‘পলিথিন থেরাপি’ নিয়ে সোনা জিতেছিলেন রহিম

সে এক দুঃসহ রাত! ডোপ টেস্ট দিতে গিয়ে বিপত্তির শেষ নেই। বোতলের পর বোতল পানি পান করেও লাভ হচ্ছিল না। উল্টো ওজন বেড়ে গেলো ৮ কেজি! অথচ সকালে নামতে হবে সোনার পদকের লড়াইয়ে। চোখেমুখে ঘোর অন্ধকার দেখছিলেন আব্দুর রহিম। স্বপ্ন ভাঙার ভয়ে চোখে পানিও এসে যায়। এরপর নিলেন পলিথিন থেরাপি! শঙ্কার মেঘ উড়িয়ে সকালটাও রাঙালেন সোনা জয়ের সাফল্যের আভায়।

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 May 2020, 11:02 AM
Updated : 7 May 2020, 11:02 AM

করোনাভাইরাস প্রকোপের এই বিষন্ন সময়ে দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে (এসএ গেমস) সোনা জয়ী অ্যাথলেটরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে শোনাচ্ছেন তাদের সাফল্যের গল্প। মিজানুর ফিরে তাকালেন দশ বছর আগের সেই উৎকণ্ঠাময় রাত  সোনালী সকালের পানে। শোনালেন ‘পলিথিন থেরাপির’  অজানা গল্প।

দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চ ক্রীড়া আসর এসএ গেমসের বক্সিংয়ে বাংলাদেশ প্রথম সোনার পদক পায় ১৯৮৫ সালে মোশাররফ হোসেনের হাত ধরে। ৮ বছর পর দ্বিতীয় সাফল্য মেলে মোজাম্মেল হকের কল্যাণে। কিন্তু পরের চার আসরে বক্সিংয়ের খাতায় পড়েনি সোনালি আঁচড়। অবশেষে দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান ২০১০ সালে। ধরা দেয় দুটি সোনা।  একটি জিতেছিলেন জুয়েল আহমেদ জনি; অন্যটি রহিম।

স্মৃতির ডানায় ভর করে এক দশক আগের সেই রাতে ফিরে যান রহিম। লাইট ওয়েল্টার ওয়েট ৬৪ কেজি ওজন শ্রেণির ফাইনালে হারিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার প্রতিপক্ষ সিসিরা কুমারাসিংহেকে। কিন্তু আগের রাতটি তার জন্য ছিল দুর্বিষহ। বলতে গিয়ে এখনও ৩০ বছর বয়সী এই বক্সারের কণ্ঠ এখনও স্পষ্ট ফুটে ওঠে সেই সময়ের উৎকণ্ঠা।  

“ ফাইনালের আগের দিন ডোপিং টেস্টে নিয়ে গেল আমাকে। সন্ধ্যার পর শুরু হয়েছিল ডোপ টেস্ট। কিন্তু আমার ইউরিনের চাপ আসে না। ছোট পানির বোতল (২৫০ মিলি) ১২টা শেষ করে ফেলেছি। এক বোতল জুসও খেয়েছি, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এদিকে রাত বেজে গেছে প্রায় ১২টা। ঘুমানো দরকার। সকালে ফাইনাল। আমার তো ভয় লাগা শুরু হয়ে গেল। অনেক লাফালাফি, হাটাহাটির পর অবশেষে একটু চাপ এলো। পরীক্ষা দিয়ে চলে এলাম রুমে।”

“কিন্তু তখনও শেষ হয়নি ঝামেলা। রুমে ফিরে ওজন নিয়ে দেখি ৮ কেজি বেড়ে গেছে! খাওয়া-দাওয়া করলে ওজন বাড়ে কিন্তু এত বেশি বেড়ে যাওয়ায় ভয় পেয়ে গেলাম। এবার তো ভয়ে চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু হয়ে গেলো। আমার কান্না দেখে কোচ এসে বললেন, ‘দুঃশ্চিন্তা বাদ দাও। দেখি কী করা যায়। তুমি একটু মিনিট দশেক ঘুমিয়ে নাও।”

এরপরের ঘটনা বলতে গিয়ে হাসেন রহিম। সেই রাতের শঙ্কার মেঘ সরে যাওয়াটা যেন এত বছর পরে এসেও ঠিকই অনূভব করতে পারেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই বক্সার। সেসময়কার কোচ থাইল্যান্ডের থান তুয়ানের প্রতিও কৃতজ্ঞতা ঝরে তার কণ্ঠে।

“পরের ঘটনা দারুণ মজার। ঘুম কী আর আসে! তবু কোচের কথা অনুযায়ী ঘুমাতে গেলাম। এই ফাঁকে কোচ সবার রুমে রুমে গিয়ে খাবার-ফল রাখার যেসব পলিথিনের ব্যাগ থাকে, সেগুলো জোগাড় করে এনে জোড়া দিয়ে জামা বানিয়েছে (হাসি)! আমাকে ঘুম থেকে তুলে বললেন, ‘এগুলো পরে নাও। রমনা পার্কে দৌড়াতে যেতে হবে। তখন রাত বাজে প্রায় দেড়টা!”

“গেঞ্জির ওপর পলিথিনের সেই জামা পরে বের হয়ে গেলাম। তার আগে অবশ্য কোচের কথা অনুযায়ী একবার গলায় হাত দিয়ে বমি করলাম। ওজন করে দেখলাম দুই কেজি কমেছে। বাকি ছয় কেজি কমাতে ছুটলাম রমনা পার্কে। দুই চক্কর দেওয়ার পর কোচ বললেন, ‘এবার থামো, যা কমার কমে গেছে।’ কোচের কথা আমার বিশ্বাস হতে চায় না। কিন্তু রুমে ফিরে ওজন করে দেখি সাড়ে সাত কেজি কমে গেছে!”

বাকি আধ কেজি ওজন কমাতে একটুও বেগ পোহাতে হয়নি রহিমের। স্বস্তির ঘুম ঘুমিয়ে সকালে উঠে পরিমাপ করে দেখেন সবকিছু আছে ঠিকঠাক। চেনা আঙিনা পল্টনের মোহাম্মদ আলী বক্সিং স্টেডিয়ামের রিংয়ে কুপোকাত করে দিলেন শ্রীলঙ্কার কুমারাসিংহেকে। এতদিন পর সেই স্মৃতি আওড়াতে গিয়ে একটু আক্ষেপও ঝরল রহিমের কণ্ঠে।

“থান তুয়ান না থাকলে হয়ত ফাইনাল খেলতেই পারতাম না। ওজন কমানোর পলিথিন থেরাপিই তো আমি জানতাম না। আসলে ওরা কত কিছু, কত কৌশল জানে! আমরা আজও তার অনেক কিছুই জানি না।”