যে আকাশছোঁয়া স্বপ্ন নিয়ে ২০১৩ সালে ইউরোপে পাড়ি জমান নেইমার, বার্সেলোনার জার্সিতে শুরুতে তা সত্যি হওয়ার আভাসও মেলে। চার বছরের সেই অধ্যায়ে কাতালান ক্লাবটির অনেক সাফল্যের কারিগর ছিলেন তিনি; লিওনেল মেসি ও লুইস সুয়ারেসের সঙ্গে গড়েন বিধ্বংসী আক্রমণত্রয়ী, জেতেন একটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও দুটি লা লিগাসহ আটটি শিরোপা। কিন্তু কখনোই ‘মেসির ছায়া’ থেকে বের হতে পারেননি তিনি।
নেইমার যদিও নিজে কখনও তেমন কিছু বলেননি। তবে অনেক ফুটবল বিশেষজ্ঞের মতে, বিশ্ব ফুটবলে নিজেকে সেরার আসনে বসাতেই ২০১৭ সালে তিনি যোগ দেন পিএসজিতে।
প্রতিপক্ষ নেইমারের বিপক্ষে পিএসজির হতাশার চিত্র সেবারই প্রথম নয়; ২০১৪-১৫ আসরেও লেখা হয়েছিল প্রায় একই গল্প। সেবার কোয়ার্টার-ফাইনালের প্রথম লেগে পিএসজির মাঠে বার্সেলোনার ৩-১ ব্যবধানের জয়ে দলকে ম্যাচের শুরুতেই এগিয়ে দেন নেইমার। আর ফিরতি লেগে ঘরের মাঠে দলের ২-০ ব্যবধানে জয়ে দুটি গোলই করেন তিনি।
তিন বছরের মধ্যে অমন দুটি হারের পরই পিএসজি কর্তৃপক্ষ উঠেপড়ে লাগে নেইমারকে পেতে। তার বিশাল অঙ্কের রিলিজ ক্লজও বাধা হতে পারেনি।
তবে, এই মৌসুমের আগ পর্যন্ত নেইমারের পিএসজি অধ্যায় মোটেও সুখকর নয়। বার্সেলোনা শিবিরের সফল মেধাবী নেইমার প্যারিসে এসে হয়ে ওঠেন অসুখী। সতীর্থদের সঙ্গে বারবার বিবাদে জড়িয়ে পড়েন, কর্তৃপক্ষও তাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিল।
গণমাধ্যমে মাঝেমধ্যেই খবর আসতে থাকে, নেইমার ফিরতে চান পুরনো ঠিকানায়। ২০১৯ এর গ্রীষ্মে তিনি নিজেও সরাসরি বার্সেলোনায় ফেরার ইচ্ছার কথা জানান। তবে দুই পক্ষের দর কষাকষিতে শেষ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি।
প্যারিসে তার শুরুর এই হতাশার গল্পে বড় এক কারণ ছিল চোট ধাক্কাও। এ সময় বারবার চোটে পড়েন তিনি এবং সেজন্য অনেকটা সময় তাকে কাটাতে হয় মাঠের বাইরে।
২০১৯ সালের শুরুতে আবারও পায়ের চোটে ছিটকে যান নেইমার। ফলে খেলতে পারেননি ইউরোপ সেরা প্রতিযোগিতায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে শেষ ষোলোর দুই লেগেই। সেবার ঘরের মাঠে ফিরতি লেগের শেষ সময়ে ‘বিতর্কিত’ এক পেনাল্টি গোলে ম্যাচটি জিতে যায় ইউনাইটেড। আর ওই অ্যাওয়ে গোলেই এগিয়ে যায় তারা, বিদায় নেয় পিএসজি।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের এবারের আসরেও শুরুতে দেখা যায়নি নেইমারকে। গত নভেম্বরে গ্রুপ পর্বে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে ২-২ ড্র ম্যাচে প্রথম মাঠে নামেন তিনি। ততদিনে তিনি বুঝে যান, আপাতত তার বার্সেলোনায় ফেরা হচ্ছে না। আক্রমণভাগের সতীর্থ কিলিয়ান এমবাপের সঙ্গেও ফুটবল উপভোগ করতে শুরু করেন তিনি।
ধীরে ধীরে নেইমার হয়ে উঠেছেন ঠিক তাই, যা দল তার কাছে আশা করে। পিএসজি প্রকল্পের কেন্দ্রবিন্দু এখন তিনি। পেছনের হতাশা পেছনে ফেলে যে এখন সুখী হয়ে উঠেছেন, তা তার অভিব্যক্তিতেই ফুটে উঠছে। এমবাপের সঙ্গে মাঠে ও মাঠের বাইরে তার বন্ধুত্ব বেশ জমে উঠেছে। এক সাক্ষাৎকারে তেমনটাই বললেন বিশ্বকাপজয়ী ফরাসি ফরোয়ার্ড।
“আমরা কাছাকাছি বয়সের। মাঠের বাইরে আমরা একসঙ্গে আনন্দ করি। আমরা খুব দ্রুত বন্ধু হয়ে উঠেছি।”
“আমরা একে অপরকে সম্মান করি, আমরা অনেক আনন্দ করি। আগের থেকে এখন আমরা নিজেদের নিয়ে কম ভাবি, বরং সতীর্থদের নিয়ে বেশি ভাবি। কারণ, আমরা বুঝতে পেরেছি যে ম্যাচ জিততে সবাইকে প্রয়োজন। আমরা দুজন মিলে তা করতে পারব না।”
নেইমারের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সেও তা ফুটে উঠেছে। ২৮ বছর বয়সে তিনি দ্বিতীয় চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জিততে মরিয়া। আগেরবার জিতেছিলেন ২০১৫ সালে।
পিএসজির হয়ে সব প্রতিযোগিতা মিলে এখন পর্যন্ত ৮৪ ম্যাচে ৭০ গোল করেছেন নেইমার। ক্লাবের ভক্ত-সমর্থকরা নিশ্চয় আশায় আছে, এই তারকা ফরোয়ার্ড তার পরের গোলটি করবেন রোববারের ফাইনালে। অধিনায়ক ও তার জাতীয় দল সতীর্থ চিয়াগো সিলভাও সেই আশায় বুক বেঁধেছেন।
“আশা করি, ঈশ্বর তাকে রোববার গোল করতে এবং আমাদের জেতাতে সাহায্য করবেন।”
আর তা হলে আরেকটি চাওয়া পূরণের পথে এগিয়ে যেতে পারেন নেইমার। সময়ের সেরা খেলোয়াড়ের প্রশ্নে অনেকেই লিওনেল মেসি ও ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর পেছনে রাখেন ব্রাজিলিয়ান তারকাকে। রোনালদোর ইউভেন্তুস ছিটকে গেছে শেষ ষোলো থেকে, মেসির বার্সেলোনা কোয়ার্টার-ফাইনালে স্রেফ উড়ে গেছে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে। পিএসজিকে শিরোপা জিতিয়ে নেইমারের সামনে সুযোগ সময়ের সেরা হিসেবে নিজের দাবি জোরালো করার।
মহামারীর এ বছরে যদিও দেওয়া হবে না বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার ব্যালন ডি’অর। আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না পেলেও অনেকের কাছে বর্ষসেরা ফুটবলার হিসেবে হয়তো তখন বিবেচিত হবেন নেইমার।