ভবিষ্যৎ না দেখে হ্যান্ডবলের মেয়েরা ছুটছে অন্য খেলায়

নিজস্ব স্টেডিয়াম আছে, জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপও হয় নিয়মিত। কিন্তু হ্যান্ডবল নিয়ে মেয়েদের আগ্রহ কমছে দিনকে দিন। তাতে টান পড়ছে আন্তর্জাতিক আঙিনার সাফল্যে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় মেয়েদের হ্যান্ডবল পিছিয়ে পড়ার নানা কারণ নিয়ে কথা বলেছেন কোচ নাসির উল্লাহ লাভলু। দিয়েছেন সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার পরামর্শও।

উত্তম সেন গুপ্তবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 April 2020, 11:21 AM
Updated : 22 April 2020, 12:33 PM

২০১৪ সালে পাকিস্তানে আইএইচএফ যুব চ্যালেঞ্জ ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন, তার আগে ১৯৯৫ সালে কমনওয়েলথ ইয়ুথ হ্যান্ডবল চ্যাম্পিয়নশীপে রানার্স-আপ হওয়ার কীর্তি আছে বাংলাদেশের মেয়েদের। ২০১৬ সালে দক্ষিণ এশিয়ান গেমসেও (এসএ গেমস) তারা জিতেছিল রুপা। ২০১৮ সালে ভারতের লক্ষ্ণৌতে সাউথ এশিয়ান হ্যান্ডবল চ্যাম্পিয়নশিপে হয়েছিল তৃতীয়। কিন্তু গত ডিসেম্বরে নেপালের এসএ গেমসে প্রত্যাশিত সাফল্য মেলেনি; তৃতীয় হয় মেয়েরা।

তার পরও, সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মোটামুটি সাফল্যের দেখা পেয়েছে মেয়েরা। কিন্তু ঘরোয়া হ্যান্ডবলেই তারা নানা উপেক্ষার শিকার!

মেয়েদের প্রতিযোগিতা নিয়ে জেলার অনীহা

জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ হয় নিয়মিত হলেও প্রথম বিভাগ লিগ বড্ড অনিয়মিত। ২০১৫ সালের পর চার বছর বিরতি দিয়ে ২০১৯ সালে হয়েছিল সর্বশেষ প্রথম বিভাগ লিগ। মেয়েদের প্রতিযোগিতা কম থাকায় জাতীয় দল গঠনে বাছাই প্রক্রিয়া যথেষ্ট মানসম্পন্ন হয় না বলে মনে করেন কোচ লাভলু।

“বিভিন্ন জেলায় অনিয়িমিত হলেও ছেলেদের লিগ আয়োজন করা হয়। কিন্তু মেয়েদের লিগ আয়োজনে প্রবল অনীহা সকল জেলা ক্রীড়া সংস্থার। তারা মনে করে সার্ভিসেস (বিজেএমসি, বাংলাদেশ আনসার ও বাংলাদেশ পুলিশ) দলগুলোই শিরোপা জিতবে, তারা এসে কী করবে! এই মানসিকতা থেকে টিম করতে চায় না জেলা পর্যায়ের সংগঠকরা। ”

“বছর কয়েক আগেও যেখানে ২৫টি দল জাতীয় লীগে অংশ নিত, সেখানে গত জানুয়ারিতে অংশ নিয়েছে মাত্র ১৬টি দল। যার মধ্যে তিনটা ছিল সার্ভিসের দল (বিজেএমসি, বাংলাদেশ আনসার ও বাংলাদেশ পুলিশ)। সার্ভিসেস দলের বাইরে কয়েকটি জেলায় কিছু মান সম্মত খেলোয়াড় আছে। অন্য জেলাগুলোয় তাও পাওয়া যায় না।”

আগ্রহ হারিয়ে মেয়েরা ছুটছে অন্য খেলায়

জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপের পর খেলা না থাকায় আর কোনো কাজ থাকে না মেয়েদের। এমনকি সার্ভিসেস দলগুলোর অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা না থাকায় তাদের খেলোয়াড়ও অনেকটা অলস সময় কাটায়। একটা সময় বিজেএমসি অভ্যন্তরীণ খেলা আয়োজন করত, কিন্তু সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে।

২০০৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন জেলাগুলোকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করে ‘জোনাল’ পর্যায়ে খেলা হত। জোনাল চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স আপ দলগুলো অংশ নিত জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপে। বন্ধ হয়ে গেছে আঞ্চলিক পর্যায়ের খেলাও।

মাঠে খেলা নেই। আর্থিক দিকটাও অনিশ্চিত। মূলত এসব কারণে হ্যান্ডবলের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে মেয়েরা অন্য খেলার দিকে ছুটছে বলেও জানান ১৯৯৫ সাল থেকে নারী দলের কোচের দায়িত্বে থাকা লাভলু।

“দলের সঙ্গে থেকে দেখেছি, মূলত আর্থিক ভাবে অস্বচ্ছল পরিবারের মেয়েরা হ্যান্ডবল খেলতে আসে। তাদের স্বপ্ন থাকে ভালো খেলে একটা চাকরি পাওয়া। ২০১০ সালের দিকে আনসার ও বিজেএমসিতে অনেক খেলোয়াড়ের চাকরি হয়েছিল। সে সুযোগ এখন অনেকটা বন্ধ। দলগুলো এখন খেলোয়াড়দের চাকরি দিচ্ছে না। যারা খেলছে, তারা মাসিক ভাতায় খেলছে। এতে অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে খেলোয়াড়দের ভবিষ্যৎ।”

“এক দশক আগেও হ্যান্ডবলে মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিল ক্রিকেট, ফুটবলের চেয়েও বেশি। কিন্তু এখন আর্থিক নিশ্চয়তার কারণে মেয়েরা হ্যান্ডবলে আগ্রহ হারাচ্ছে। ক্রিকেট, ফুটবলের মতো যেসব খেলায় আর্থিক নিশ্চয়তা আছে, সেদিকে ছুটছে। এসব কারণে খেলোয়াড়ের সংকট বাড়ছে। যার প্রভাব পড়ছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে।”

প্রয়োজন দূরদর্শী পরিকল্পনা, আর্থিক নিশ্চয়তা

ছেলে ও মেয়েদের হ্যান্ডবলে সমস্যা মূলত একই ধরণের। উভয় দলের একাধিক কোচের চাওয়া ‍আর্থিক নিশ্চয়তা, দূরদর্শী পরিকল্পনা। সাবেক খেলোয়াড় ও বর্তমানে হ্যান্ডবল ফেডারেশনের সহকারী সম্পাদক সালাউদ্দিন আহমেদ সমস্যাগুলো মেনে নিয়ে জানালেন পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে তাদের।

“আন্তর্জাতিক ও দেশীয় পর্যায়ে হ্যান্ডবলের উন্নয়নে আমরা পরিকল্পনা হাতে নেয়ার চেষ্টা করেছিলাম। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সঙ্গে আর্থিক বিষয়টিও জড়িত। কোন আর্থিক পৃষ্ঠপোষক পাইনি। আসলে বাংলাদেশে ক্রিকেট ছাড়া বাকি সব ইভেন্টেই স্পন্সর জোগাড় করা অনেকটা কষ্টকর। তবে সবচেয়ে বড় কথা, আমরা প্রতিকূলতাকে জয় করতে পারিনি। অর্থ  সংস্থানের কথা চিন্তা করে আমরা কোনো পরিকল্পনা করে এগিয়ে যেতে পারিনি ।”

“নানা সীমাবদ্ধতায় সার্ভিসেস দলগুলোর নিজেদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেওয়া, এই সংস্থাগুলোতে খেলোয়াড়দের চাকরির অভাব, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খেলোয়াড় কোটায় ভর্তির সুযোগ বন্ধ হওয়া-এসব কারণে এখন খেলোয়াড়রা হ্যান্ডবল খেলার দিকে আসছে না। যাতে মান সম্মত খেলোয়াড়ের অভাব পড়ছে। এসব কারণে আমরা ঘরোয়া পর্যায়ের পাশাপাশি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দল গঠনে সমস্যায় পড়ছে। আমরা ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে  পিছিয়ে পড়ছি।”

খেলার কৌশলের মৌলিক জায়গাগুলোর ভিত গড়ে দিতে হয় ছোট থেকেই। এখানেই বাইরের দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা টানলেন সালাউদ্দিন। দিলেন নতুন শুরুর প্রতিশ্রুতিও।

“একজন খেলোয়াড়ের বেসিক তৈরি হয় শিশুকালে। যেটা বাইরের দেশগুলো করে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে যারা জাতীয় দলে খেলার জন্য উঠে আসে, তারা সার্ভিসেস দলের। ২২-২৩ বছর বয়সে তারা আসে খেলায়।”

“তবে নতুনভাবে শুরুর পরিকল্পনা নিয়েছি। আমরা কোয়ানটিটির দিক থেকে ফিরে আসছি। কোয়ালিটির দিকে যাব। ‘সিলেক্টেড’ জেলা ধরে ধরে কাজ করার পরিকল্পনা নিচ্ছি। একদম তৃণমূলে গিয়ে খেলোয়াড় তুলে এনে তাদের পরিচর্যা করব। তখন আশা করি, সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারব আমরা।”