‘ভাগ্যগুণে’ বিশ্বকাপ যাদের

সেকালের ইয়োহান ক্রুইফ, ফ্রেঙ্ক পুসকাস, আলফ্রেদো দে স্তেফানো, জিকো; একালের ডেভিড বেকহ্যাম, মাইকেল বালাক, ফিগো, রাউল গনসালেস-ফুটবলের কত না বড় নাম, সমৃদ্ধ অর্জনের ভাণ্ডার। তারপরও তাদের প্রাপ্তির থলিতে বড় এক শূন্যতা, জেতা হয়নি বিশ্বকাপ! সময়ের দুই সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসি ও ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো-অনেকের কাছে যারা ইতিহাসের অন্যতম সেরা। এখনও তারা খেলে যাচ্ছেন বটে, কিন্তু ফুরিয়ে আসছে অধরা সেই স্বপ্ন পূরণের আশা।

আব্দুল মোমিনআব্দুল মোমিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 May 2020, 03:08 AM
Updated : 14 May 2020, 03:08 AM

বিপরীতে বিশ্বকাপ জয়ীদের তালিকায় এমন কিছু নামও আছে, শুধু ‘ভাগ্যগুণে’ যাদের মাথায় উঠেছে বিশ্বসেরার মুকুট। আজকের গল্প তেমন একটি একাদশ নিয়ে।

ফেলিক্স, ব্রাজিল ১৯৭০

দেশের ইতিহাসে সেরা তো বটেই, কারো কারো মতে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা আক্রমণভাগের দল ছিল ১৯৭০ বিশ্বকাপ জয়ী ব্রাজিল। সেই দলের সদস্য ছিলেন এই ফেলিক্স, পোস্টে যার পজিশনিং ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। প্রতিপক্ষের ক্রসের সময় তার শরীরি ভাষায় সমর্থকদের আত্মবিশ্বাসের বেলুন ফুস হয়ে যেত, এই বুঝি হলো গোল!

তারপরও পরতে পেরেছেন বিশ্বসেরার মুকুট। আর সেটা যে শুধু সৌভাগ্যবশত ওই দলে জায়গা পাওয়ার কারণেই, পরিষ্কার হয়ে যায় এই তথ্যে-বিশ্বকাপের পর আর কোনো টুর্নামেন্টে খেলতে পারেননি ১৯৫৩-৫৫ পর্যন্ত ইউভেন্তুসে খেলা এই গোলরক্ষক। ক্যারিয়ারের বাকি সময় খেলেন ব্রাজিলে।

ফেলিক্সের ‘কপালগুণের প্রশংসায়’ সাবেক ব্রিটিশ গোলরক্ষক বব উইলসন একবার বলেছিলেন, “নিঃসন্দেহে সে সবচেয়ে অযোগ্য বিশ্বকাপ জয়ী গোলরক্ষক। এমন এক দলে খেলার সৌভাগ্য হয়েছিল ফেলিক্সের, তার কারণে তিন গোল খাওয়ার পরও যে দলের চার গোল দেওয়ার সক্ষমতা ছিল।”

আন্দেরসন পোলগা, ব্রাজিল ২০০২

বিশ্ব জয়ের সেই বছরের জানুয়ারিতে বলিভিয়ার বিপক্ষে অভিষেক। দুই মাসের কম সময়ের মধ্যে বিশ্বকাপের প্রাক-প্রস্তুতি পর্বে আইসল্যান্ডের বিপক্ষে ৬-১ ব্যবধানে জয়ের ম্যাচে দুই গোল করে অল্প সময়ের জন্য উঠে আসেন পাদপ্রদীপের আলোয়। হারিয়ে যেতে সময় লাগেনি; তবে এর মাঝেই গলায় পরেন সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত বিশ্ব জয়ের পদক। মাত্র ১৮ মাস জাতীয় দলের ড্রেসিং রুমে ছিলেন ডিফেন্ডার পোলগা।

ব্রাজিলকে পঞ্চম বিশ্বকাপ এনে দেওয়া দলটির আরেক সদস্য হকে জুনিয়রের কাছে জায়গা হারান তিনি। জাতীয় দলের হয়ে মাত্র ১১ ম্যাচ খেলতে পেরেছিলেন ক্যারিয়ারের অধিকাংশ সময় পর্তুগালের দল স্পোর্তিংয়ে খেলা সেন্টার-ব্যাক পোলগা।

স্কোড্রান মুস্তাফি, জার্মানি ২০১৪

ইতালির তুলনামূলক কম শক্তির দল সাম্পদোরিয়ায় খেলার সময় মুস্তাফির বিশ্বকাপ দলে ডাক পাওয়াটা অনেককে অবাক করেছিল। টুর্নামেন্টেও ছিল তারই প্রতিফলন; জার্মানির শিরোপা জয়ের মিশনে সাত ম্যাচে মাত্র ১৩২ মিনিট খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন এই ডিফেন্ডার।

বিশ্বকাপ জয়ের পর তিনি যোগ দেন ভালেন্সিয়ায়। দুই বছর পর সাড়ে তিন কোটি ট্রান্সফার ফিতে নাম লেখান আর্সেনালে। লন্ডনের ক্লাবটিতে প্রথম দুই বছরে সময় খুব একটা ভালো কাটেনি তার; সেন্টার-ব্যাক হিসেবে প্রায়ই তার দুর্বলতা বেরিয়ে পড়তো। তাই ২০১৮ বিশ্বকাপ দলে তার ডাক না পাওয়াটা কাউকে অবাক করেনি।

জুনিয়র, ব্রাজিল ২০০২

১৯৯৬ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত জাতীয় দলের হয়ে মোট ১৯ ম্যাচ খেলেছেন তিনি; তবে কখনোই নিজেকে সেভাবে প্রমাণ করতে পারেননি। তারপরও ২০০২ বিশ্বকাপ স্কোয়াডে সুযোগ পান, যদিও রবের্তো কার্লোসের মত বিশ্বসেরা লেফট-ব্যাক থাকায় ওই পজিশনে সবসময় তার ব্যাকআপ হয়েই থাকতে হয়েছে তাকে।

তবে বিশ্বজয়ী দলের সদস্য হওয়ায় বিশ্বকাপ জয়ী হিসেবেই তাকে জানবে বিশ্ব।

সিমোনে বারোনে, ইতালি ২০০৬

ফুটবল দক্ষতার বিচারে বলে দেওয়া যায়, কখনোই আহামরি কিছু ছিল না তার ভাণ্ডারে। বড় কোনো ক্লাবে খেলার সুযোগ পাননি কখনও। ক্লাব ক্যারিয়ারে জিততে পারেননি কোনো শিরোপা।

তবে কপালগুণেই হোক আর যে কারণেই হোক, সুযোগ পেয়ে যান বিশ্বকাপ দলে। অনেকগুলো পজিশনের বিকল্প খেলোয়াড় হিসেবে হতে পারেন, এই ভাবনা থেকে ছিলেন দলে। তারপরও তার দলে অন্তর্ভুক্তি অবাক করেছিল অনেককে।

ইতালির বিশ্ব জয়ের পথে সাত ম্যাচের মাত্র দুটিতে খেলার সুযোগ হয়েছিল এই সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারের, দুবারই বদলি হিসেবে। সে বছরের পর আর জাতীয় দলে দেখা যায়নি তাকে।

ক্লেবেরসন, ব্রাজিল ২০০২

ইংলিশ ফুটবলে বেশ পরিচিত তিনি। ছিলেন দারুণ সম্ভাবনাময়; পেশাদার ক্যারিয়ারের শুরুতে স্বদেশের ক্লাব আতলেতিকো পারানায়েনসেতে চার বছর খেলে জিতেছিলেন একটি ব্রাজিলিয়ান সেরি আসহ তিনটি শিরোপা।

আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হন তখনকার ব্রাজিল কোচ লুইস ফেলিপে স্কলারির। বিশ্বকাপের প্রথম চার ম্যাচে যদিও বেঞ্চে বসেই কাটাতে হয় তাকে। তবে কোয়ার্টার-ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একাদশে সুযোগ পেয়ে নিজেকে মেলে ধরেন। ফাইনাল পর্যন্ত জায়গা ধরে রেখে দেশের পঞ্চম শিরোপা জয়ে রাখেন অবদান।

দেশের হয়ে আরও দুটি শিরোপা জিতেছেন তিনি, ২০০৪ কোপা আমেরিকা ও ২০০৯ ফিফা কনফেডারেশন্স কাপ। তবে ক্লাব ফুটবলে নিজেকে সেভাবে চেনাতে পারেননি।

বিশ্বকাপ জয়ের পরের বছর তাকে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে নিয়ে আসেন তখনকার ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কোচ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন। হয়তো আর্জেন্টাইন তারকা মিডফিল্ডার হুয়ান সেবাস্তিয়ান ভেরোনের শূন্যস্থান পূরণের লক্ষ্যে তাকে টেনেছিলেন কোচ; কিন্তু প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। চোটও ছিল অন্তরায়। চ্যাম্পিয়নের বেশে যোগ দিয়ে হতাশায় বিদায় নিয়েছিলেন মিডফিল্ডার ক্লেবেরসন।

আলদো দোনাত্তি, ইতালি ১৯৩৮

দেশের হয়ে কোনো ম্যাচ না খেলেই জায়গা পেয়েছিলেন বিশ্বকাপ দলে। টুর্নামেন্টেও খেলার সুযোগ হয়নি। ফুটবলের ইতিহাসে এই মিডফিল্ডার এক বিরল চরিত্র। জাতীয় দলে কখনও কোনো ম্যাচ না খেলে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন তিনি!

ক্লাওদিও বোর্গি, আর্জেন্টিনা ১৯৮৬

সম্ভাবনার কোনো কমতি ছিল না। ২২ বছর বয়সে ডাক পান বিশ্বকাপ দলে। কিংবদন্তি দিয়েগো মারাদোনার পাশে দাঁড়িয়ে করেন বিশ্ব জয়ের উৎসব।

অনেকের চোখে বোর্গি ছিলেন পরবর্তী প্রজন্মে মারাদোনার বিকল্প। কিন্তু ভাবনার সঙ্গে বাস্তবার ছিল আকাশ-পাতাল তফাত। ওই বিশ্বকাপেই শেষ, জাতীয় দলের হয়ে আর কখনও খেলতে পারেননি তিনি।

বিশ্ব জয়ীর বেশে পরের বছর যোগ দেন এসি মিলানে; কিন্তু দুর্ভাগ্য, দলটির হয়ে খেলতে পারেননি একটি ম্যাচও। তাকে ধারে পাঠানো হয় সেরি ডি-এর দল কোমোয়।

এরপর প্রতি বছরে একের পর এক দল পাল্টে গেছেন অ্যাটাকিং এই মিডফিল্ডার। শেষে ১৯৯৮-৯৯ মৌসুম চিলির ক্লাব সান্তিয়াগো ওয়ানদেরের্সে খেলে ক্যারিয়ারের ইতি টানেন বোর্গি।

হেসুস নাভাস, স্পেন ২০১০

ভিন্ন ভিন্ন পজিশনে খেলার মেধাসম্পন্ন এক ফুটবলার। মাথাটা ঠাণ্ডা রাখতে পারলে হতে পারতেন দুর্দান্ত। বাইলাইন ধরে বল নিয়ে ছুটে গিয়ে ডি-বক্সে দারুণ সব ক্রস বাড়ানোয় পারদর্শী নাভাস। কিন্তু গরম মাথাটাই বারবার তার রাশ টেনে ধরেছে। 

২০০৩-১৩ পর্যন্ত সেভিয়ায় ছয়টি শিরোপা জিতে যোগ দেন ম্যানচেস্টার সিটিতে। মূলত উইঙ্গার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করা নাভাস রাইট-ব্যাক পজিশনেও বেশ কার্যকর ছিলেন। তবে সিটিতে কোনো পজিশনেই সেভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি তিনি।

২০১৬-১৭ মৌসুমে সিটির নতুন কোচ পেপ গুয়ার্দিওলার অধীনে দলের প্রয়োজনে খেলেন রক্ষণে। কিন্তু আস্থা অর্জন করতে পারেননি, উল্টো হয়েছেন সমালোচিত। তার সম্পর্কে অনেকের মত ছিল, সে ট্যাকল করতে পারে না আর বাঁ পায়ে শুধু দাঁড়িয়ে থাকতেই পারে।

তবে ২০১৭ সালের অগাস্টে পুরনো ঠিকানায় ফিরে গিয়ে নিজেকে নতুন করে চেনাতে শুরু করেছেন নাভাস। ২০১৪ বিশ্বকাপের মূল দলে জায়গা হারানোর পর প্রায় ছয় বছর বাদে গত বছর ইউরো বাছাইয়ের দলে ফেরেন তিনি, ৩৩ বছর বয়সে।

বেহনাঁ দিওমেদি, ফ্রান্স ১৯৯৮

সে সময়ে ফ্রান্সের শীর্ষ লিগের দল অক্সেরে মূলত উইঙ্গার হিসেবে খেলা দিওমেদি ডাক পান বিশ্বকাপ দলে। জিনেদিন জিদানের জাদুকরী ফুটবলে শিরোপা জিতে নেয় ফ্রান্স। দিওমেদির আন্তর্জাতিক ফুটবলে পথচলাও শেষ ওখানেই। এরপর আর কখনোই জাতীয় দলে ফিরতে পারেননি তিনি।

২০০০ সালে ৩০ লাখ পাউন্ড ট্রান্সফার ফিতে যোগ দিয়েছিলেন লিভারপুলে। মার্সিসাইড ক্লাবটিতে কাটান তিন বছর, কিন্তু খেলার সুযোগ পাননি তেমন; মোটে খেলতে পেরেছিলেন পাঁচ ম্যাচ।

শেষে বিশ্বকাপ জয়ের আট বছরের মাথায় ৩২ বছর বয়সে ক্যারিয়ারের ইতি টানেন তিনি।

স্তিফান জিভেরক, ফ্রান্স ১৯৯৮

প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে সবচেয়ে বাজে স্ট্রাইকার কে? জবাবে অনেকের মুখে আসে নিউক্যাসল ইউনাইটেডের সাবেক স্তিফানের নাম। আন্তর্জাতিক ফুটবলে যদিও অ্যালান শিয়েরার, ওয়েইন রুনি ও অ্যাশলে কোলের থেকে বেশি সাফল্য পেয়েছেন তিনি। ছিলেন দিওমেদির সঙ্গে ফ্রান্সের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের মিশনে।

১৯৯৮ বিশ্বকাপে একটি বাদে খেলেছিলেন সবকটি ম্যাচ, কিন্তু জালের দেখা পাননি একবারও। অবশ্য ২০১৮ সালে রাশিয়া বিশ্বকাপে ফরাসিদের দ্বিতীয় বিশ্বসেরার ট্রফি জয়ের মিশনে অলিভিয়ে জিরুদও পারেননি গোল করতে।

স্তিফান এখন নিজের জন্মস্থান ব্রিতোহনিতে সুইমিং পুল বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন।