জাদুকরী কত মুহূর্ত উপহার দিয়েছেন ৩২ বছর বয়সী মেসি। বার্সেলোনা ও আর্জেন্টিনার হয়ে তার সেরা ১০ স্মরণীয় মুহূর্ত তুলে ধরেছে বিবিসি।
বার্সেলোনা ৩-৩ রিয়াল মাদ্রিদ, ১০ মার্চ ২০০৭
মেসির প্রথম হ্যাটট্রিকটি ছিল রাজসিক। যেটি করেছিলেন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে। তখনকার ১৯ বছর বয়সী মেসির কাম্প নউয়ে সেটি ছিল প্রথম এল ক্লাসিকো। হ্যাটট্রিক পূরণের গোলটি ছিল দুর্দান্ত।
নির্ধারিত সময়ের মিনিট তিনেক বাকি থাকতে রোনালদিনিয়োর পাস যখন ডি-বক্সের একটু সামনে পান মেসি, তাকে ঘিরে রেখেছিলেন রিয়ালের তিন জন খেলোয়াড়। বাম দিক দিয়ে ঢুকে সব বাধা পেরিয়ে বাঁ পায়ের শটে গোলরক্ষককে পরাস্ত করেন মেসি। তার সমতাসূচক সেই গোলে এক পয়েন্ট নিয়ে মাঠ ছাড়ে বার্সেলোনা।
বার্সেলোনা ৫-২ গেতাফে, ১৮ এপ্রিল ২০০৭
১৩ বছর আগে কোপা দেল রের সেমি-ফাইনালের প্রথম লেগে মেসির সেই গোলকে এখনও তার ক্যারিয়ারের সেরা গোল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোল বললেও হয়তো ভুল হবে না। এটি ছিল অনেকটা ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দিয়েগো মারাদোনার পায়ের জাদুতে করা গোলটির মতো।
মেসি বল পেয়েছিলেন নিজেদের অর্ধে। সেখান থেকে দৌড় শুরু করে পাঁচ জনকে কাটিয়ে গোলরক্ষককেও বোকা বানিয়ে গোলটি করেন তিনি।
বার্সেলোনা ২-০ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, ২৭ মে ২০০৯
অবিশ্বাস্য শোনালেও একটা সময় ছিল যখন ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায় ইংলিশ ক্লাবগুলোর বিপক্ষে মেসির পারফরম্যান্স নিয়ে প্রশ্ন উঠত হারহামেশা। ২০০৯ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের আগে এই প্রতিযোগিতায় ইংলিশ ক্লাবগুলোর বিপক্ষে ১০ ম্যাচে গোল করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি।
সেবার রোমের ফাইনালে যেন সবকিছুর জবাব দেন মেসি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে দলের দ্বিতীয় গোলটি করেন আর্জেন্টিনা তারকা। চাভির ক্রস থেকে লাফিয়ে উঠে হেড থেকে জালের দেখা পান তিনি। ইউনাইটেডকে ২-০ ব্যবধানে হারিয়ে শিরোপা জেতে বার্সেলোনা। মেসি ও ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর মুখোমুখি লড়াইয়ের শুরুও সেটি।
দুই বছর পর বিখ্যাত ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে ইউরোপ সেরার ফাইনালে ইউনাইটেডের বিপক্ষে ৩-১ গোলের জয়েও একটি গোল করেন মেসি। জেতেন তার চার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপার তৃতীয়টি।
বার্সেলোনা ৪-১ আর্সেনাল, ৬ এপ্রিল ২০১০
ক্যারিয়ারে সেবারই প্রথম এক ম্যাচে চার গোল করেন মেসি। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার-ফাইনালের প্রথম লেগে আর্সেনালের মাঠে ২-২ গোলে ড্রয়ের পর নিজেদের মাঠে ফিরতি ম্যাচ খেলতে নেমেছিল বার্সেলোনা। শুরুতে গোল হজম করে তারা। তবে প্রথমার্ধেই মেসি পূরণ করেন হ্যাটট্রিক। ম্যাচের শেষ দিকে গোল করেন আরেকটি।
দুই বছর পর নিজেকেই ছাড়িয়ে যান মেসি। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ ষোলোয় জার্মান ক্লাব বায়ার লেভারকুজেনকে ৭-১ গোলে হারায় বার্সেলোনা, এর পাঁচটি গোলই করেন মেসি।
১১৪ গোল নিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা মেসি। ১২৮ গোল নিয়ে তার ওপরে আছেন কেবল রোনালদো।
বার্সেলোনা ৫-৩ গ্রানাদা, ২০ মার্চ ২০১২
সেবার গ্রানাদার বিপক্ষে দারুণ এক হ্যাটট্রিকের পথে বার্সেলোনার হয়ে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড নিজের করে নেন মেসি। বয়স তখন কেবল ২৪।
ম্যাচে নিজের প্রথম গোলে স্পর্শ করেন সেসার রদ্রিগেসের ২৩২ গোলের আগের রেকর্ড। দ্বিতীয় গোলে ছাড়িয়ে যান পূর্বসূরিকে। আর হ্যাটট্রিক পূরণ করে বাড়িয়ে নেন রেকর্ড।
মেসির বয়স এখন ৩২। বার্সেলোনার হয়ে তার নামের পাশে গোল ৬২৭টি- যে কারও চেয়ে প্রায় ৪০০টি বেশি। সামনে বাড়বে আরও।
রিয়াল ভাইয়াদলিদ ১-৩ বার্সেলোনা, ২২ ডিসেম্বর ২০১২
সেদিন ভাইয়াদলিদের বিপক্ষে একটি গোল করে এক পঞ্জিকাবর্ষে সর্বোচ্চ গোলের অনন্য এই কৃতিত্ব গড়েন মেসি। বার্সেলোনা তারকার এই রেকর্ড ভাঙা অসম্ভব বলে মনে করা হয় এখনও।
ওই বছর বার্সেলোনার হয়ে মেসি করেন ৭৯ গোল, ১২টি আর্জেন্টিনার জার্সিতে। সব মিলে ম্যাচ খেলেন ৬৯টি।
মেসির টানা চতুর্থ ব্যালন ডি’অর জয়ের জন্য ওই কীর্তিই যথেষ্ট ছিল সেবার। কিন্তু এত গোল করলেও ২০১২ সালে জিততে পেরেছিলেন কেবল কোপা দেল রের শিরোপা।
জার্মানি ১-০ আর্জেন্টিনা, ১৩ জুলাই ২০১৪
বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জয়- তাত্ত্বিকভাবে এটি মেসির অন্যতম সেরা মুহূর্ত হওয়া উচিত। কেননা, আর্জেন্টিনার হয়ে অলিম্পিক ফুটবল ইভেন্টের সোনা জয় ছাড়া আর কোনো সাফল্য নেই তার। তবে তাকে গোল্ডেন বল দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিল বিতর্ক। ওই আসরে মেসি তার চারটি গোলই করেন গ্রুপ পর্বে। নকআউট পর্বে জ্বলে উঠতে পারেননি। ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে হারের ম্যাচেও ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে।
এমনকি তখনকার ফিফা সভাপতি সেপ ব্লাটার পর্যন্ত বলেছিলেন, মেসিকে বিশ্বকাপের সেরা হতে দেখে তিনি অবাক হয়েছেন। আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি মারাদোনার মতে, সিদ্ধান্তটা ছিল ‘অন্যায্য।’
বার্সেলোনার হয়ে সাফল্যের ভাণ্ডার অনেক সমৃদ্ধ হলেও জাতীয় দলের হয়ে এখনও কিছুই জেতা হয়নি মেসির। ২০১৪ সালের আসরে বিশ্বকাপ জয়ের খুব কাছে গিয়েছিলেন। চার বছর পর রাশিয়া বিশ্বকাপে তার দল বিদায় নেয় কোয়ার্টার-ফাইনাল থেকে।
২০১৬ সালে তৃতীয়বারের মতো কোপা আমেরিকা ফাইনালে হারের পর আচমকা আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নেন মেসি। পরে অবসর ভেঙে ফেরে ফিরে আসেন।
বার্সেলোনা ৫-১ সেভিয়া, ২২ নভেম্বর ২০১৪
আরেকটি হ্যাটট্রিকের পথে আরেকটি রেকর্ড। সেভিয়ার বিপক্ষে দারুণ এক ফ্রি-কিকে গোল করে লা লিগায় সর্বোচ্চ গোলের আগের রেকর্ডধারী তেলমো সাররার ২৫১ গোলের রেকর্ড স্পর্শ করেন মেসি। নিজের দ্বিতীয় গোলে ছাড়িয়ে যান আথলেতিক বিলবাও কিংবদন্তিকে। হ্যাটট্রিক পূরণ করে সমৃদ্ধ করেন রেকর্ড।
লিগে মেসির গোল এখন ৪৩৮টি। আগের রেকর্ডধারীর চেয়ে প্রায় ২০০টি বেশি এবং দ্বিতীয় স্থানে থাকা রোনালদোর চেয়ে ১০০টির বেশি। রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে ইউভেন্তুসে পাড়ি জমানোর আগে পর্তুগিজ ফরোয়ার্ড রোনালদো স্পেনের শীর্ষ লিগে করেন ৩১১ গোল।
রিয়াল মাদ্রিদ ২-৩ বার্সেলোনা, ২৩ এপ্রিল ২০১৭
কখনও কখনও কোনো একটা গোলকে একদম ‘নিখুঁত’ মনে হয়। তেমনই একটি গোল ছিল এটি। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদের মাঠে শ্বাসরুদ্ধকর এল ক্লাসিকোর অন্তিম মুহূর্তে বল জালে পাঠিয়ে বার্সেলোনাকে জয় এনে দেওয়ার পাশাপাশি ক্লাবের হয়ে ৫০০ গোলের মাইলফলক স্পর্শ করেন মেসি। জর্দি আলবার ক্রসে ডি-বক্সের একটু ভেতর থেকে বাঁকানো শটে কেইলর নাভাসকে ফাঁকি দেন তিনি।
এরপরই তার সেই ঐতিহাসিক উদযাপন। জার্সি খুলে রেফারির হলুদ কার্ডে ভ্রুক্ষেপ না দেখিয়ে সান্তিয়াগো বের্নাবেউয়ের স্তব্ধ গ্যালারির দিকে তুলে ধরেন মেসি।
গত বছরের ডিসেম্বরে রোনালদো ও ভার্জিল ফন ডাইককে পেছনে ফেলে রেকর্ড ষষ্ঠবারের মতো ব্যালন ডি’অর জেতেন মেসি। ছাড়িয়ে যান পাঁচবার ব্যালন ডি’অর জেতা রোনালদোকে। ২০১৮-১৯ মৌসুমে ক্লাব ও জাতীয় দলের হয়ে সব প্রতিযোগিতা মিলে ৫৮ ম্যাচ খেলে ৫৪ গোল করে বর্ষসেরার এই পুরস্কার জেতেন তিনি।
২০১২ সালের পর এটি ছিল তার কেবল দ্বিতীয় ব্যালন ডি’অর জয়- অন্যটি এসেছিল ২০১৫ সালে।
“এখনও অনেকগুলো সুন্দর বছর আমার সামনে আছে”- পুরস্কার জয়ের পর বলেছিলেন মেসি।
বুট জোড়া তুলে রাখার আগে আরও কত স্মরণীয় মুহূর্তের জন্ম দেবেন মেসি?