রিয়াল মাদ্রিদে রোনালদোর প্রভাব

সান্তিয়াগো বের্নাবেউয়ে কাটিয়েছেন ক্যারিয়ারের স্বপ্নের নয়টি মৌসুম। রিয়াল মাদ্রিদকে জিতিয়েছেন সম্ভাব্য সব কিছু; চ্যাম্পিয়ন্স লিগ চারবার, লা লিগা দুইবারসহ অনেক শিরোপা। দলকে যেমন তুলেছেন সাফল্যের চূড়ায়, তেমনি ব্যক্তিগত অর্জনও তার আকাশছোঁয়া। একাধিকবার জিতেছেন বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার, হয়েছেন ইউরোপ সেরার প্রতিযোগিতায় সর্বোচ্চ গোলদাতা, গড়েছেন আরও অনেক রেকর্ড। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে বছর দুয়েক হলো মাদ্রিদ ছেড়ে তুরিনে পাড়ি দিয়েছেন ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো, তবে স্পেনের সফলতম ক্লাবটিতে তার সব অর্জন নিয়ে নিয়মিতই হয় চর্চা।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 June 2020, 05:03 PM
Updated : 27 June 2020, 05:34 PM

২০০৯ সালের ২৬ জুন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে সান্তিয়াগো বের্নাবেউয়ে নাম লেখান রোনালদো। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, রোনালদোকে পেতে রিয়ালের খরচ হয়েছিল সেই সময়ের রেকর্ড ৯ কোটি ৪০ লাখ ইউরো। অনেকেই তখন বলেছিলেন, রোনালদোর জন্য বেশি খরচ করেছে রিয়াল। ২০১৮ সালে বের্নাবেউ ছেড়ে ইউভেন্তুসে যোগ দেন রোনালদো। এরপর ধীরে ধীরে তার শূন্যতা যেন শুধু বড়ই হয়েছে। সবাই যেন নতুন করে বুঝতে পারে, ফুটবলের জন্য, রিয়ালের জন্য কী অসাধারণ এক দলবদলই না ছিল পর্তুগিজ ফরোয়ার্ড!

রোনালদোর রিয়ালে যোগ দেওয়ার ১১ বছর পূর্ণ হয়েছে গত শুক্রবার। ক্রীড়া উপাত্ত বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান অপটার পরিসংখ্যানে বিশেষ এই দিনে ক্লাবটিতে তার সাফল্য তুলে ধরেছে স্প্যানিশ পত্রিকা এএস। 

শুরুর বছরগুলো-অন্য উচ্চতার সন্ধানে

ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে থাকতে জিতেছিলেন ব্যালন ডি’অর। প্রতিভার প্রমাণ দিয়েই এসেছিলেন রিয়ালে। স্পেনের সফলতম দলটির হয়ে প্রথম মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৩৩ গোল করেছিলেন রোনালদো। ইংল্যান্ডে কাটানো ছয় মৌসুমে এর চেয়ে বেশি গোল করেছিলেন কেবল একবার।

এটি ছিল স্রেফ শুরু। পরের মৌসুমগুলোতে যেন গোলের বন্যা বইয়ে দেন তিনি। রিয়ালের হয়ে তার কাটানো নয় মৌসুমের মধ্যে ২০০৯-১০ মৌসুমেই কেবল ৪০ গোলের মাইলফলক ছুঁতে পারেননি। সময় যত গড়িয়েছে তার ম্যাচ খেলার সংখ্যা বেড়েছে। ধারাবাহিকতা ধরে রাখা আর ক্লান্তিহীন মৌসুমপ্রতি ৫০ এর বেশি ম্যাচ খেলার ব্যাপারগুলো ছিল অবিশ্বাস্য।

রিয়ালের জার্সিতে রোনালদো প্রথম শিরোপা জেতেন ২০১০-১১ মৌসুমে; কোপা দেল রে। ওই মৌসুমে ৫৪ ম্যাচে ৬৯ গোলে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। ৫৩ গোল করা পর্তুগিজ ফরোয়ার্ড অবদান রাখেন ১৬ গোলে। পরের মৌসুমে করেন ৬০ গোল, অ্যাসিস্ট ১৫টি। তার দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে চার বছরের মধ্যে প্রথম লা লিগা শিরোপা জেতার পাশাপাশি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমি-ফাইনালে খেলে রিয়াল।

২০১২ সাল নাগাদ কেউ কেউ তাকে রাখতে শুরু করেন সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়ের তালিকায়। পরের বছরগুলোতে এই দাবির পক্ষে সমর্থন বাড়তে থাকে।

সেরার পথে এগিয়ে যাওয়া

দীর্ঘদিন ধরে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ রিয়ালের জন্য ছিল হাহাকারের এক নাম। নিজের প্রথম পাঁচ মৌসুমে টানা তিনবার শেষ চার থেকে বিদায় নেওয়ায় ইউরোপ সেরার শিরোপাটা বড় লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল রোনালদোর নিজের জন্যও।

রিয়ালের অপেক্ষাটা ছিল আরও দীর্ঘ। ২০০১-০২ মৌসুমের পর থেকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে নিজেদের দশম শিরোপা বা ‘লা দেসিমার’ জন্য প্রহর গুনছিল তারা। প্রতীক্ষার অবসান হয় ২০১৩-১৪ মৌসুমে। সেবার রিয়াল জেতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও কোপা দেল রের ‘ডাবল’। যেখানে বড় অবদান ছিল মৌসুমে ৬৫ গোলে যুক্ত (৫১ গোল, ১৪ অ্যাসিস্ট) থাকা রোনালদোর।

ফাইনালে নগরপ্রতিদ্বন্দ্বী আতলেতিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে শেষ দিকে পেনাল্টি থেকে গোল করেন রোনালদো। আসরে তার মোট গোল ছিল ১৭টি, যা প্রতিযোগিতার এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড হিসেবে টিকে আছে এখনও।

পরের চার মৌসুমে রিয়াল চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা ঘরে তোলে আরও তিনবার। টানা তিন মৌসুমে জিতে করে হ্যাটট্রিক। তবে যেবার শিরোপাটা তারা পায়নি, সেই ২০১৪-১৫ মৌসুম ছিল ব্যক্তিগত সাফল্যে রোনালদোর সেরা। সেবার তিনি নিজে ৬১ গোল করার পাশাপাশি সতীর্থদের দিয়ে করান ২১টি।

ওই তিন ফাইনালের কেবল একটিতে জালের দেখা পান রোনালদো, ইউভেন্তুসের বিপক্ষে ৪-১ ব্যবধানের জয়ে করেন দুই গোল। এর আগের বছরের ফাইনালে টাইব্রেকারে দলের শেষ শটে বল জালে পাঠিয়ে আতলেতিকো সমর্থকদের হৃদয় ভেঙেছিলেন আরেকবার।

রিয়ালের হয়ে তার সবশেষ দুই মৌসুমে রোনালদো জেতেন মোট আটটি শিরোপা। এই সময়ে গোল করেন তিনি ৮৬টি, ভাগ বসান তখন পর্যন্ত পাঁচটি ব্যালন ডি’অর জেতা লিওনেল মেসির রেকর্ডে।

অসাধারণ পথচলায় রোনালদো হয়ে ওঠেন রিয়াল মাদ্রিদের প্রতিশব্দ। ২০১৮ সালে দুই পক্ষের দুটি পথ বেঁকে যায় দুই দিকে, সমাপ্তি ঘটে আধুনিক ফুটবলে অন্যতম সেরা খেলোয়াড়-ক্লাব সম্পর্কের।

রিয়ালের রোনালদোর অবিশ্বাস্য রেকর্ড

রিয়ালের হয়ে নয় মৌসুমে রোনালদো করেন মোট ৪৫০ গোল, সতীর্থদের দিয়ে গোল করান ১১৯টি। গড়েন ক্লাবের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড।

রিয়ালের হয়ে সর্বোচ্চ গোলের তালিকায় আগের রেকর্ডধারী রাউল গনসালেসকে (৩২৩ গোল) রোনালদো ছাড়িয়ে যান ২০১৫ সালে। এর আগেই পেছনে ফেলেন ফেরেঙ্ক পুসকাস, কার্লোস সান্তিয়ানা ও আলফ্রেদো দি স্তেফানোকে।

রোনালদোর ৪৫০ গোলের ৩১১টি এসেছে লা লিগায়। স্পেনের শীর্ষ লিগে রোনালদোর চেয়ে বেশি গোল আছে আর কেবল একজনের, বার্সেলোনার লিওনেল মেসির ৪৪০টি। অবশ্য আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড ক্যারিয়ারের শুরু থেকে শুধু স্পেনেই খেলছেন।

রোনালদো লা লিগা ছেড়ে যাওয়ায় প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডাররা হয়তো হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। লিগে সবচেয়ে বেশি গোল করেছেন তিনি সেভিয়ার বিপক্ষে, ২৭টি। তালিকায় এরপর আছে যথাক্রমে গেতাফে (২৩), আতলেতিকো মাদ্রিদ (২২), সেল্তা ভিগো (২০) ও বার্সেলোনা (১৮)।  

শুধু লা লিগাতেই নয়, চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও রোনালদো ছিলেন ধারাবাহিক। টানা সাত মৌসুমে কমপক্ষে ১০ গোল করা ও একক কোনো দলের হয়ে প্রতিযোগিতায় ১০০ গোল করা প্রথম খেলোয়াড় তিনিই।

রোনালদোর বয়স এখন ৩৫। ইউভেন্তুসে যাওয়ার পরও ধরে রেখেছেন সাফল্য ধারা, এখনও ছুটছেন দুর্বার গতিতে। তবে তার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে রিয়াল মাদ্রিদেই। ভবিষ্যতে মাদ্রিদের দলটি আবার কখনও এমন কিছু দেখতে পাবে কি-না, কে জানে!