‘পার্টি’ নয়, মুজিবরের সোনা জয়ের উদযাপনে ছিল হৈ-হুল্লোড়

‘সে সময় তো অত পার্টির রেওয়াজ ছিল না’, একটু যেন দীর্ঘশ্বাস মেশানো হাসি নিয়ে বলেন মুজিবর রহমান মল্লিক। এরপর যখন স্মৃতিময় দিনগুলোর পাতা উল্টাতে শুরু করেন, একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে আবেগে মোড়ানো অর্জনের গল্প। দক্ষিণ এশিয়ান গেমসের (এসএ গেমস) ইতিহাসে বাংলাদেশের সোনা জয়ের দুটি ‘প্রথম’-এর গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই অ্যাথলেট আপ্লুত হয়ে পড়েন স্মৃতির অলিন্দে ঢু মেরে।

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 May 2020, 06:31 AM
Updated : 10 May 2020, 06:31 AM

করোনাভাইরাস প্রকোপের ঘরবন্দি সময়ে দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে (এসএ গেমস) সোনা জয়ী অ্যাথলেটরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে শোনাচ্ছেন তাদের গৌরবের দিনগুলোর গল্প। মুজিবর ফিরে তাকালেন এসএ গেমসের প্রথম আসরে, ৩৬ বছর আগে নেপালে সোনায় রাঙানো দিনগুলিতে। শোনালেন প্রাপ্তির পূর্ণতায় ভেসে যাওয়ার আবেগময় গাঁথা।

১৯৮৪ সালে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক শ্রেষ্ঠত্বের প্রথম আসর বসেছিল নেপালের কাঠমান্ডুতে। সেবার ‍দুটি সোনা জিতেছিল বাংলাদেশ, দুটিই অ্যাথলেটিক্স থেকে। দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামের ট্র্যাকে সাইদুর রহমান ডন, শাহ আলম, আফতাব মোল্লার সঙ্গে ১০০ মিটার রিলেতে বাজিমাত করেন মজিবুর। এসএ গেমসের ইতিহাসে বাংলাদেশের প্রথম সোনার পদক জয়ের গল্পে চিরদিনের জন্য খোদাই হয়ে যায় তার নাম।

এরপর ট্রিপল জাম্পে ১৪ দশমিক ৫৮ মিটার অতিক্রম করে সেরা হন মজিবুর। ষষ্ঠ লাফে পরেছিলেন শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট। ব্যক্তিগত ইভেন্টে প্রথম সোনা অর্জনের কীর্তিও গড়া হয়ে যায়।

এখন সাফল্য পেলে ঘটা করে উৎসব, পার্টি কত কী হয়! কিন্তু সেসময় এসবের কিছুই হয়নি। তবে স্মৃতির ভেলায় চেপে তিন যুগ পেছনে ফিরে গেলে এখনও একই আবেগ অনুভব করেন ৫৯ বছর বয়সী মুজিবর।

“নেপালে যাওয়ার পর বেশ ভালোই ছিলাম আমরা। কিন্তু যখন সোনার পদক পাচ্ছিলাম না, রুপা-ব্রোঞ্জ আসছিল, তখন আর কারও ভালো লাগছিল না। এরপর অ্যাথলেটিক্স থেকে আমরা দুইটা সোনা জিতলাম। বিজয়স্তম্ভে ওঠার পর দেশের পতাকা উড়ল, জাতীয় সঙ্গীত বাজল….সে এক অসাধারণ ব্যাপার। গর্বে বুকটা এখনও ফুলে ওঠে।”

“দলীয় ও ব্যক্তিগত মিলিয়ে দুটি সোনা জিতলাম। দুটি ‘প্রথম’ সোনার পদক নিজের নাম লেখা হলো, দুটো অর্জন নিয়ে অন্যরকম ভালো লাগা ছিল। কিন্তু এখনকার মতো তো আমাদের সময় এত পার্টির রেওয়াজ ছিল না (হাসি)। রুমে ফিরে নিজেদের মতো করে হৈ-হুল্লোড় করে সবাই উদযাপন করেছিলাম আরকি।”

সোনা জয়ের পরের একটি ঘটনা তাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল প্রবলভাবে।

“সেবার একটা ঘটনা আমাকে খুব নাড়া দিয়েছিল। আমি সোনা জয়ের পর ব্রজেন দাস (ইংলিশ চ্যানেল পার করা সাঁতারু) আমাকে জড়িয়ে ধরে এমনভাবে কান্না শুরু করল যে, আমিও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম। সে হাউমাউ করে কাঁদছিল। ওই ঘটনা আমাকে সাংঘাতিকভাবে নাড়া দিয়েছিল। দৃশ্যটি আমি যেন আজও দেখতে পাই।”

অ্যাথলেটিক্স ক্যারিয়ারের মতোই উজ্জ্বল মুজিবরের চাকরি জীবন। সব পথেই সফল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া এই অ্যাথলেট। খেলোয়াড় কোটায় চাকরি শুরু করেছিলেন বিজেএমসিতে (বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন)। গত জানুয়ারিতে এই প্রতিষ্ঠানের মহা-ব্যবস্থাপকের পদে থেকে অবসরে গেছেন যশোর থেকে উঠে আসা এই অ্যাথলেট।

নিজের মুঠোভরে পাওয়ার তৃপ্তি থাকলেও অ্যাথলেটিক্সের বর্তমান দুর্দশায় কষ্ট লাগে মুজিবরের। এসএ গেমসের ১৩ আসর মিলিয়ে এই ডিসিপ্লিন থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তি ৮টি সোনা। কিন্তু ২০০৬ সালে ১১০ মিটার হার্ডলসে মাহফুজুর রহমান মিঠু সেরা হওয়ার পর থেকে চলছে খরা। গত তিন আসরে এই বিভাগ থেকে মেলেনি সোনার হাসি। তিন যুগ আগের পরের হিসাব কষে তাই তল খুঁজে পান না মুজিবর।

“নিজের জীবন নিয়ে একবিন্দু আক্ষেপও নেই আমার। ট্র্যাকে সাফল্য পেয়েছি। চাকরি জীবনেও সাফল্য পেয়েছি। কিন্তু অ্যাথলেটিক্সের বর্তমান অবস্থা দেখলে খুবই খারাপ লাগে।”

“৩৫-৩৬ বছর আগে আমরা যেটা করেছি, যখন আধুনিক সুযোগ-সুবিধার কিছুই আমাদের জন্য ছিল না, এত দিন পরও যদি আগের মানটুকু না দেখা যায়, খারাপ তো লাগবেই।”