বাংলাদেশ কোচের নাটকীয় ফুটবল জীবন

একটি ফোন কলে বদলে গেল জেমি ডের পথচলা। বাড়ি থেকে পাঁচ হাজার কিলোমিটার দূরের দেশ বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচ হয়ে গেলেন ৪০ বছর বয়সী এই ইংলিশ। গোলডটকম-এর সঙ্গে আলাপচারিতায় নিজের খেলোয়াড়ি জীবন, প্রিয় দল আর্সেনালকে ছেড়ে দেওয়ার কঠিন সিদ্ধান্ত, বাংলাদেশের কোচ হওয়া, ঢাকার রাস্তাঘাটে মুখোমুখি হওয়া নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলেছেন ডে।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 May 2020, 03:24 PM
Updated : 1 May 2020, 03:25 PM

ইংল্যান্ডে যখন নিজের এলাকা সিডকাপের রাস্তায় হাঁটতেন জেমি, তাকে আলাদা করে খেয়াল করতেন না কেউই। কিন্তু পাঁচ হাজার কিলোমিটার দূরে ঢাকা শহরের ব্যস্ত রাস্তায় জেমির গল্পটা অন্যরকম। শুধু জায়গাই বদলায়নি, বদলে গেছে তার জগৎ!

“ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। ইংল্যান্ডে অবশ্যই আমি কে বা আমার স্টাফরা কারা, এসব নিয়ে কারও কোনো ধারণাই ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশে লোকজন আমাদেরকে দেখলেই কাছে আসে ও ছবি তোলে।”

“আমি এটা উপভোগ করি। আমরা সবাই এটা উপভোগ করি। কিন্তু রাস্তায় সবসময় ছবি তোলার জন্য থামতে হওয়াটা শুরুর দিকে একটু অদ্ভূতুড়ে ছিল।”

বাংলাদেশের কোচ হওয়ার আগে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছেন ডে। শুরুটা বলা যায় সেই ১৯৯০ সালে, আর্সেনালে দারুণ প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ হিসেবে। কোচ আর্সেন ভেঙ্গার তাকে পেশাদার চুক্তিতে নিয়ে আসেন। ডেনিস বার্গকাম্প, মার্ক ওভারমার্স, পাত্রিক ভিয়েইরার মতো খেলোয়াড়দের সঙ্গে অনুশীলন করেছেন ডে, সুযোগ পেয়েছেন ইংল্যান্ডের সেরা কিছু কোচদের সঙ্গে কাজ করার।

কিন্তু মূল দলে খেলার পথ খুঁজে হয়রান ডের মোহমুক্তি ঘটে একসময়। পথ হারাতে শুরু করেন। ডে নিজেই জানালেন, তিনি একরকম থমকে গিয়েছিলেন, স্রেফ চালাতে হয় বলে চালিয়ে যাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত ২০০১ সালে যোগ দেন বোর্নমাউথে।

তারপরও ভাগ্য বদল হয়নি তার। বাধ্য হয়ে এক পর্যায়ে নন-লিগ পর্যায়ে খেলা শুরু করেন। অনূর্ধ্ব-১৮ পর্যায়ে ইংল্যান্ডকে প্রতিনিধিত্ব করা ফুটবলার বয়স ২৪ ছুঁতে ছুঁতেই কোচিং ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিলেন।

২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ওয়েলিং ইউনাইটেডে খেলোয়াড় ও ম্যানেজার হিসেবে কাটান ডে। এরপর এবসফ্লিট ও ব্রেইনট্রিতে কিছু সময় কাটিয়ে ২০১৭ সালে দায়িত্ব নেন জিলিংহামের প্রধান কোচ হিসেবে।

পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে সহকারী কোচ হিসেবে যোগ দেন ব্যারোতে। মাস দুয়েকের মধ্যে একটি ফোন কলে বদলে যার তার ক্যারিয়ারের গতিপথ।

“ফোন কলটা পেয়েছিলাম আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে, যে একজন এজেন্ট। সে আমাকে বলল বাংলাদেশ দলে চাকরির সুযোগ আছে।”

“আমি আমার সিভি দিলাম। এরপর লন্ডনে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম এবং তখনই অনেকটা চূড়ান্ত হয়ে গেল।”

“এমনকি আমি জানতামও না, বিশ্বের কোথায় বাংলাদেশের অবস্থান। দেশটা কেমন বা তাদের ফুটবল সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। কিন্তু দেখলাম, আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করার সুযোগ এটি। জাতীয় দল নিয়ে কাজের সুযোগ তো সহজে মেলে না…।”

২০১৮ সালের জুনে যখন বাংলাদেশের দায়িত্ব নেন ডে, তখন বেশ বাজে অবস্থায় ছিল দল। তিন বছর ধরে তারা জয়ের মুখ দেখেনি। ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে অবস্থান ছিল ১৯৭, নিজেদের ইতিহাসে সর্বনিম্ন।

এই দুই বছরের মধ্যে ১০ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। ডে ও তার সহকারী স্টুয়ার্ট ওয়াটকিসের কোচিংয়ে গত ১৯ ম্যাচের মধ্যে ৯টিতে জিতেছে বাংলাদেশ।

তরুণ একটা দলকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন ডে। তার বিশ্বাস উন্নতির সম্ভাবনার নাটাই তরুণদের হাতেই থাকে।

বাংলাদেশেও তার এগিয়ে চলা সহজ ছিল না। অনেক প্রতিকূলতা পেরোতে হয়েছে। ভিন্ন এক পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়েছে। ডে শোনালেন সেই গল্প।

“এটা চোখ খুলে দেওয়ার মত ব্যাপার। ইংল্যান্ডের চেয়ে এটা পুরো ভিন্ন এক জগৎ এটি, তবে মানিয়ে তো নিতেই হয়।”

“কখনও কখনও আমরা বল, বিবসের মতো সরঞ্জামও পর্যাপ্ত পাইনা। মনে পড়ে, একবার আমরা বিশ্বকাপ বাছাইয়ের একটা ম্যাচ খেলে বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে বাসে উঠলাম, হঠাৎই পুলিশ এসে ঘিরে ধরল।”

“আমি ভাবলাম, তারা বোধহয় আমাদের শহরে নিয়ে যাবে। কিন্তু তারা আমাদের দাঁড় করিয়ে রাখল। পরে বোঝা গেল, আমাদের বাসের ড্রাইভার আসলে এমনিই এক লোক, তার লাইসেন্সও ছিল না। এরপর বাস থেকে নেমে ক্যাব ধরতে বাধ্য হলাম সবাই।”

ওই ঘটনায় বেশ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন ডে। তবে সময়ের সঙ্গে বাংলাদেশের বাস্তবতা বুঝে উঠেছেন আরও বেশি করে। ফুটবলারদের উৎসাহ দেখেও তিনি অনুপ্রেরণা পান কাজ করার।

“ওই সময় আমি খুব রেগে গিয়েছিলাম, কিন্তু গত দুই বছরে অনেকটাই মানিয়ে নিয়েছি। অনেক কিছুই এখন ঠিকঠাকভাবে পাচ্ছি এবং যেটা নিশ্চিত করেছে, পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু আমাদের আরও উন্নতি করতে হবে।”

“ছেলেরা আসলেই ভালো করছে। তারা কথা শোনে, শিখতে চায়। ওদের কাছে তো আসলে আমি এগুলোই চাইতে পারি। এখন তাদের আসলেই ভালো কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে এবং গত দুই বছরে আমরা বড় কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। সেটা আমরা চালিয়ে যেতে চাই এবং সামনের দিকে আরও এগিয়ে যেতে চাই।”

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে সারাবিশ্বে ফুটবল থমকে আছে। বাংলাদেশ থেকে ফিরে গেছেন ডে। কেন্টে স্ত্রী ও চার সন্তানের সঙ্গে আছেন বাংলাদেশ কোচ।

গত দুই বছরের অধিকাংশ সময় দেশের বাইরে থাকায় করোনাভাইরাসের প্রেক্ষাপটে পাওয়া এই ‘ছুটি’ তার জন্য অন্যরকম স্বস্তি হয়ে এসেছে। পরিবারকে আরও বেশি সময় দিতে পারছেন। তবে তিনি মুখিয়ে আছেন দ্রুত বাংলাদেশে ফিরতে।

শৈশবে ফুটবল নিয়ে স্বপ্ন দেখার শুরুর দিনগুলির সঙ্গে ডের এখনকার ভূমিকার ব্যবধান যোজন যোজন। ১০ বছর বয়সে আর্সেনালে যোগ দিয়েছিলেন ট্রেইনি হিসেবে, তাদের সেন্টার অব এক্সিলেন্সেও ছিলেন। যুব দলে অ্যাশলি কোল, জুলিয়ান গ্রে, ওমের রিজার মতো ফুটবলারদের সঙ্গে বেড়ে উঠেছেন তিনি। ১৯৯৮ সালে জিতেছেন প্রিমিয়ার একাডেমি লিগ, জিতেছেন ফ্লাডলিট কাপও।

ওই সময়টাতে আর্সেন ভেঙ্গারের মূল দলের অনুশীলনে নিয়মিত ছিলেন ডে। ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাইবুরিতে ক্রিস্টাল প্যালেসের বিপক্ষে ম্যাচে বেঞ্চে জায়গা পেয়েছিলেন। আর্সেনাল ক্যারিয়ার নিয়ে তৃপ্তি-হতাশা দুটোই জানালেন ডে।

ওই বছরই আর্সেনাল প্রিমিয়ার লিগ এবং এফএ কাপ জিতেছিল। সেটাই ছিল ফরাসি এই কোচের আর্সেনালের দায়িত্বে প্রথম পুরো মৌসুম।

সেই দিনগুলি কাছ থেকেই দেখেছেন ডে। ক্লাবের বদলে যাওয়ায় তাদের ভালো লাগার ব্যাপার যেমন ছিল, তেমনি ক্লাবের উৎকর্ষের তাড়নায় তাদের কপালও পুড়েছিল।

“আর্সেন এসে ক্লাবকে পাল্টে দিল, ক্লাবের দর্শন বদলে দিল। অবশ্যই আরও ভালো জায়গা করে তুলল। নতুন ধ্যান-ধারণার সঙ্গে পরিচয় হওয়া, বিদেশি কোচ কীভাবে কাজগুলো করেন, সেগুলো দেখা আমাদের জন্য ছিল দারুণ ব্যাপার।”

“কিন্তু এটার উল্টো দিকও ছিল, শীর্ষ পর্যায়ের খেলোয়াড়দের সে আনতে শুরু করল এবং আমাদের মতো তরুণরা মূল দলে খেলার সুযোগ আর কখনই পেলাম না।”

মূল দলে খেলতে না পারলেও আর্সেনালে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সেটিকেই বড় প্রাপ্তি মানছেন ডে।

“ওই খেলোয়াড়দের সঙ্গে অনুশীলন ও প্রতিদিন তাদের দেখতে পাওয়াটা দারুণ অভিজ্ঞতা ছিল। ডেনিস বার্গকাম্পের মতো খেলোয়াড়ের সঙ্গে অনুশীলন করার সুযোগও তো খুব বেশি লোকে পায় না!”

“ডেনিস অন্যদের চেয়ে অনেকটা ব্যবধানে এগিয়ে ছিল। মনে পড়ে, মার্ক ওভারমার্সও ভালো ছিল, কিন্তু অনুশীলনে ডেনিস যেটা করতে পারত, তার কল্পনাশক্তি এবং সজাগ থাকা, এসব ছিল এক ধাপ এগিয়ে।”

১৯৯৮ সালে আর্সেনাল ডাবল জয়ের বছরখানেকের মধ্যে বোর্নমাউথে পাড়ি জমান ডে। দলটি তখন খেলত দ্বিতীয় বিভাগে।

দুই বছর পর ডের ঠিকানা হলো ডোভার অ্যাথলেটিক এবং শুরু হলো তার ‘নন-লিগ’ ক্যারিয়ার। এখানে অবশ্য দারুণ ছিল তার ক্যারিয়ার।

পেছন ফিরে তাকালে, আর্সেনাল অধ্যায়ের জন্য খানিকটা আক্ষেপই হয় তার।

“পেছনে তাকালে মনে হয়, আমার সম্ভবত উচিত ছিল নিজেকে সত্যিকার অর্থেই ফিট রাখা, ওই পরিবেশে থাকতে এবং ওই ফুটবলারদের সঙ্গে অনুশীলন করতে নিজের সঙ্গে আরও বেশি লড়াই করা।”

“এরপর হয়তো আমি এমন কোনো ক্লাবে যেতে পারতাম, যারা চ্যাম্পিয়নশিপ বা প্রিমিয়ার লিগের অন্য দল, যেখানে খেললে হয়তো আমার মূল দলে সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকত।”

শীর্ষ পর্যায়ের ফুটবলে থিতু হতে না পারায় নিজের দায়ও মেনে নিয়েছেন ডে। জানালেন, পেছনে ফিরে যেতে পারলে কিছু সিদ্ধান্ত বদলে নেওয়ার কথাও।

“সত্যি বলতে, আমি একটু অলসও ছিলাম। ফিটনেস আরও বাড়ানো বা বাড়তি কিছু করে নিজেকে সুযোগ দেওয়ার পথে না হেঁটে আমি অন্য পথ বেছে নিয়েছিলাম। ফুটবলার হিসেবে আমার শরীরটা ভারি ছিল, যেটা উচিত ছিল না।”

“বিকেলে বাড়তি একটু অনুশীলনের জন্য আমি থেকে যেতাম না। কারণ আমি ধরেই নিয়েছিলাম, আর্সেনালে আমার খেলা হবে না। সপ্তাহে একটি রিজার্ভ গেম খেলছিলাম এবং একরকম থমকে ছিলাম।”

“আমার সামনে প্রথম যে ক্লাবে যাওয়ার সুযোগ এসেছিল, সেখানেই চলে গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু আমার উচিত ছিল, একটু সময় নিয়ে নিজের খেলার ধরণ এবং নিজের পর্যায়ের সঙ্গে মানানসই ক্লাব বেছে নেওয়া। হয়তো, সেটিই আমার একমাত্র আক্ষেপ।”