সময়ের থাবায় থমকে গেছে মোশাররফের সোনার হাসি

সোনায় মোড়ানো দিনগুলি হারিয়ে গেছে সময়ের স্রোতে। পড়ে আছে কেবল অতীতের কঙ্কাল। একসময় বক্সিং রিং দাপিয়ে বেড়িয়েছেন মোশাররফ হোসেন। মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের প্রতাপে লিখেছেন অর্জনের দারুণ সব গল্প। সময়ের থাবায় এখন তিনি নড়তে-চড়তে পারেন না ঠিকঠাক। পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার পর লাঠিতে ভর করে কোনো রকমে চলছে জীবনের চাকা। বক্সার মোশাররফ হেরে গেছেন জীবনযুদ্ধে। ৩৫ বছর এসএ গেমসের সেই সোনাঝরা দিনগুলি এখনও তাকে ভালো লাগার দোলা দেয় বটে, তবে জাগায় প্রবল হাহাকারও।

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 May 2020, 07:31 AM
Updated : 12 May 2020, 07:31 AM

করোনাভাইরাস প্রকোপের এই দুঃসময়ে দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে (এসএ গেমস) সোনা জয়ী অ্যাথলেটরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে শোনাচ্ছেন তাদের সাফল্যময় দিনগুলোর গল্প। তবে মোশাররফের জীবনে সেই উজ্জ্বল অতীত চাপা পড়েছে বিবর্ণ বর্তমানের আড়ালে। করোনাভাইরাসের ছোবল শুরুর আগেই তাকে আঘাত করেছে কঠিন বাস্তবতার থাবা।

১৯৮৫ এসএ গেমস, ১৯৮৬ এশিয়ান গেমসের সোনালী দিনের গল্প বলতে গিয়ে তার কণ্ঠে উচ্ছ্বাস ফুটে ওঠে এখনও। তবে খুব স্বস্তস্ফূর্ত হয় না তা, বাস্তবতার কষাঘাতে দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া জীবনের হাহাকারও যে থাকে সেখানে!

এসএ গেমসের দ্বিতীয় আসর বসেছিল ঢাকায় ১৯৮৫ সালে। প্রথমবারের মতো আয়োজক ছিল বাংলাদেশ। ৮১ কেজি লাইট হেভিওয়েট ওজন শ্রেণিতে সোনা জিতেছিলেন মোশাররফ। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে বক্সিং থেকে প্রথম সোনার হাসি হাসতে পেরেছিল বাংলাদেশ। সেদিনের স্মৃতি আজও স্পষ্ট মনে পড়ে ৫৯ বছর বয়সী এই বক্সারের।

“সোনা জয়ের পর আমি মনে হয় এক-দেড় ঘণ্টা মানুষের হাতের উপরে ছিলাম! আমাকে উপরে তুলে পুরো স্টেডিয়ামে ঘোরানো হয়েছিল। বক্সিং ফেডারেশনের সিনিয়র রেফারি সুলতান ভাই ওই সময় ২০০ টাকা উপহার দিয়েছিলেন। দেশের হয়ে সোনা জেতা….এটা অন্যরকম আনন্দের।”

বছর ঘুরে এলো ১৯৮৬ সাল। দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলের এশিয়ান গেমসে একই ওজন শ্রেণিতে নেপালের প্রতিযোগীকে হারিয়ে ব্রোঞ্জ জিতলেন মোশাররফ। এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে প্রথম পদক জয়ের অধ্যায় রচনা হলো বাংলাদেশের। রাজশাহী থেকে উঠে আসা এই বক্সারের স্মৃতিতে তা আজও অমলিন।

“সিউলে নেপালের বক্সারকে ৩৮ সেকেন্ডে নকআউট করে ব্রোঞ্জ পেয়েছিলাম। এরপর বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড়রা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল,  ‘তুমি তো দেশকে প্রথম পদক এনে দিলে, তোমার দেশ নিশ্চয় তোমার জন্য অনেক কিছু করবে, অনেক উপহার দিবে, তাই না? গর্ব করে আমিও বলেছিলাম, ‘হ্যাঁ, অনেক কিছু পাব।”

সিউল থেকে ফেরার পর বাবা হলেন মোশাররফ। ছেলের নামের সঙ্গে জীবনের সেরা স্মৃতিটুকু জড়িয়ে দিলেন। নাম রাখলেন, মাহবুব হোসেন সিউল। কিন্তু সে আনন্দ টিকল না বেশি দিন। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ছেলেটা আস্তে আস্তে হাঁটার শক্তি হারিয়ে ফেলল। এখন তার সঙ্গী হুইল চেয়ার।

ছেলের দুঃসময়ে পাশে থাকতে পারেননি মোশাররফ। বাড়িতে ছিলেন না। ছুটে বেড়াচ্ছিলেন বক্সিংয়ের রিংয়ে। অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে মোশাররফের স্ত্রী হুনুফা হোসেন দৌড়াদৌড়ি করেছিলেন, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ঘরে ফিরে স্বপ্নের অপমৃত্যু দেখলেন মোশাররফ।

জীবন তবু থেমে ছিল না। ২০০৪ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চাকরি শেষে  বক্সিংয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রেফারি হিসেবে। ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে চলছিল মোটামুটি। দুই মেয়ের মধ্যে বড় মাহমুদা হোসেন তিন বছর আগে এমবিবিএস পাশ করে সরকারি চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করছেন। ছোট মেয়ে মাহফুজা হোসেন পড়ছেন অনার্সে।

জীবন সংগ্রামে এই বক্সারের এগিয়ে চলা আচমকাই থমকে গেল ২০১৮ সালের মার্চ মাসে। যুব গেমসে রেফারির দায়িত্ব পালন করতে ঢাকায় আসার পর ভোর রাতে আক্রান্ত হলেন হৃদরোগে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলো। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) এক সপ্তাহ চিকিৎসা নিয়ে প্রাণে বাঁচলেন। কিন্তু চলার শক্তি হারিয়ে ফেললেন চিরতরে।

এরপর মুদ্রার উল্টো পিঠ আরও ভালোভাবে দেখা হয়ে যায় মোশাররফের। এতদিনের পরিচিত বক্সিং ফেডারেশন, অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (বিওএ), জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি), সবই অচেনা হয়ে গেলো মুহূর্তেই। মুখ ফিরিয়ে নিল অনেকে। দেশকে সাফল্য এনে দেওয়ার পর পাওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো পড়ে গেল বকেয়ার খাতায়।

এসএ গেমসের সাফল্যের পর মানুষের কাঁধে চড়ে স্টেডিয়াম চক্কর দেওয়া, সিউল থেকে ফেরার পর ফুলের বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া সেই দিনগুলোর সঙ্গে বর্তমানকে একটুও মেলাতে পারেন না মোশাররফ। লাভ-ক্ষতির হিসাব কষতে গিয়ে তাই ভারী হয়ে ওঠে তার কণ্ঠ।

“এমন একটা দুঃসময় চলছে। কিন্তু কেউ তো খোঁজ নিল না আমি খেয়ে আছি নাকি না খেয়ে আছি। দেশকে পদক এনে দেওয়ার পর কতজন কত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু কই, কিছুই তো পেলাম না! এত লেখালেখি হলো, তারপরও কিছু হলো না। এগুলো বলে আসলে কি লাভ আছে?”