ে নিয়ে অধিনায়ক হিসেবে যান বিশ্বকাপ খেলতে। প্রথম ম্যাচে দলের বড় জয়ে অসাধারণ এক গোল উপহার দেন। দ্বিতীয় ম্যাচেও দলের দুই গোলের জয়ে দুটিতেই রাখেন অবদান। পরের ম্যাচের আগেই খবর আসে ডোপ পরীক্ষায় আরেকদফা ব্যর্থ হওয়ার। এবারও নিষিদ্ধ ১৫ মাসের জন্য। ১৭ বছরের আন্তর্জাতিক ফুটবল ক্যারিয়ারের সেখানেই সমাপ্তি।
নানা বিতর্ককে সঙ্গী করে ক্লাব ফুটবল খেলে গেছেন আরও কিছুদিন। বোকা জুনিয়র্সের হয়ে খেলে পেশাদার ফুটবলকে বিদায় জানান ১৯৯৭ সালে।
ব্যক্তিগত অর্জন ও স্বীকৃতি পেয়েছেন অসংখ্য। যুব বিশ্বকাপ ও মূল বিশ্বকাপ, দুটিতেই গোল্ডেন বল জয়ী প্রথম ফুটবলার ছিলেন তিনি। ২০০০ সালে ফিফার অনলাইন জরিপে শতাব্দী সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হয়েছিলেন বিপুল ভোট পেয়ে।
খেলা ছাড়ার আগেই টুকটাক কোচিং করানো শুরু করেছিলেন। তবে বড় দায়িত্ব পান ২০০৮ সালে, আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের কোচ হিসেবে। ২০১০ বিশ্বকাপে জার্মানির কাছে কোয়ার্টার-ফাইনালে হারার পর শেষ হয় তার দায়িত্ব। পরে নানা জায়গায় ক্লাব ফুটবলে কোচিং করিয়েছেন, থিতু হতে পারেননি কোথাও।
মাদকাসক্তি ও মাঠের বাইরে উচ্ছৃঙ্খল জীবনের পাশাপাশি কখনও ভক্ত দর্শককে লাথি মারা, সাংবাদিককে চড় মারা, একবার সাংবাদিকদের ওপর এয়ার রাইফেল দিয়ে গুলি ছোঁড়া, কর ফাঁকি, এসব অসংখ্য বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। এমনকি আর্জেন্টিনার কোচ থাকার সময়ও আপত্তিকর মন্তব্য করে নিষেধাজ্ঞা পেয়েছেন। আর্জেন্টিনায় ও দেশের বাইরেও সব জায়গায় সংবাদমাধ্যম তাকে অনুসরণ করেছে সবসময়।
‘একদিন স্বর্গে একসঙ্গে ফুটবল খেলব’, মারাদোনার মৃত্যুতে পেলে
গত কয়েক বছরে অবশ্য তিনি খবরের শিরোনামে বেশি এসেছেন নানা সময়ে বিতর্কিত ও চটকদার সব মন্তব্য করে।
রাজনীতি নিয়েও নিজের অবস্থান প্রকাশ্যে জানিয়েছেন সবসময়। কিউবার বিপ্লবী ও রাষ্ট্রনায়ক ফিদোল কাস্ত্রোর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ছিল কিংবদন্তি পর্যায়ের। কিউবার তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন কাস্ত্রো। দুজনে একসঙ্গে সময় কাটিয়েছেন অনেক। এছাড়াও নানা সময়ে রাজনৈতিক অবস্থান ও বক্তব্য দিয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন তিনি।
শরীরের ওপর এত অত্যাচার করেছেন, শরীরও সেই প্রতিশোধ নিয়েছে। মাদক পুনর্বাসন কেন্দ্রে কয়েকবারই যেতে হয়েছে তাকে। হাসপাতালও তার ঠিকানা হয়েছে অনেকবার। এবার চিরস্থায়ী ঠিকানায় চলে যেতে হলো। প্রিয় বন্ধু কাস্ত্রোর মৃত্যুদিনেই মারাদোনা পাড়ি জমালেন অসীমে।
তবে চলে যাওয়া মানেই তো প্রস্থান নয়! ফুটবল যতদিন থাকবে, মারাদোনা থাকবেন নানা গল্পগাঁথায়, আনন্দ-অশ্রুতে, শত কোটি ভক্তের ভক্তি- শ্রদ্ধা-ভালোবাসায়। দ্রোহের আগুনে সদা জ্বলতে থাকা বর্ণময় ও প্রথাবিরোধী জীবনের গল্প রোমাঞ্চ ছড়াবে যুগ যুগ ধরে। তিনি নিজেই বলে গেছেন নিজের কথা, “আমি মারাদোনা, যে গোল করে, যে ভুলও করে। কিন্তু আমি সব নিতে পারি। সবার সঙ্গে লড়াই করার মতো যথেষ্ট চওড়া কাঁধ আমার আছে।”
সবকিছু মিলিয়েই মারাদোনা নিশ্চিত করে গেছেন, তাকে মনে রাখতেই হবে!
সর্বাধিক পঠিত
- নোয়াখালীতে ফের গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের মামলা
- দ্বিতীয় ধাপের ভোটে মেয়র হলেন যারা
- ভোটে জিতে কাদের মির্জা বললেন, কথা বলে যাব
- বিমানের সহযাত্রী করোনাভাইরাস পজিটিভ, কোয়ারেন্টিনে ৪৭ খেলোয়াড়
- সিরাজগঞ্জে ফল ঘোষণার পর সংঘর্ষে কাউন্সিলর পদে বিজয়ী নিহত
- তিন নতুন মুখের ব্যাখ্যা প্রধান নির্বাচকের
- অঁজিকে হারিয়ে শীর্ষে পিএসজি
- অভিষেকে অনুজ্জ্বল টেন্ডুলকারের ছেলে
- করোনাভাইরাস: সাড়ে আট মাসের সর্বনিম্ন রোগী শনাক্ত
- উইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে দলে হাসান-শরিফুল-মেহেদি