লিভারপুল এবং ৩ দশকের অপেক্ষা

প্রতিযোগিতার নাম বদলে ‘প্রিমিয়ার লিগ’ রাখার পর যেন বদলে গেল লিভারপুল। দারুণ সফল দলটি দেখল মুদ্রার উল্টো পিঠ। এক দশকে ছয়বার, দেড় যুগে ১১ বার শীর্ষ লিগের শিরোপা জেতা দলটি যেন হয়ে উঠেছিল চ্যাম্পিয়নের প্রতিশব্দ। ট্রফি কেসে ১৮ শিরোপা সাজিয়ে ইংলিশ লিগের সেই সময়ের দলটির হতাশাময় পথ চলার শুরু ১৯৯০-৯১ মৌসুম দিয়ে। এরপর একে একে পার হয়ে গেছে তিন দশক, কিন্তু পরবর্তী লিগ শিরোপার দেখা মেলেনি আজও।

আব্দুল মোমিনআব্দুল মোমিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 April 2020, 08:52 AM
Updated : 28 April 2020, 10:23 AM

আশা জেগেছে এবার। তবে আপাতত অনাকাঙ্ক্ষিত কারণে আলোর রেখা ঢেকে গেছে কালো মেঘে। বিল শ্যাঙ্কলি বলেছিলেন, “কিছু মানুষ বিশ্বাস করে, ফুটবল জীবন-মরণের ব্যাপার। তাদের অমন আচরণে আমি খুব হতাশ। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, ফুটবল তার চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”

করোনাভাইরাস যেন ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে লিভারপুল কিংবদন্তিকে। নতুন এই ভাইরাসের জন্য থমকে গেছে লিভারপুলের ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ জয়ের আশা। তিন দশকের অপেক্ষার অবসান হতে গিয়েও হচ্ছে না।

দিক হারিয়ে ভুল পথে সাফল্যের রথ

৩০ বছর! এতদিনে সবশেষ শিরোপা জয়ের স্মৃতিতে হয়তো মরিচা ধরে গেছে। কেউ কেউ দিনটি মনে করতে পারেন। তাদের একজন গ্যারি গিলেস্পি। সম্প্রতি সিএনএন’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে লিভারপুলের সাবেক এই ডিফেন্ডার ফিরে গেলেন সেই দিনে।

“আমরা একসঙ্গে বোধহয় পান করেছিলাম আর সবাই মিলে সদ্য শেষ হওয়া মৌসুমের স্মৃতিচারণ করছিলাম।”

ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে সেই সাফল্য, উদযাপন তাদের কাছে আলাদা কিছু ছিল না। কারণ? সেই সময়টায় লিভারপুলের শিরোপা জয়ই যেন ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। পাঁচ মৌসুমে সেটি ছিল গিলেস্পির তৃতীয় লিগ শিরোপা। সোনায় মোড়া দশকে লিভারপুলের ষষ্ঠ, সব মিলিয়ে ১৮তম।

সেই সময়ের বাস্তবতায়, লিভারপুলের পরের শিরোপা যেন ছিল নাগালেই; হয় ধরে রাখবে, নয়তো এক মৌসুম পর ফিরে পাবে। কিন্তু কে জানতো, ১৯৮৯-৯০ মৌসুমই শেষ! লিভারপুল ভক্তদের তো কথাই নেই, ঘোর শত্রুর কাছেও হয়তো অবিশ্বাস্য ঠেকত, যদি বলা হত এই শেষ। লিগ শিরোপাশূন্য কাটবে পরের তিন দশক!

“দলের সবাই জিততে অভ্যস্ত ছিল। হয়তো সেজন্য জয়ের ব্যাপারটি সবাই নিশ্চিত বলে ধরে নিয়েছিল। আর জীবনে কখনও কোনো বিষয় নিশ্চিত ধরে নিলে কোনো এক সময় তা ঘুরে দৃঢ়ভাবে আঘাত করবে।”

লিভারপুলের সঙ্গে ঠিক এমনই হয়েছে বলে মনে করেন গিলেস্পি। লিগ শিরোপার আশায় একে একে পেরিয়ে গেছে ৩০টি বছর। খেলোয়াড় বদলেছে, নতুন কোচ এসেছে, কিন্তু প্রিমিয়ার লিগে সাফল্য অধরাই রয়ে গেছে।

হতাশার কালো মেঘ ফুড়ে এই বছর উঁকি দিয়েছিল সূর্য। কিন্তু স্বপ্ন পূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনাভাইরাসে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ম্যানচেস্টার সিটির চেয়ে ২৫ পয়েন্টে এগিয়ে গিয়ে শিরোপার সুবাস পাচ্ছিল ‘অল রেড’ নামে পরিচিত দলটি। আর মাত্র দুটি ম্যাচ জিতলেই নিশ্চিত হয়ে যেত শিরোপা, কিন্তু এমন সময়ে দৃশ্যপটে হাজির প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। থমকে গেছে বিশ্ব, স্থবির হয়ে গেছে ফুটবল। ভেস্তে যেতে বসেছে লিভারপুলের অধরাকে ছোঁয়ার স্বপ্ন।

ডুবতে বসা শহরের প্রাণ

ব্রিটেন, ১৯৮০। ‘লৌহমানবী’ মার্গারেট থ্যাচারের দশক। শহর লিভারপুল তখন লড়ছিল অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে। বন্দর শহরটির সমৃদ্ধির মূলে ছিল যে ডক, সেগুলো ১৯৭০ দশক থেকে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল। উৎপাদন হয়ে পড়েছিল সীমিত, অর্থনৈতিক কাঠামো সঙ্কুচিত, মারাত্মকভাবে বেড়ে গিয়েছিল বেকারত্ব। এর চেয়েও বড় দুশ্চিন্তার কারণ ছিল মাদক। নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল তরুণ প্রজন্ম।

“লিভারপুল ধ্বংসের দুয়ারে পৌঁছে গিয়েছিল”, সেই সময়ের বর্ণনায় বলেন লিভারপুল ফুটবল ক্লাবের আজীবন সমর্থক ও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক গর্ডন জেনকিন্স।

২০ পাউন্ডের নোট বাড়িয়ে চেলসি সমর্থকরা বলত, “আমাদের অনেক অর্থ আছে।” সে সব আজো মনে পড়ে তার।

১৯৮১ সাল। জুলাইয়ের রৌদ্রজ্জ্বল এক দিনে চার্লস ও ডায়ানার বিয়ে উপলক্ষ্যে লন্ডনের রাস্তায় যখন শুভাকাঙ্ক্ষীরা পতাকা নাড়ছিল, ২০০ মাইল দূরে লিভারপুল তখন জ্বলছিল। অর্থনৈতিক মন্দা, পুলিশের সঙ্গে আফ্রিকান-ক্যারিবিয়ান গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব, সবকিছু মিলে পরিস্থিতি হয়ে উঠেছিল নারকীয়। মানুষের ক্ষোভ বাড়ছিল প্রতিনিয়ত। শাসন ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল। নয় দিনে আহত ও গ্রেপ্তার হয়েছিল শত-শত মানুষ, প্রাণ হারিয়েছিল একজন।

পরবর্তীতে লিভারপুল শহরকে পুনরুজ্জীবিত করতে বেশ কিছু পরিকল্পনা হাতে নেওয়া ক্যাবিনেট মিনিস্টার মাইকেল হেসেলটিন তার জীবনীতে লিখেছেন, “শহরটি কার্যত তখন ছিল নেতৃত্বহীন।”

কঠিন ওই সময়েও মানুষের জীবনে ফুটবল ছিল। ছিল অসাধারণ দুটি দল লিভারপুল ও এভারটন। সুন্দর খেলাটি লিভারপুলের মানুষদের দিয়েছিল কিছু নায়ক আর বেঁচে থাকার আশা। 

১৯৮১ থেকে ১৯৯০-দুই মার্সিসাইড ক্লাব(লিভারপুল ও এভারটন) মিলে আটটি লিগ শিরোপা, দুটি ইউরোপিয়ান কাপ (বর্তমানের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ), একটি কাপ উইনার্স কাপ (বর্তমানের ইউরোপা লিগ), তিনটি করে এফএ কাপ ও লিগ কাপ ঘরে তুলেছিল।

সেই সময়ের লিভারপুলের অন্দর-বাহিরের নানা গল্প উঠে এসেছে গিলেস্পির কথায়।

“আমাদের কখনোই অতি উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ার সুযোগ ছিল না” লিভারপুলের এত এত সাফল্যের এটাই নিয়ামক ছিল বলে মনে করেন গিলেস্পি।

“কোচিং স্টাফের সবাই আমাদের সবসময় অহংকারী বলে ডাকতো। আর সুযোগ পেলেই তারা আমাদের তিরস্কার করতে ছাড়তো না। কখনও আমাদের অতিরিক্ত প্রশংসা করা হতো না। আমাদের এর প্রয়োজন ছিল বলেও মনে হয় না আমার।”

সোনালী সময়

ক্যারিয়ারের সোনালী সময়টা লিভারপুলে কাটান গিলেস্পি। ক্লাবের ইতিহাসেও সেটি যে স্বর্ণযুগ ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সে ছিল অবিশ্বাস্য এক যাত্রা। ক্যারিয়ারের অ্যানফিল্ড অধ্যায় নিয়ে বলতে গেলে এখনও উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন ১৯৯১ সালে সেল্টিকে যোগ দেওয়া গিলেস্পি।

“সেখানে আমি আট বছর ছিলাম, সবচেয়ে খারাপভাবে আমাদের লিগ শেষ করাটা ছিল রানার্সআপ হওয়া। দ্বিতীয় হলে সেটা ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হতো। অন্য যে শিরোপাই জেত না কেন, মৌসুম খারাপ কেটেছে বলে গণ্য হতো।”

লিভারপুল কিংবদন্তি বিল শ্যাঙ্কলি মন্ত্রটা আরও পরিষ্কার করে বলেছিলেন, “প্রথম হতে পারলেই তুমি সেরা। কিন্তু দ্বিতীয় হলে তুমি কিছুই না।”

লিগ শিরোপা কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল এর পেছনে আছে এক হৃদয় বিদারক ঘটনা। যে জন্য আশির দশকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে ইউরোপীয় প্রতিযোগিতায় নিষিদ্ধ ছিল ইংলিশ সব ক্লাব।  

২৯ মে, ১৯৮৫। বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে হেইজেল স্টেডিয়ামে ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনালে ইউভেন্তুসের মুখোমুখি হয় লিভারপুল। ম্যাচ শুরুর ঠিক আগমুহূর্তে ঘটে অকল্পনীয় এক দুর্ঘটনা; দুই পক্ষের সমর্থকদের আলাদা করে রাখা জাল ভেঙে ইউভেন্তুস সমর্থকদের হামলা করে বসে লিভারপুল সমর্থকরা। রক্তক্ষয়ী সে ঘটনায় ১১ বছরের এক শিশুসহ মোট ৩৯ জন প্রাণ হারায়। আহত হয় অসংখ্য। মূলত সেদিনের ওই ঘটনার পরই ইউরোপীয় প্রতিযোগিতায় ইংলিশ ক্লাবগুলোকে অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়।

প্রলেপ না পড়া ক্ষত

ওই দশকে ভেঙে পড়া শহরকে যদিও ফুটবল বাঁচিয়ে রেখেছিল, তারপরও এই খেলাই কখনও ভুলতে না পারার মত অনেক কষ্টের উৎসও ছিল। অনেক ক্ষতে প্রলেপ পড়েনি এখনও।

১৫ এপ্রিল, ১৯৮৯। শেফিল্ডের হিলসবরো স্টেডিয়ামে সেদিন এফএ কাপের সেমি-ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল লিভারপুল ও নটিংহ্যাম ফরেস্ট। দুই পক্ষের সমর্থকদের সংঘর্ষ এড়াতে আলাদা করে দেওয়া হয়েছিল গ্যালারি। এমনিতেই দর্শক ছিল আসন সংখ্যার চেয়ে বেশি, তারওপর লিভারপুলের জন্য ছিল তুলনামূলক ছোট গ্যালারি।

ম্যাচ শুরুর ১০ মিনিট আগে মাঠে ঢোকার অপেক্ষায় ছিল পাঁচ হাজারের বেশি দর্শক। চাপ সামলাতে না পেরে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা নির্দেশ দেন আরেকটি প্রবেশ পথ খুলে দিতে। তাতেই বাধে বিপত্তি; ওই পথ দিয়ে যে অংশে যাওয়া যায়, এর সব আসন আগেই পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।

শুরু হয় মানুষের হুড়োহুড়ি, পেছনের চাপে সামনের মানুষগুলো চ্যাপ্টা হতে থাকে। পায়ের তলায় চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন অনেকে। মর্মান্তিক সেই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৯৬ জন লিভারপুল সমর্থক। আহত হন শত শত।

শুরুর খানিক পরেই খেলা বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিজ্ঞাপনের বোর্ডগুলোকে স্ট্রেচার বানিয়ে আহত-নিহতদের নিয়ে যেতে দেখেন মাঠে স্তব্ধ হয়ে পড়া খেলোয়াড়রা। পরের কয়েক সপ্তাহ জুড়ে শোক জানানো হয়। এমনও হয়েছিল, ওই সময়ে একই সঙ্গে খেলোয়াড়-কোচের দায়িত্বে থাকা ৩৮ বছর বয়সী কেনি ডালগিশ এক দিনে চার জনের শেষকৃত্যে অংশ নিয়েছিলেন।

“ওই দুর্ঘটনা অনেক মানুষের মনে সারা জীবনের জন্য একটা ছাপ ফেলে দেয়,” বলেন গিলেস্পি। সেই দুর্ঘটনা নিয়ে এখনও ওই দলের অনেক খেলোয়াড় কথা বলতে চান না। যা বড় ছাপ ফেলেছিল লিগ মৌসুমের শেষ ভাগে।

সে বছরের শুরুতে লিগ টেবিলে শিরোপাধারী লিভারপুলের অবস্থান ছিল অচেনা; শীর্ষে থাকা আর্সেনালের চেয়ে ৯ পয়েন্ট পিছিয়ে পাঁচে ছিল তারা। এরপর দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে একপর্যায়ে আর্সেনালকে টপকে শীর্ষে উঠে যায় দলটি। শিরোপা লড়াই গড়ায় শেষ রাউন্ডে।

আর্সেনালের ফিরতি লেগে অ্যানফিল্ডে খেলার কথা ছিল এপ্রিলে। কিন্তু ‘হিলসবোরো ট্রাজেডির’ কারণে সেটি পিছিয়ে যায় ২৬ মে। চ্যাম্পিয়ন হতে আর্সেনালের জিততে হতো দুই গোলের ব্যবধানে।

আর্সেনাল ১-০ গোলে এগিয়ে থাকা অবস্থায় ম্যাচ গড়ায় যোগ করা সময়ে। শেষ বাঁশির আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড বাকি, আচমকা সফরকারী মিডফিল্ডার মাইকেল টমাস মাঝমাঠ থেকে ছুটে গিয়ে গোল করে বসেন। ২-০ ব্যবধানে হেরে শিরোপা হাতছাড়া হয় লিভারপুলের। চ্যাম্পিয়নদের সমান ৭৬ পয়েন্ট নিয়ে দুইয়ে থেকে লিগ শেষ করে তারা।

শেষ বাঁশি বাজার পর টিভি ক্যামেরায় দেখা যায়, স্তব্ধ হয়ে মাঠের দিকে চেয়ে আছেন ডালগিশ।

ওই মুহূর্ত নিয়ে লিভারপুল সমর্থক গর্ডন জেনকিন্স বলেন, “আর্সেনাল (দ্বিতীয়) গোল করার পর লিভারপুলের অনেক খেলোয়াড় মাটিতে নুইয়ে পড়েছিল। ওই সপ্তাহে তারা সেদিন তৃতীয় ম্যাচ খেলছিল, মাঝে সবার শেষকৃত্যেও গিয়েছিল তারা। তাই বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তাদের অনেকেই ছিল রীতিমত বিধ্বস্ত।”

হতাশা মুছে নতুন উদ্যমে

ওই হারের যারা সাক্ষী হয়েছিল, তাদের মনে ১৯৮৮-৮৯ আসরের শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচটি দাগ কেটেছিল। তবে চার সপ্তাহ পর লিভারপুলের খেলোয়াড়রা যখন প্রাক-মৌসুমের প্রস্তুতি পর্বে ফিরেছিল, কেউই সেই আর্সেনাল ম্যাচ নিয়ে আলোচনা করেনি। এমনকি ফেলে আসা মৌসুম নিয়েও নয়। গিলেস্পির ভাষায়, এগুলো ছিল চ্যাম্পিয়ন লিভারপুলের মূল মন্ত্র।

“কোচিং স্টাফ, ম্যানেজার, ক্লাবের কেউই কখনও পেছন ফিরে তাকাতো না, পুরনো বিষয় ভুলতে দেরি করত না। সেটি জয় কিংবা পরাজয় হোক না কেন। পুরো ব্যাপারটি যেন আমাদের মধ্যে গেঁথে দেওয়া হয়েছিল।”

১৯৮৯ এর গ্রীষ্মের দলবদলে উল্লেখযোগ্য একজন খেলোয়াড়কেই দলে টেনেছিল লিভারপুল; ৬ লাখ পাউন্ড ট্রান্সফার ফিতে ফিওরেন্তিনা থেকে সুইডিশ ডিফেন্ডার গ্লেন হাইসেনকে।

দুর্দান্ত দশকের শেষ মৌসুমের শুরুতে লিভারপুলকে ঠিক চেনা রূপে দেখা যায়নি। তবুও লিগে প্রথম আট ম্যাচ অপরাজিত ছিল তারা, এর মাঝে ছিল ক্রিস্টাল প্যালেসের বিপক্ষে ৯-০ গোলের অসাধারণ জয়। নবম রাউন্ডে তারা হেরে যায় সাউথ্যাম্পটনের মাঠে। বছর যদিও শেষ করে শীর্ষে থেকে, তবে তাদের পেছনে ছুটছিল অ্যাস্টন ভিলা।

মৌসুমের পরের ধাপে অবশ্য তাল মেলাতে পারেনি ভিলা। সেই সুযোগে শীর্ষস্থান মজবুত করে লিভারপুল। আর ২৮ এপ্রিল, ১৯৯০-ঘরের মাঠে কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্সকে ২-১ গোলে হারিয়ে শিরোপা পুনরুদ্ধার করে লিভারপুল।

ইংলিশ ফুটবলের ইতিহাসে রেকর্ড অষ্টাদশ লিগ শিরোপা জয়ের প্রসঙ্গে লিভারপুল সমর্থক গর্ডন বলেন, “হৃদয়ভাঙা এক দশকের পর চ্যাম্পিয়নশিপ জয়…অসাধারণ এক অর্জন ছিল।”

আজকের মত মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে স্মার্টফোনের অংশ হয়ে যাওয়ার তখনও কয়েক বছর বাকি। আর তাই, এক দশকে ষষ্ঠ ও মোট অষ্টাদশ লিগ শিরোপা জয়ের খবরটি সমর্থকদের জানানোর তখনও লিভারপুলের বাকি ছিল।

৩০ বছর আগের সবশেষ সেই সাফল্যের দিনে অ্যানফিল্ডে উপস্থিত ছিলেন সাত বছর বয়সী জন গিবন্স। আজ তিনি অ্যানফিল্ড র‌্যাপ পডকাস্টের কন্ট্রিবিউটর।

“মুহূর্তটি ছিল রোমাঞ্চকর, দারুণ ব্যাপার। সেদিন মাঠে কাউকে যদি বলা হতো, পরবর্তী লিগ শিরোপা জিততে লিভারপুলের ৩০ বছর লাগবে, নিশ্চিত কেউ বিশ্বাস করত না।”

ডালগিশের বিদায়, ইউনাইটেডের উত্থান-লিভারপুলের পতন

ভবিষ্যতের কঠিন বাস্তবতার আভাস ১৯৯০ দশকের শুরুতেই পেয়েছিল লিভারপুল। বড় ক্লাবেরও যে মুহূর্তের জন্য হেলাফেলা করার সুযোগ নেই, তা ভালোই অনুধাবন করেছিল লিভারপুল। ঠিক যেমন তাদের সাবেক কোচ বিল শ্যাঙ্কলি বলেছিলেন, “ফুটবল নিরন্তর…এটা নদীর মত চলতেই থাকে।”

১৯৯১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারির সকাল। ১৯৯০-৯১ মৌসুমের তিন মাসের মত বাকি। ফটোগ্রাফার, টিভি ক্রু ও সাংবাদিকরা অ্যানফিল্ডে ভিড় করলেন। শহরটির পত্রিকা ‘লিভারপুল ইকো’ আগেই তাদের প্রথম পাতা প্রস্তুত করে ফেলেছে। কারণ, তারা জানতো কি হতে যাচ্ছে। লিগ টেবিলে লিভারপুলকে ৩ পয়েন্ট ব্যবধানে শীর্ষে রেখে বিদায় নিতে যাচ্ছেন কোচ ডালগিশ।

সংবাদ সম্মেলনে ওই সময়ের ৪০ বছর বয়সী ডালগিশ বলেন, “ব্যক্তি হিসেবে কেনি ডালগিশ তার সামর্থ্যের সর্বোচ্চটা দিয়ে দিয়েছে।”

লিভারপুলের খেলোয়াড় হিসেবে তিনটি ইউরোপিয়ান কাপ, পাঁচটি লিগ শিরোপা ও চারটি লিগ কাপ জিতেছিলেন ডালগিশ। আর খেলোয়াড়-কোচ হিসেবে দলটিকে আরও তিনটি লিগ, দুটি এফএ কাপ জিতিয়েছিলেন তিনি; এর মধ্যে একবার ছিল লিগ ও কাপের ডাবল।

হেইজেল দুর্ঘটনার পরও একবার স্বল্প সময়ের জন্য দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন লিভারপুলের ডালগিশ। তার বিদায়ের ক্ষণ থেকেই যেন শুরু হয় দলটির টানা ব্যর্থতার পালা। গিলেস্পিও তাই মনে করেন।

“কেনি চলে যাওয়ার পর থেকেই সবকিছু খারাপ হওয়ার শুরু হলো।”

অনেকের মতে, লিভারপুলের এক দশকের সফল কাঠামোর ভেঙে পড়ার প্রথম আভাস মিলেছিল ১৯৮৯-৯০ মৌসুমের এফএ কাপের সেমি-ফাইনালে। ওই ম্যাচে ক্রিস্টাল প্যালেসের বিপক্ষে ৪-৩ গোলে হেরে ছিটকে গিয়েছিল আগেরবারের চ্যাম্পিয়নরা। অভিজ্ঞ তারকা ফুটবলাররা তাদের ক্যারিয়ারের শেষপ্রান্তে চলে এসেছিল। নতুন কোচ গ্রায়েম সোনেস দলের জন্য অনুপযুক্ত খেলোয়াড় দলে টানছিলেন, সেই সঙ্গে দামি ফুটবলারদের।

৩০ মাইল দূরের ক্লাব প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তখন প্রস্তুত হচ্ছিল ইংলিশ ফুটবল আধিপত্যের। আর এই নতুন যুগের সূচনা হয় ১৯৯২ সালে প্রিমিয়ার লিগ শুরুর মধ্য দিয়ে; অর্থ, গ্ল্যামার ও ইংলিশ ফুটবলের বিশ্বায়ন। মাঠে সফল হওয়ার পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবেও দারুণ উন্নতি করছিল ইউনাইটেড।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ১৩ বার লিগ চ্যাম্পিয়ন করানো স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন ২০০২ সালে ইংলিশ পত্রিকা দা গার্ডিয়ানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল লিভারপুলকে তাদের জায়গা থেকে নামানো।”

২০টি লিগ শিরোপা জিতে এখনও প্রতিযোগিতাটির সফলতম ক্লাবের ট্যাগ ইউনাইটেডের গায়েই সেটে আছে। অবশ্য কয়েক বছর আগে তাদের যে আধিপত্য ছিল, এখন আর তা নেই।

ফের সিংহাসনে?

ডালগিশের বিদায়ের পর অপেক্ষার ৩০ বছরে মোট ১১ জন নতুন কোচ পেয়েছে অ্যানফিল্ড। মাঝে একবার তো একই সঙ্গে দুই কোচের অধীনেও খেলেছে দলটি। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সাফল্য মেলেনি।

রাফায়েল বেনিতেসের অধীনে ২০০৮-০৯ ও ব্রেন্ডন রজার্সের কোচিংয়ে ২০১৩-১৪ মৌসুমে লিগে রানার্সআপ হয় তারা। আর সবশেষ গত মৌসুমে ম্যানচেস্টার সিটির সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই; ৯৭ পয়েন্ট নিয়ে রানার্সআপ হয় ‘অল রেডস’। ১ পয়েন্ট বেশি নিয়ে শিরোপা জেতে পেপ গুয়ার্দিওলার সিটি।

গত তিন দশকে এই তিনবারই শিরোপার সবচেয়ে কাছাকাছি গেছে লিভারপুল-এই আসরগুলোর কোনোটিতেই অবশ্য তারা প্রশ্নাতীতভাবে সেরা ফর্মে ছিল না। সমর্থকরা স্বপ্ন দেখেছিল বটে, কিন্তু পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেনি।

২০১৯-২০ মৌসুমের চিত্র অবশ্য পুরোপুরি ভিন্ন; ২৯ রাউন্ডে মাত্র ৫ পয়েন্ট হারিয়েছে ইয়ুর্গেন ক্লপের দল। প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে এর আগে কোনো দলকে এতটা অদম্য রূপে দেখা যায়নি। পরিস্থিতি যত কঠিনই হোক, জয়ের কোনো না কোনো পথ ঠিক বের করে নিয়েছে। দুর্দান্ত পথচলায় সর্বোচ্চ ম্যাচ হাতে রেখে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ড গড়ার হাতছানি তাদের সামনে।

গত মৌসুমে লিগে তারা একবারই মাত্র হেরেছিল; ম্যানচেস্টার সিটির মাঠে ২-১ গোলে, ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি। এবারও তারা ছুটছিল দারুণ ছন্দে। লিগে ১৩ মাসের বেশি অপরাজিত থাকার পর গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ওয়াটফোর্ডের মাঠে হেরে বসে ৩-০ গোলে। পরের রাউন্ডেই বোর্নমাউথকে ২-১ ব্যবধানে হারিয়ে পথে ফেরে মোহামেদ সালাহ-সাদিও মানেরা।

এর কদিন পরেই কোভিড-১৯ মহামারীতে ইংল্যান্ডে স্থগিত হয়ে যায় সব ধরনের খেলাধুলা। বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা ও ইউরোপীয় সর্বোচ্চ সংস্থা উয়েফার পক্ষ থেকে অবশ্য ঘরোয়া লিগগুলো শেষ করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে; কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ কাটেনি এক বিন্দুও।

ফেলে আসা ৩০ বছরে লিভারপুল যে শিরোপা জেতেনি এমন নয়। এ সময়ে তারা ইউরোপ শ্রেষ্টত্বের মুকুট পরেছে দুবার। এফএ কাপ জিতেছে তিনবার, লিগ কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে চারবার। স্বাদ পেয়েছে ইউরোপা লিগ, উয়েফা সুপার কাপ ও কমিউনিটি শিল্ডের।

গত বছর খুব কাছ থেকে লিগ শিরোপা হাতছাড়া করলেও ১ জুন মাদ্রিদের ওয়ান্দা মেত্রোপলিতানোয় চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে হতাশায় প্রলেপ দেয় লিভারপুল। অ্যানফিল্ডে জার্মান কোচ ক্লপের সেটি ছিল প্রথম শিরোপা। এর মধ্য দিয়ে একই সঙ্গে খেলোয়াড় ও সমর্থকদের বিশ্বাস আরও মজবুত হয়।

আত্মবিশ্বাসের প্রতিফলন পড়ে মাঠে, অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে অল রেড বাহিনী। সেই আশির দশকে লিভারপুলের কাছে যেমন ছিল, ‘আর যাই জেত না কেন বাছা, লিগ শিরোপাই শেষ কথা।’

‘অনন্ত’ অপেক্ষায় সেই চাওয়া যেন আরও জোরদার হয়েছে। ৬৪ বছর বয়সী জয় ব্র্যাথারটনের কথায় তা আরও পরিষ্কার হয়।

যুক্তরাজ্যে লকডাউন ঘোষণার কয়েক দিন আগে, ‘লিভারপুল লিগ জিতবে কি-না’ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, “সকালে আমি ঠিক এটাই ভাবি এবং দিন শেষে রাতেও এটা ভাবি। আর ঘুম-ঘুম চোখে এই দুই বিষয় নিয়ে মিশ্র একটা স্বপ্ন দেখি।”

গর্ডন জেনকিন্স-জয় ব্র্যাথারটনদের মত বিশ্বজুড়ে লাখো-কোটি লিভারপুল সমর্থকদের স্বপ্ন এবার পূরণ হবে? নাকি শিরোপার সুবাস পেয়ে আবারও খালি হাতে ফিরতে হবে তাদের? বছরজুড়ে দাপুটে ফুটবল খেলেও কি হতাশায় মুখ ঢাকতে হবে ক্লপের দলকে? অধরা প্রিমিয়ার লিগের শিরোপার অপেক্ষা তিন দশকেও কী শেষ হবে না? জবাব-আপাতত জানা নেই কারও।

ইতিহাস বলে হাল ছাড়ার পাত্র নয় লিভারপুল। ২০০৫ সালে ইস্তানবুলে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে এসি মিলানের বিপক্ষে ৩-০ গোলে পিছিয়ে ছিল ইংলিশ দলটি। কিংবদন্তি বলে, সে সময়ে খেলোয়াড়দের মনোবল বাড়াতে সমর্থকরা গেয়ে ওঠেন দলীয় সঙ্গীত, ‘ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন।’ কাজ হয় দারুণভাবে। দ্বিতীয়ার্ধে ৭ মিনিটের মধ্য ৩ গোল শোধ করে সমতা ফেরায় লিভারপুল। পরে টাইব্রেকারে জিতে নেয় শিরোপা। ঘুরে দাঁড়ানোর অমন গল্প রচনা করা দলটি এতো সহজে হাল ছাড়বে কেন?