যে চূড়ার কাছে রোনালদো, দূরে মেসি

ফুটবলের আঙিনায়, পরিসংখ্যানের পাতায় কতই না রঙ ছড়িয়েছেন ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো। লিখেছেন দারুণ সব প্রাপ্তির গল্প। ৩৫ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ডের সামনে আরেকটি রেকর্ডের হাতছানি। বয়সের ভারে শরীর পথ আগলে না দাঁড়ালে একদিন হয়তো নিজের করে নেবেন জাতীয় দলের হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতার মুকুটও। এখন যেটি শোভা পাচ্ছে ইরানের আলি দাইয়ের মাথায়।

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 April 2020, 10:36 AM
Updated : 24 April 2020, 12:32 PM

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ছোবলে স্থগিত সব ধরনের খেলাধুলা। কিন্তু বয়স তো বসে নেই। দাইয়ের সঙ্গে ১০ গোলের ব্যবধান ঘুচিয়ে রোনালদোর শীর্ষে ওঠার সময়ও কি ফুরিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে? বুটজোড়া তুলে রাখার আগে পর্তুগিজ ফরোয়ার্ড চূড়ায় পদচিহ্ন এঁকে যেতে পারবেন কি-না, সে প্রশ্নের উত্তর তোলা সময়ের হাতে। ঘরবন্দি জীবনের এই অবসরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর পাঠকদের জন্য ভিন্ন এক আয়োজন, যেখানে থাকছে জাতীয় দলের হয়ে গোলদাতাদের তালিকার প্রথম ১০ জনের গল্প।

১০. সুনিল ছেত্রী, ভারত (১১৫ ম্যাচ, ৭২ গোল)

বিস্ময়কর শোনালেও সত্য, এই তালিকার সেরা দশে নেই লিওনেল মেসি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার ম্যাচ প্রতি গোলের গড় বেশ ভালো, কিন্তু আপাতত তিনি চূড়া থেকে অনেক দূরে। আর্জেন্টিনার হয়ে তারকা এই ফরোয়ার্ডের গোল ৭০টি। তার চেয়ে দুই গোল বেশি নিয়ে ১০ নম্বরে আছেন ভারতের সুনিল ছেত্রী।

‘ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাস্টিক’ নামে পরিচিত ছেত্রী দেশের হয়ে খেলেছেন সর্বোচ্চ ম্যাচ। করেছেন সর্বোচ্চ গোল (৭২টি)। ২০১১ সাল ছিল জাতীয় দলের হয়ে তার কাটানো সোনালী বছর; ১৭ ম্যাচ খেলে করেছিলেন ১৩ গোল। বয়স হয়ে গেছে ৩৫ বছর, এই তালিকায় বেশি ওপরে ওঠার সুযোগ তাই কমই।

৯. বাশার আব্দুল্লাহ, কুয়েত (১৩৩ ম্যাচ, ৭৫ গোল)

২০০০ সালে কুয়েত তাদের ফুটবল ইতিহাসে পেয়েছিল সবচেয়ে বড় ব্যবধানের জয়; ভুটানকে উড়িয়ে দিয়েছিল ২০-০ গোলে! ওই ম্যাচেই আটবার প্রতিপক্ষের জালে বল পাঠিয়েছিলেন বাশার আব্দুল্লাহ! চার দিন পর নেপালের বিপক্ষে এই ফরোয়ার্ড করেছিলেন পাঁচ গোল।

১৯৯৬ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত কুয়েতের হয়ে খেলা বাশার জাতীয় দলের হয়ে জিতেছেন দুটি গালফ কাপ; এএফসি এশিয়ান কাপের সেমি-ফাইনালে ওঠা দলেও ছিলেন এই ফরোয়ার্ড। তার ভুরিভুরি গোলের অধিকাংশই এসেছে ভুটান, নেপাল, সিঙ্গাপুর, ফিলিস্তিন, উজবেকিস্তানের মতো দলের বিপক্ষে।

৮. পেলে, ব্রাজিল (৯২ ম্যাচ, ৭৭ গোল)

২১টি ‘আনঅফিসিয়াল’ ম্যাচ, তাই এ ম্যাচগুলোয় করা ১৮ গোলও ‘আনঅফিসিয়াল’। এই গোলগুলো আন্তর্জাতিক গোলের পাতায় যোগ হলে কিংবদন্তি পেলে থাকতেন তালিকার দ্বিতীয় স্থানে! অফিসিয়াল হিসাবে ৯২ ম্যাচে ৭৭ গোল নিয়ে রেকর্ডের পাতায় তিনি তাই অষ্টম।

মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে সুইডেনের বিপক্ষে জোড়া গোল করেছিলেন পেলে। সেমি-ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে করেছিলেন হ্যাটট্রিক। বর্ণিল ক্যারিয়ারে পরে আরও ছয়বার পেয়েছেন হ্যাটট্রিকের স্বাদ। চার বিশ্বকাপে ১৫ ম্যাচ খেলে করেন ১২ গোল। সতীর্থদের ১০ গোলে রাখেন অবদান। ১৯৭০ বিশ্বকাপের ফাইনালে ইতালির বিপক্ষে হেডে বল জালে পাঠিয়েছিলেন পেলে; যেটি ছিল বিশ্বকাপে ব্রাজিলের শততম গোল।

৭. জাইনাল আবেদিন হাসান, মালয়েশিয়া (১৩৮ ম্যাচ, ৭৮ গোল)

ক্যারিয়ারে দেশের হয়ে অনেক ম্যাচে আবেদিন সামলেছেন রক্ষণ! আক্রমণভাগ ও রক্ষণভাগ-দুই প্রান্তে তিনি এতটাই দক্ষ ছিলেন যে কোনো কোনো ম্যাচে স্ট্রাইকার হিসেবে শুরু করে পরের দিকে লিড ধরে রাখতে দায়িত্ব পেতেন রক্ষণ সামলানোয়!

আবেদিনের মতো জাতীয় দলের হয়ে ৭৮ গোল আছে ইরাকের হুসেইন সাঈদেরও। কিন্তু তার চেয়ে এক ম্যাচ বেশি খেলার কারণে এক ধাপ নিচে ঠাঁই হয়েছে ক্লাব ক্যারিয়ারে ৩৬৭ লিগ ম্যাচে ১৯৩ গোল করা আবেদিনের।

৬) হুসেইন সাঈদ (ইরাক, ১৩৭ ম্যাচ, ৭৮ গোল)

ইরাকের মানুষের কাছে দেশটির ফুটবল ইতিহাসের ‘প্লেয়ার অব দা সেঞ্চুরি’ হলেন হুসেইন সাঈদ। ৩২ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি না ঘটলে এই ফরোয়ার্ডের সুযোগ ছিল রেকর্ডটাকে আরও উঁচুতে তোলার।

রেফারিংয়ের কারণে ১৯৯০ সালের ইরাক গালফ কাপ থেকে ইরাক নিজেদের সরিয়ে নিলে থেমে যায় সাঈদের পথচলা।

ইরাকের এই সর্বোচ্চ গোলদাতা ক্লাব ক্যারিয়ারের পুরোটাই কাটিয়েছেন আল-তালাবায়। ১৯৮৪ সালে দেশের গালফ কাপ জয়ের অন্যতম কারিগর ছিলেন সাঈদ।

৫. গডফ্রে চিতালু (জাম্বিয়া, ১০৮ ম্যাচ, ৭৯ গোল)

২০১২ সালে মেসি যখন জার্ড মুলারের এক বর্ষপঞ্জিতে করা সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ড ভাঙলেন, তখন জাম্বিয়ার ফুটবল ফেডারেশন দাবি করেছিল, ১৯৭২ সালে নাকি এক বর্ষপঞ্জিতে ১০৭ গোল করেছিলেন চিতালু! ওই বছরই ৮৫ গোল করেছিলেন মুলার, যে রেকর্ড পরে ভেঙেছিলেন মেসি।

জাম্বিয়ার সেই দাবির সুরাহা হয়নি। তবে চিতালু জাতীয় দলের হয়ে সর্বোচ্চ গোলের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন ১০৮ ম্যাচে ৭৯ গোল করে। ১৯৮০ সালের মস্কো অলিম্পিকে দারুণ সময় কাটানো চিতালু ১৯৯৩ সালে প্রাণ হারান বিমান দুর্ঘটনায়। সেসময় জাতীয় দলের কোচ ছিলেন তিনি।

৪. কুনিসিগে কামামোতো, জাপান (৮৪ ম্যাচ, ৮০ গোল)

তাকে বলা হয় জাপানের প্রথম ফুটবল ‘সুপারস্টার’। ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৭ সাল-১৩ বছরের ক্যারিয়ারে কামামোতো ১৯৬৮ সালের মেক্সিকো অলিম্পিকে কাটিয়েছিলেন দারুণ সময়। নাইজেরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে উপহার দিয়েছিলেন হ্যাটট্রিক। ফ্রান্সের বিপক্ষে কোয়ার্টার-ফাইনালে করেছিলেন জোড়া গোল। সেবার তৃতীয় হয়েছিল জাপান।

কামামোতো থাকায় ১৯৭০ বিশ্বকাপের বাছাইয়ে জাপানের প্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বী। কিন্তু ১৯৬৯ সালে তিনি হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হওয়ায় ধাক্কা খায় জাপান।

দেশের হয়ে কামামোতোর সেরা সময় ছিল ১৯৭২ সাল; সেবার আট ম্যাচে ১৫ গোল করেছিলেন পরে রাজনীতির ময়দানে নামা এই ফরোয়ার্ড।

৩) ফেরেঙ্ক পুসকাস (হাঙ্গেরি, ৮৫ ম্যাচ, ৮৪ গোল)

১৯৪৫ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত জাতীয় দলের হয়ে খেলে ৮৫ ম্যাচে ৮৪ গোল করেছিলেন পুসকাস। হাঙ্গেরিয়ান আর্মি ক্লাবে খেলার সুবাদে ‘গ্যালোপিং মেজর’ খেতাব পাওয়া সাবেক এই ফরোয়ার্ডের জাতীয় দলের হয়ে হ্যাটট্রিকের সংখ্যা তিনটি। আলবেনিয়াকে ১২-০ ব্যবধানে বিধ্বস্ত করার ম্যাচে চার গোল করেছিলেন এই ফুটবল গ্রেট।

১৯৫২ অলিম্পিকে হাঙ্গেরির ফুটবল ইভেন্টের সোনা জয়ে চার গোল করেছিলেন পুসকাস। পরের দুই বছরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যথাক্রমে ৬-৩, ৭-১ ব্যবধানে জেতা দুই ম্যাচে দুটি করে গোল করেছিলেন তিনি।

১৯৫৪ বিশ্বকাপে হাঙ্গেরির প্রথম দুই ম্যাচে তিন গোল করা পুসকাস হাঁটুর চোটে পরের দুই ম্যাচ খেলতে পারেননি। জার্মানির বিপক্ষে ফাইনালে ফিরে দলকে এগিয়ে নেন, কিন্তু হয়নি শেষ রক্ষা। শেষ দিকের গোলে ৩-২ ব্যবধানে হেরে স্বপ্ন ভাঙে হাঙ্গেরির। পুসকাসেরও।

২) ক্রিস্তিয়ানো রোনালাদো, পর্তুগাল (১৬৪ ম্যাচ, ৯৯ গোল)

ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর হয়ে ৭০ গোল করা স্টার্ন জন্সকে ২০১৭ সালে যখন স্পর্শ করেন রোনালদো, তখনও এই তালিকায় তার অবস্থান ১১ জনের পরে!

২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে স্পেনের বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ম্যাচে হ্যাটট্রিক করে পুসকাসের পাশে বসেন রোনালদো। পরের ম্যাচে মরক্কোর বিপক্ষে হাঙ্গেরিয়ান গ্রেটকে পেছনে ফেলা পর্তুগিজ তারকার সামনে এখন কেবল ইরানের আলি দাই।

আর এক গোল হলে ইতিহাসের দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে জাতীয় দলের জার্সিতে ‘সেঞ্চুরি’ পূরণ করবেন রোনালদো।

রিয়াল মাদ্রিদ থেকে সেরি আর দল ইউভেন্তুসে যোগ দেওয়া রোনালদোর বয়স এখন ৩৫ বছর। এই বয়সেও পর্তুগাল ও ইউভেন্তুসের হয়ে নিয়মিত খেলে যাওয়া এই ফরোয়ার্ড যেন এই বার্তাই দিচ্ছেন-আলি দাই... আমি আসছি।

১. আলি দাই, ইরান (১৪৯ ম্যাচ, ১০৯ গোল)

১৯৯৯ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপ পর্বে চেলসির বিপক্ষে হের্টা বার্লিনের ২-১ গোলের জয়ের ম্যাচে দারুণ এক দৃশ্য দেখছিল ফুটবলপ্রেমীরা। চেলসির ছয় ফুট লম্বা ফরাসি ডিফেন্ডার ফ্রাঁ লেবোউফকে নিচে ফেলে হেডে গোল করলেন আলি দাই; লেবোউফকে টপকানোর কাজটি যে খুব কম ফরোয়ার্ডেরই পারার নজির আছে!

ইরানের হয়ে ১৯৯৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত খেলা দাই ১০৯ গোল নিয়ে এই তালিকার চূড়ায়। ক্যারিয়ারে দুই ম্যাচে চারটি করে গোল আছে তার; ১৯৯৬ সালে এশিয়ান কাপে দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে ও ২০০৬ সালের বিশ্বকাপ বাছাইয়ে লাওসের বিপক্ষে ম্যাচে।

কঠিন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে দাই অবশ্য অতটা পারঙ্গম ছিলেন না। ১৯৯৮ ও ২০০৬ বিশ্বকাপে পাননি গোলের দেখা। তবে ১৯৯৮ বিশ্বকাপে ইরানের একটি দারুণ প্রাপ্তিতে লেখা আছে এই ফরোয়ার্ডের নাম। সেবার তার তৈরি করে দেওয়া গোলেই যুক্তরাষ্ট্রকে হারিয়েছিল ইরান, যেটি আজ অবধি বিশ্বকাপে ইরানিদের পাওয়া প্রথম এবং সর্বশেষ জয়!