মেসি-রোনালদোর ‘সম্মুখ যুদ্ধের’ এক যুগ

করোনাভাইরাসের ছোবলে আরও অনেক দিন-তারিখের মত এবারের ২৩ এপ্রিলও চলে গেল অনেকটা নিরবে-নিভৃতে। ফুটবলপ্রেমীরাও ঝড় তুললেন না চায়ের কাপে। এক যুগ আগে এই দিনেই যে শুরু হয়েছিল লিওনেল মেসি ও ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর ‘সম্মুখ যুদ্ধ’।

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 April 2020, 02:58 AM
Updated : 26 April 2020, 02:58 AM

এপ্রিল ২৩, ২০০৮। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমি-ফাইনালের প্রথম লেগে কাম্প নউয়ে মুখোমুখি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও বার্সেলোনা। মেসির বয়স তখন ২০ বছর, রোনালদোর ২৩। ওই ম্যাচে দুজনে ছিলেন গোলহীন, ম্যাচও শেষ হয় গোলশূন্য ড্রয়ে। কিন্তু ফুটবল ইতিহাসের অবিস্মরণীয় এক দ্বৈরথের শুরু ওই ম্যাচ দিয়েই।

প্রথম লেগে কাম্প নউয়ে পেনাল্টি মিস করেছিলেন রোনালদো। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ফিরতি লেগে পল স্কোলসের একমাত্র গোলে জিতে ঠিকই ফাইনালে ওঠে ইউনাইটেড। মস্কোর ফাইনালে চেলসিকে হারিয়ে জিতে নেয় ইউরোপ সেরার মুকুট। ২০০৯ সালে ৮ কোটি পাউন্ডের রেকর্ড ট্রান্সফার ফিতে রোনালদো নোঙর ফেলেন রিয়াল মাদ্রিদে। নতুন মাত্রা পায় সময়ের দুই সেরার লড়াই।

বর্তমানে মেসির বয়স ৩২, রোনালদোর ৩৫। এ পর্যন্ত আর্জেন্টাইন ও পর্তুগিজ তারকা ফুটবলের আঙিনায় সম্মুখ সমরে নেমেছেন ৩৬ বার। আনন্দ-বিষাদ সঙ্গী হয়েছে দুজনেরই।

যুগপূর্তিতে পেছন ফিরে দেখা যেতে পারে দুজনের স্মরণীয় ছয় লড়াই।

চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল, ২০০৯ (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ০-২ বার্সেলোনা)

ফাইনালের মঞ্চ ছিল রোম, সেই ম্যাচ ঘিরে উত্তেজনা এমন ছিল যেন কলোসিয়ামে লড়াইয়ে নামবেন প্রবল প্রতাপশালী দুই গ্ল্যাডিয়েটর!

রোমের অলিম্পিক স্টেডিয়ামের ফাইনালে পাদপ্রদীপের আলোটুকু নিজের করে নিয়েছিলেন মেসি। আড়াল হয়ে ছিলেন রোনালদো। সামুয়েল এতোর গোলে বার্সেলোনা এগিয়ে যাওয়ার পর ৭০তম মিনিটে মেসির লক্ষ্যভেদে কোণঠাসা হয়ে পড়ে ইউনাইটেড। রোনালদো পারেননি দলের ত্রাণকর্তা হতে। ইউরোপ সেরার লড়াই জিতে ট্রেবল জয়ের দারুণ কীর্তি গড়েছিলেন মেসিরা।

লা লিগা, ২০১০ (বার্সেলোনা ৫-০ রিয়াল মাদ্রিদ)

যথারীতি এ ম্যাচকেও দেখা হচ্ছিল দুজনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের মঞ্চ হিসেবে। কিন্তু লড়াই ছিল একতরফা। মেসিদের সামনে স্রেফ উড়ে গিয়েছিলেন রোনালদোরা।

রোনালদো নিশ্চয়ই মনে রাখতে চাইবেন না ২০১০ সালের ২৯ নভেম্বর, লা লিগার সেই ম্যাচ। কী দুঃসহ অভিজ্ঞতা নিয়েই না চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের আঙিনা থেকে ফিরতে হয়েছিল রিয়ালকে!

পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে থেকে ও টানা সাত ম্যাচ অপরাজিত থেকে কাম্প নউয়ে গিয়েছিল রিয়াল। জোসে মরিনিয়োর দল ফিরেছিল স্রেফ বিধ্বস্ত হয়ে।

মর্যাদার লড়াইয়ে বার্সেলোনা লিখেছিল ৫-০ গোলে জয়ের দুর্দান্ত এক মহাকাব্য। ওই ম্যাচে গোল পাননি মেসি, তবে অবদান রেখেছিলেন দুটিতে। তিনি নিজে একবার জালে বল পাঠালেও বাতিল হয়ে যায় সেটি।

রিয়াল সমর্থকদের উদ্দেশে হাতের পাঁচ আঙুল উঁচিয়ে উদযাপন করে তাদের বড় হারের সেই ক্ষত যেন আরও দগদগে করে তুলেছিলেন বার্সেলোনা ডিফেন্ডার জেরার্দ পিকে।

কোপা দেল রে ফাইনাল, ২০১১ (রিয়াল মাদ্রিদ ১-০ বার্সেলোনা)

ক্লাসিকোয় পঞ্চমবারের চেষ্টায় অবশেষে জয়ের হাসি হাসতে পেরেছিলেন রোনালদো। নির্ধারিত সময় গোলশূন্যভাবে শেষ হওয়ার পর অতিরিক্ত সময়ে গড়িয়েছিল ম্যাচ। ১০৩তম মিনিটে পর্তুগিজ ফরোয়ার্ডের দুর্দান্ত হেডে গোল করে ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দেন রোনালদো। শিরোপা জয়ের উৎসবে মাতে রিয়াল।

লা লিগা, ২০১২ (রিয়াল মাদ্রিদ ২-১ বার্সেলোনা)

বার্সেলোনার মাঠ কাম্প নউয়ে লড়াই চলছিল জমজমাট। সামি খেদিরার গোলে এগিয়ে যায় রিয়াল। ৭০তম মিনিটে আলেক্সিস সানচেসের গোলে সমতায় ফেরে বার্সেলোনা। গোল তখনও মেসি-রোনালদোর কাছে অধরা।

শেষ পর্যন্ত রোনালদোর গোলেই মহারণ জিতে নেয় রিয়াল। ওই জয়েই লিগ শিরোপা অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায় তাদের। চার ম্যাচ বাকি রেখে এগিয়ে যায় তারা ৭ পয়েন্টে।

রোনালদোর ওই লক্ষ্যভেদে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড নিজের করে নেয় রিয়াল (১০৯টি)। ওই মৌসুমে ১০০ পয়েন্ট তুলে লিগ শিরোপার উৎসব সেরেছিল মাদ্রিদের দলটি। ৯ পয়েন্ট পেছনে থেকে দ্বিতীয় হয়েছিল বার্সেলোনা।

কোপা দেল রে, ২০১৩ (রিয়াল মাদ্রিদ ৩-১ বার্সেলোনা)

সান্তিয়াগো বের্নাবেউয়ে প্রথম লেগ হয়েছিল ১-১ ড্র। যথেষ্ট শঙ্কা নিয়েই কোপা দেল রের সেমি-ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনার মাঠ কাম্প নউয়ে ফিরতি লেগে খেলতে গিয়েছিল রিয়াল।

শুরুর দিকে রোনালদো ডানা মেলায় শঙ্কার মেঘ সরে যায় ‍মুহূর্তেই; ত্রয়োদশ মিনিটে পেনাল্টি থেকে তিনি এগিয়ে নেন রিয়ালকে। ৫৭তম মিনিটে উপহার দেন আরেকটি গোল। বার্সেলোনাকে তাদের মাঠেই দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে ফাইনালে উঠেছিল রিয়াল।

ওই ম্যাচেই মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করার ভঙ্গি করে বার্সেলোনা সমর্থকদের সামনে নেচেছিলেন রিয়াল কোচ মরিনিয়ো। বার্সার মাঠে টানা ছয় ম্যাচে জালের নাগাল পাওয়ার তৃপ্তি নিয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন রোনালদো।

লা লিগা, ২০১৭ (রিয়াল মাদ্রিদ ২-৩ বার্সেলোনা)

২০১৬-১৭ মৌসুমেও দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর লা লিগার শিরোপা লড়াই জমেছিল দারুণ। শেষ হাসি অবশ্য হেসেছিল রিয়াল। কিন্তু লিগের শেষ ক্লাসিকোয় জয়ের হাসি ছিল বার্সেলোনার। সেটিও আবার রিয়ালের মাঠ সান্তিয়াগো বের্নাবেউয়ে।

প্রথমার্ধেই একটি গোল করেছিলেন মেসি। তবে ৯০ মিনিটেও খেলায় ছিল ২-২ সমতা। যোগ করা সময়ে জর্দি আলবার পাস থেকে বাঁ পায়ের ট্রেডমার্ক শটে জাল খুঁজে নেন মেসি। রিয়াল সমর্থকদের উদ্দেশে জার্সি উঁচিয়ে মেতে ওঠেন উল্লাসে। তার সেই উদযাপন নিয়ে পরে চর্চা হয়েছে অনেক।

২০১৮ সালের জুলাইয়ে রিয়াল ছেড়ে রোনালদো ইউভেন্তুসে পাড়ি জমানোয় সময়ের সেরা দুই গোলমেশিনের লড়াইয়ের দামামা থিতিয়ে যায় অনেকটা। সেরার বিতর্ক চলছে এখনও, তবে সম্মুখ সমরের উত্তেজনার দেখা নেই!